শরীর ভালো যাবে না। সাংসারিক কলহ বৃদ্ধি। প্রেমে সফলতা। শত্রুর সঙ্গে সন্তোষজনক সমঝোতা। সন্তানের সাফল্যে ... বিশদ
‘সোচ বদলো, বাত বদলেগি’— অর্থাৎ চিন্তাধারা বদলালে তবেই মেয়েদের সামাজিক অবস্থানের পরিবর্তন ঘটবে। কাদের চিন্তাধারা? পুরুষের। পুরুষতান্ত্রিক সমাজের। এবার পুরুষের মাধ্যমে মহিলাদের উন্নত করার উদ্যোগ নিয়েছে নারীকেন্দ্রিক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ‘স্বয়ম’। অনুরাধা কাপুর সংস্থাটির প্রতিষ্ঠাতা-অধিকর্তা। বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করলেন তিনি। তাঁর মতে, মেয়েদের উত্তরণের জন্য সামাজিক মনোভাবের বদল প্রয়োজন। অনুরাধা বললেন, জেন্ডার ইকুয়ালিটি বা লিঙ্গসাম্য না এলে সমাজে মেয়েরা মাথা উঁচু করে স্বাধীন জীবনযাপন করতে পারবে না। ফলে নারী-স্বাধীনতার প্রথম ধাপই লিঙ্গসাম্য। অর্থনৈতিক স্বাধীনতা, শিক্ষা এবং আধুনিক মনোভাব সত্ত্বেও মেয়েরা লিঙ্গবৈষম্যের শিকার হয়। এই পরিস্থিতির পরিবর্তন প্রয়োজন। আর তা একমাত্র সামাজিক চিন্তাধারা বদলের মাধ্যমেই সম্ভব।
সমাজে যখন নারীর ক্ষমতায়ন প্রসঙ্গে আলোচনাসভা হচ্ছে তখন লিঙ্গসাম্য কি আদৌ প্রাসঙ্গিক?
অবশ্যই প্রাসঙ্গিক। আসলে আমাদের দেশের একটা বড় সমস্যা হল এখানে সর্বত্র একইরকম মনোভাব বা চিন্তাধারা বিরাজ করে না। কোথাও হয়তো নারী উন্নয়ন নিয়ে আলোচনা হয়, কিন্তু সমগ্র সমাজের সেটা চিত্র নয়। কোথাও কোথাও মেয়েরা এখনও বৈষম্যের অন্ধকারে পড়ে আছে। ফলে সেই সমাজের চিন্তাধারা বদলানো দরকার। আর তাই আমাদের এই প্রয়াস।
সামাজিক এই চিন্তাধারা বদলের জন্য পুরুষের ভূমিকা কতটা গুরুত্বপূর্ণ?
পুরুষের ভূমিকা এক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ গ্রাম বা শহরতলিতে তো বটেই, এমনকী, শহরের বহু অঞ্চলেও পুরুষতান্ত্রিকতা থেকেই গিয়েছে। সেক্ষেত্রে মেয়েরা সবসময়ই পুরুষের অধীনে। ফলে পুরুষের মানসিকতা না বদলালে মেয়েদের উন্নয়ন অসম্ভব। তাই আমাদের এই কর্মসূচি মূলত পুরুষ ও পুরুষতান্ত্রিক সমাজের উদ্দেশ্যে। তাদেরই বুঝতে হবে যে নারী-পুরুষ একে অপরের পরিপূরক। এবং নারী উন্নয়নের মাধ্যমেই সামাজিক উন্নতি সম্ভব।
সমাজের বদল কীভাবে সম্ভব?
পুরুষতান্ত্রিকতা ও সেই ধরনের চিন্তাধারা পাল্টালেই সামাজিক বদল আসবে। আমাদের সমাজে এখনও মেয়েদের ‘দায়’ মনে করা হয়। পুত্রের আশায় বারবার সন্তানসম্ভবা হতে হয় নারীকে। স্থাবর সম্পত্তি আজও বহু পরিবারেই শুধু ছেলেকে দিয়ে যান বাবা মা। অস্থাবর সম্পত্তি ভাগের বেলাতেও প্রচুর বৈষম্য লক্ষ করা যায়। আর গ্রামে, শহরতলিতে, এমনকী, শহুরে পরিবারেও অনেক ক্ষেত্রেই মেয়ের বিয়ের সময় যৌতুক দিতে হয় বাবাকে। ‘কন্যাদায়গ্রস্ত পিতা’ এই শব্দবন্ধটি আজও বহুল প্রচলিত। এরপরও বলবেন মেয়েরা বৈষম্যের শিকার নয়?
আপনার কী মনে হয়, মেয়েদের ওপর বৈষম্য সমাজের কোন কোন স্তরে সবচেয়ে বেশি?
আমার তো মনে হয় সমাজের সব স্তরেই লিঙ্গবৈষম্য আছে। তার তারতম্য অবশ্যই আছে। কিন্তু কোনও স্তরেই মেয়েরা সম্পূর্ণ স্বাধীন নয়। সমাজের কোথাও মেয়েরা পুরুষের সমকক্ষ নয়। অশিক্ষিত বা অল্পশিক্ষিত সমাজে হয়তো বৈষম্য বেশি মাত্রায় প্রকট, কিন্তু সমাজের উচ্চস্তরের শিক্ষিত পরিবারেও কন্যা অপেক্ষা পুত্রের কদর বেশি। এবং এই চিন্তাধারা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে চলে আসছে। যুগ বদলাচ্ছে, জীবন পাল্টাচ্ছে, তবু চিন্তাধারার বদল হচ্ছে না। তাই সেই চিন্তাধারা বা ‘সোচ’ বদলানোর জন্যই আমাদের এই কর্মসূচির আয়োজন।
আপনাদের গবেষণা অনুযায়ী এই বৈষম্যের উৎস কোথায়?
আসলে এটা একটা ‘প্রিকন্ডিশনড নোশন’। অর্থাৎ মেয়েরা পুরুষের অধীনে এবং পুরুষ আসলে পরিবারের চালকশক্তি— এই ধারণাটা আমাদের মনে বদ্ধমূল হয়ে গিয়েছে। ছেলেদের ওপরেও কিছু দায়িত্ব চাপিয়ে দেওয়া হয়। ছোট থেকেই তাকে ‘বীর’ হতে শেখানো হয়। কাঁদলে তার মা-ই ধমকে বলেন, ‘মেয়েদের মতো কাঁদছিস কেন?’ ফলে সে একদম অল্প বয়সেই বুঝে যায় যে তাকে শক্ত হতে হবে, আবেগ দেখানো চলবে না। অতএব তার চরিত্রে উচ্ছ্বাস থাকবে না, দুঃখ পেলেও তা চেপে যেতে হবে। কেননা, এসবই চারিত্রিক দুর্বলতার লক্ষণ। উল্টোদিকে মেয়েদের কান্নাকাটি, অতিরিক্ত উচ্ছ্বাস সবই চরিত্রের সঙ্গে মানিয়ে যায়। তারাও ছোট থেকেই বাবার ওপর নির্ভর করতে দেখে মায়েদের। ফলে অন্যের ওপর নির্ভরতার বীজ মেয়েদের মনে একদম অল্প বয়সেই বপন করা হয়। আমরা এই স্টিরিওটাইপগুলো ভেঙে দিতে চাই। গতানুগতিকতার বাইরেও যে একটা পৃথিবী আছে, একটা সমাজ আছে— সেটাই পুরুষ ও নারী উভয়ের সম্মুখে তুলে ধরতে চাই।
মেয়েদের পাশাপাশি কি ছেলেদেরও শিক্ষিত করে তুলবে স্বয়মের এই উদ্যোগ?
অবশ্যই। দেখুন, আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজ। আগেও বলেছি সেখানে পুরুষের চিন্তাধারা যতক্ষণ না বদলাবে, ততক্ষণ সমাজের পরিবর্তন অসম্ভব। ফলে প্রাথমিকভাবে পুরুষদের শিক্ষিত করার চেষ্টা করা হচ্ছে আমাদের এই উদ্যোগের মাধ্যমে। সত্যি বলতে কী, আমরা এবার ছেলেদের নিয়েই কাজ করছি।
কীরকম? আর একটু বিস্তারিত বলুন না।
আমাদের উদ্যোগে শেখানো হচ্ছে মেয়েরা পুরুষের পরিপূরক। ফলে মেয়েদের শেখানো হবে তারা ছেলেদের সমকক্ষ। পুরুষও যে মেয়েদেরই সমকক্ষ, তা ভাবতে শেখানো হবে ছেলেদের। আমি বিশ্বাস করি চিন্তাধারার এই পরিবর্তনের মাধ্যমে ছেলেদের জীবনও বদলানো যাবে। আমাদের পরিকাঠামোর মধ্যেই এমন বদল দেখা গিয়েছে। যেমন যে স্তরের নারী নির্যাতন বন্ধ করার জন্য আমরা সক্রিয় হয়েছি, সেখানে পুরুষের জীবনেও আমূল পরিবর্তন এসেছে এবং সেই পরিবর্তন অবশ্যই ভালোর জন্য। এবার আমরা দু’টি ছবি তৈরি করেছি এই উদ্যোগের জন্য। প্রতিটিতে পুরুষকে উন্নতমনস্ক হিসেবে দেখানো হয়েছে। এবং সেই উন্নত চিন্তাধারাই আমরা তুলে ধরার চেষ্টা করছি।
সমাজে এই যে বৈষম্য তার জন্য মেয়েরা কি নিজেরাও খানিকটা দায়ী?
আমার তা মনে হয় না। বরং বলব সমাজই এর জন্য দায়ী। কারণ মেয়েদের কখনও পুরুষের সমকক্ষ ভাবাই হয় না। সবসময় পুরুষের অধীনে রাখা হয় তাদের। এবং এইভাবে তাদের মনেও এই ধারণা বদ্ধমূল হয়ে গিয়েছে যে ঘরে-বাইরে সর্বত্র পুরুষই চালকশক্তি আর মেয়েরা তাদের অধীনে। কিন্তু সামাজিক চিন্তার পরিবর্তন এনে দেখুন, মেয়েদের জীবনটাই বদলে যাবে।
সমাজে একটা ধারণা রয়েছে, মেয়েরা নাকি দায়িত্ব নিতে অক্ষম...।
এই ধারণাটা ভেঙে দেওয়ার জন্য আমাদের অক্লান্ত লড়াই। সমাজ ভেবে নিল মেয়েরা দায়িত্ব নিতে অক্ষম আর ব্যস, ওমনি মেয়েরা অক্ষম হয়ে গেল! মেয়েদের কাঁধে একবার দায়িত্ব দিয়েই দেখা হোক না, মেয়েরা তা সামলাতে পারে কি না? না পারলে তখন তাদের দিকে আঙুল তুলবেন। কিন্তু আমরা তো আগে থেকেই গতানুগতিক চিন্তাভাবনার শিকার হয়ে রয়েছি। আরে মেয়েরা যদি দায়িত্ব নিতে না-ই পারবে তাহলে সংসার সামলে রোজগার করছে কীভাবে? শুধু তা-ই নয়, সংসারের খুঁটিনাটি সব দায়িত্ব এতদিন ধরে মেয়েরা পালনই বা করছে কীভাবে? ফলে ওই দায়িত্ব নিতে না পারার ‘অপবাদ’ আসলে মেয়েদের দমিয়ে রাখার কৌশল।
গতানুগতিকতা বদলের মাধ্যমে পুরুষের জীবন কীভাবে বদলাচ্ছে?
গতানুগতিক শক্ত চরিত্রের বর্মটা ছেলেদের গা থেকে খুলে দিয়ে দেখেছি তারা একটা স্বাভাবিক পারিবারিক সম্পর্কের মধ্যে প্রবেশ করছে। যেমন, একটি ছেলে তার মাকে বাড়িতে রান্নার লোকের ভূমিকায় দেখেই অভ্যস্ত ছিল। সেও তার মায়ের সঙ্গে সেভাবেই ব্যবহার করত। কিন্তু আমাদের সঙ্গে আলোচনা ও কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে সে বুঝতে পেরেছে যে মায়ের ভূমিকা সংসারে শুধুই রান্না নয়। বরং তিনি রান্না করেন বলেই সে খেয়ে-পরে বেঁচে আছে। চিন্তাধারার এই পরিবর্তনের কারণেই আজ তার নিজের মায়ের সঙ্গে একটা সুস্থ স্বাভাবিক সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। সে মায়ের সঙ্গে সময় কাটায়, তার সারাদিনের খোঁজখবর নেয়, নিজের কাজ নিয়ে আলোচনা করে। এর ফলে শুধু বাড়ির মহিলাটিরই নয়, ছেলেটির জীবনও কিন্তু উন্নত হয়েছে। এইভাবেই গতানুগতিকতা বদলের সঙ্গে সঙ্গে নারী এবং পুরুষ দু’জনের জীবনই বদলানো সম্ভব।
সামাজিক কোন স্তর থেকে পুরুষ ও মহিলাদের বেছে নেন আপনারা?
সমাজের সর্বস্তরেই আমাদের বিস্তার রয়েছে। যেখানে প্রয়োজন হয়, আমরা সেখানেই হাজির হয়ে যাই।
আপনাদের উদ্যোগে পুরুষরা কীভাবে কাজ করছে?
পুরুষদের চিন্তাধারার বদল হচ্ছে। তারপর তারাই বিভিন্ন কর্মশালার আয়োজন করছে, কিছু ক্ষেত্রে ছোট ছোট গ্রুপ তৈরি করে পুরুষরা কিছু সেমিনারের আয়োজন করছে। এইভাবে সামাজিক চিন্তাধারার বদলের পিছনে পুরুষদের সক্রিয় ভূমিকা রয়েছে। পরবর্তীতে আরও বেশিমাত্রায় তাদের সক্রিয় অবদান থাকবে বলেই আমার বিশ্বাস।
পয়লা বৈশাখের আগে এই উদ্যোগ শুরু করেছি। এরপর সারা বছর বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এই উদ্যোগ আমরা এগিয়ে নিয়ে যাব। এবং সেই কর্মশালায় পুরুষরাও আমাদের পাশে থাকবে বলেই আমার বিশ্বাস। কারণ মহিলাদের উন্নতির জন্য পুরুষের সক্রিয় অবদান খুবই জরুরি। আমি বিশ্বাস করি এই পৃথিবীর উন্নতির জন্য পুরুষ ও মহিলা সমদায়িত্বের অধিকারী। তাই শুধুই মেয়েদের মানসিক গঠন ও চিন্তাধারার পরিবর্তন আনলে চলবে না, পাশাপাশি পুরুষদের চিন্তারও উন্নতি দরকার। তবেই না সমাজ এগবে!