শরীর ভালো যাবে না। সাংসারিক কলহ বৃদ্ধি। প্রেমে সফলতা। শত্রুর সঙ্গে সন্তোষজনক সমঝোতা। সন্তানের সাফল্যে ... বিশদ
শ্রমিক ধর্মঘট অথবা আন্দোলন। আট ঘণ্টা শ্রমের দাবি। শব্দগুলো সব আমাদের চেনা ও জানা। মে দিবস কী, তা কাউকে ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দিতে হয় না। কিন্তু হতাশার বিষয় একটাই, আট ঘণ্টা কাজের দাবিতে আমেরিকার শিকাগো শহরে শ্রমিকদের সেই আন্দোলনের ১৩৫ বছর পেরিয়ে গিয়েছে, অথচ শ্রমিক বলতে এখনও আমরা শুধু পুরুষদের কথাই ভাবি। বিশ্বজুড়ে বিরাট সংখ্যক নারী যে কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জড়িত, সেখানে তাঁদের অস্তিত্ব প্রায় স্বীকারই করা হয় না। ব্যাপারটা কিছুটা দেখেও না দেখার মতো। আর এই না দেখার, বলা ভালো উপেক্ষার মূল্য দিতে হয় মহিলা শ্রমিকদের। গোটা জীবনের বিভিন্ন স্তরে। নারীশ্রম নিয়ে এই যে দ্বন্দ্ব, তা শেষ হওয়ার নয়। সমাজের দেখার চোখ না পাল্টালে এই দ্বন্দ্ব থেকেই যাবে। মহিলা-শ্রমিকদের নিজেদের জায়গা প্রতিষ্ঠা করতে যুগের পর যুগ আরও ঘাম ঝরাতে হবে।
বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছিলাম স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ইকুইডাইভারসিটি ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা এবং ম্যানেজিং ট্রাস্টি অনিন্দিতা মজুমদারের সঙ্গে। তিনি রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে (সুন্দরবনের পাথরপ্রতিমা-কুলটি, বীরভূমের লাভপুর-নানুর, পুরুলিয়ার ঝালদা) মহিলাদের উন্নয়ন নিয়ে কাজ করেন। তিনি স্পষ্ট করে বোঝালেন যে তিনি যাঁদের নিয়ে কাজ করেন, তাঁরা শ্রমিকের সংজ্ঞা থেকেই হয়তো বাদ পড়বেন। কারণ তাঁদের দেওয়া শ্রম সমাজের চোখে স্বীকৃত নয়। সেটা যেন অদৃশ্য কোনও শক্তি। উদাহরণ দিয়ে বিষয়টা আরও বুঝিয়ে দিলেন অনিন্দিতা। তাঁর কথায়, ‘ধরুন একজন কৃষকের কথা বললেই আপনার কী মনে হয়? একজন শ্রমিক যিনি নিজের জমিতে বা অন্যের জমিতে শ্রম দিচ্ছেন। কিন্তু জেনে রাখুন এই শ্রেণির অসংখ্য মহিলাও কিন্তু কৃষিকাজের সঙ্গে জড়িত। অথচ তাঁরা কখনওই কৃষক বলে পরিচতি হন না। যেন তাঁদের কোনও অস্তিত্ব নেই। এদিকে এটা উৎপাদনমূলক শ্রম। যা করে পরিবারের আয় হচ্ছে। তা সত্ত্বেও সংশ্লিষ্ট মহিলার শ্রম উপেক্ষিত। তার কোনও মূল্য নেই। সব প্রাপ্তি কৃষকের।’
এই সূত্রে অনিন্দিতা জানালেন নারীর দেওয়া শ্রমকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়— ১) উৎপাদনমূলক শ্রম, যা থেকে আয় হয়। ২) প্রজননমূলক শ্রম, শিশুর জন্ম থেকে যত্ন, লালনপালন ইত্যাদি। এবং ৩) সামাজিক শ্রম। তাঁর মতে, উৎপাদনমূলক শ্রমে নারীর স্বীকৃতি অর্জনের পাশাপাশি সমান কাজে সমান মজুরির লড়াইটাও রয়েছে। যেটা আমি-আপনি সবাই হয়তো লড়ছি। অর্থাৎ একই ধরনের কাজ করেও একজন পুরুষ যা উপার্জন করতে পারেন, একজন নারীকে আজও অধিকাংশ ক্ষেত্রে তার তুলনায় কম মূল্য দেওয়া হয়। এই বৈষম্য চলছেই।
প্রজননমূলক শ্রমের কথা যদি ধরেন, তাতে নারীর অংশগ্রহণ সবাই দেখতে পান। কিন্তু সেই অংশগ্রহণকে শ্রমদানের কোনও পর্যায়েই ফেলা হয় না। অর্থাৎ নারী ওই শ্রম দিতে যেন একরকম ‘বাধ্য’। ধরে নেওয়া হয় বাচ্চার যত্ন তাঁর একারই দায়িত্ব এবং তাই সে দায়িত্ব পালন করলেও নারীর শ্রমের আলাদা কোনও মর্যাদা নেই। ‘একজন নারী তাঁর গোটা জীবনের নিরিখে যে পরিমাণ শ্রম দান করেন, তার কত শতাংশ স্বীকৃত?’ প্রশ্ন তুললেন অনিন্দিতা। ‘বরং সারাদিনের খাটাখাটনির পর বাড়ির কর্তার মুখে হয়তো তাঁকে শুনতে হয়, আমার বউ সন্ধেবেলা শুয়ে শুয়ে সিরিয়াল দেখে। বাড়ির কাজে মহিলাদের নিয়মিত শ্রম ব্যয় এবং তার স্বীকৃতি না থাকার বিতর্কটা বহুদিনের। অথচ মেয়েটি কাজকর্ম গুছিয়ে না দিলে বাড়ির পুরুষটি কিন্তু বাইরে গিয়ে কাজ করতে পারবেন না বা বউ না দেখলে বাড়িতে ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা হবে না। পড়াশোনা করাতে গিয়েও একজন মেয়ে যে শ্রম ব্যয় করেন, তা-ও লোকচক্ষুর আড়ালেই যেন থেকে যায়।’ কিন্তু এসবের আর্থিক মূল্য কি হয়? তিনি বললেন, ‘হয় না। কারণ আমরা সেভাবে দেখতেই শিখিনি। সমাজ সেটা দেখতে শেখায় না। অথচ নারীর শ্রমদানের বিষয়টি আর্থিক প্রেক্ষাপটে বিচার না করা হলে তা তো চিরকালই মূল্যহীন থেকে যাবে। আর ঠিক সেটাই হয়ে চলেছে।’
নারীশ্রমের ভরসায় একটা সমাজ দিনের পর দিন এগিয়ে চলেছে অথচ সেই শ্রমকে স্বীকার করা তো দূর, তা মাপারও কোনও দাড়িপাল্লা নেই। বিশ্বের বেশিরভাগ দেশেই সেটা চলছে।
এরপর অনিন্দিতা চলে গেলেন সামাজিক শ্রমের কথায়। ‘সমাজে যখন কারও পাশে কোনও পুরুষ দাঁড়াচ্ছেন, তা অনেক সময়েই বিরাট করে দেখানোর প্রবণতা দেখা যায়। যেন আর কেউ এটা করতেই পারতেন না। অথচ খুব ঢাকঢোল না পিটিয়েও একজন নারী হয়তো সেটা করে চলেছেন দীর্ঘকাল ধরে। যেমন ধরা যাক, আজ আমার বাড়িতে খুব অসুবিধে, আমি আমার বাচ্চাকে পাশের বাড়ির বৌদির কাছে রেখে গেলাম। এমন ছোট ছোট অনেক ক্ষেত্র আছে। কোনও মহিলা হিংসার শিকার হচ্ছে দেখে প্রতিবেশী হিসেবে তা রুখে দিলেন আর এক মহিলা। স্বনির্ভর গোষ্ঠী করে মেয়েদের পাশে দাঁড়ালেন কেউ। এই ধরনের সামাজিক শ্রম কিছুটা চোখে পড়লেও তা মূল্যহীন। আর মূল্য নেই মানেই সমাজের কাছে তা ধর্তব্য নয়।’
প্রত্যন্ত গ্রাম্য এলাকার মহিলাদের নিয়ে ওয়ার্কশপের অভিজ্ঞতা জানালেন অনিন্দিতা। তাঁর কথায়, ‘কারও পরিচয় জানতে চেয়ে যখন প্রশ্ন করি, কী করো? তার উত্তর আসে, কিছুই করি না। এটা শুধু গ্রামে বলে নয়। যে কোনও শহুরে শিক্ষিত হোমমেকারকেও এই প্রশ্ন করলে শুনবেন, আমি কিছু করি না। সুতরাং আমরা নিজেরাই নিজেদের কাজের কোনও মূল্য দিতে শিখিনি। এইভাবেই শিক্ষাটা চলে এসেছে। এতে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের সুবিধা হয়েছে।’ তবে এর মধ্যেও লড়ছেন মেয়েরা। অনিন্দিতা জানান, যেসব মহিলার সঙ্গে তাঁরা কাজ করেন, বাড়িতে মার খেয়েও তাঁরা স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার আলোচনায় যোগ দিতে আসেন। মারের সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের জবাবদিহিও করতে হয়— কেন মিটিংয়ে যাবে, কী পাবে ইত্যাদি। যে মেয়েটি বিশেষ প্রশিক্ষণ নিতে দূরে কোথাও যাচ্ছেন, তাঁর গতিবিধি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা এবং এ ক্ষেত্রেও শারীরিক নির্যাতন চালানো হয়। আজকাল মেয়েরা মার খেয়েও ফের চলে আসেন কাজ শিখতে। ধরে নেওয়া যায় এইটুকু জোর বেড়েছে, বললেন তিনি।
গ্রামের মেয়েরা দূর দূর থেকে শহরে পরিচারিকার কাজও করতে আসছেন। বাড়ি থেকে তাঁরা ছাড় পাচ্ছেন কারণ সংসারে তাঁদের উপার্জিত অর্থের প্রয়োজন। কিন্তু গ্রামের বাইরে তাঁদের নিরাপত্তা? তাঁদের কাজের ক্ষেত্রে যাতায়াতের অসুবিধা? অনিন্দিতা মনে করালেন, ‘এগুলো নিয়ে স্পষ্ট কোনও দিশা নেই আমাদের সমাজে। ওই মেয়েদের কর্মক্ষমতা মাপা তো ছেড়েই দিলাম। কত দিন এভাবে কাজ চালিয়ে যেতে পারবেন তাঁরা?’ ইদানীং আবার শোনা যাচ্ছে কর্মক্ষেত্রে এখন মেয়েদের অংশগ্রহণ কিছুটা কমতির দিকে। কেন? প্রশ্নটা তুলতে হবে। নিরাপত্তা যদি একটা কারণ হয়, তাহলে কাজের পরিবেশ আর একটা কারণ। অনেক কাজের জায়গায় মহিলাদের জন্য সঠিক টয়লেটটা অবধি নেই। মহিলারা বাচ্চাকে রাখতে পারেন, এমন ক্রেশের ব্যবস্থা ক’টা সংস্থায় আছে? বাইরে কাজ করতে হবে শুনে মহিলার বাড়ির লোক কতটা তাঁর পাশে আছে? — এই ধরনের বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা হয় না। শুধু তথ্য দিয়ে দেখানো হয়, মহিলারা বাইরে কাজ করতে চান না। গঠনগত পরিবর্তনের কথা বলা হয় না।
তবে কোভিডও একটা বড় শিক্ষা দিয়েছে। এই সঙ্কটে বহু পুরুষ কর্মহীন হয়েছেন। এতদিনে যেন মহিলাদের শ্রমের জায়গাটা কিছুটা হলেও চোখে পড়েছে। অনিন্দিতার মতে, মহিলাদের মধ্যে যাঁরা শহরে গিয়ে কাজ করতেন, সেটা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল লকডাউনে। তাই গ্রামে কৃষিকাজেও হাত লাগিয়েছেন অনেকে। বহু স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ‘সাসটেনেবল লাইভলিহুড’ নিয়ে কাজ করছে। এই ক্ষেত্রেও মহিলাদের ভূমিকা অগ্রগণ্য। চাষের কাজটাই ধরা যাক। পুরুষ চাষির মতো চাষের কাজ মেয়েদেরও বাণিজ্যিক দিক থেকে দেখতে হবে। মেয়েরা সেটাই পারেন না। মেয়েরা প্রথমে ভাবেন চাষবাস থেকে আমার পরিবার কতটা উপকৃত হবে, তারপর আসে রোজগারের ভাবনা। জৈব সার তৈরির মতো কিছু কাজে পুরুষদের কম পাওয়া যায়। কারণ তাতে প্রথমেই বাণিজ্যিক লাভ হয় না। মেয়েরা এই ঝুঁকিটা নেন। যা আখেরে পরিবারের কাজে লাগে। ‘কিন্তু যে মহিলা শুধু বাড়ির কাজ করতে হবে বলে ভোর পাঁচটায় উঠতেন, তিনি বাইরেও কাজ করতে যাবেন বলে রাত তিনটেয় উঠে পড়ছেন। এই অতিরিক্ত সময়টার দাম কে দেবে’? ফের ভাবিয়ে তুলে অনিন্দিতা বলেন, ‘প্রাণ দিয়ে কাজ করার জন্য মহিলাদের ডাকব, কিন্তু এত বড় একটা চালিকাশক্তি আমাদের চোখে অদৃশ্য হয়ে থাকবে। কোভিডের সময় পরিযায়ী শ্রমিকদের মর্মান্তিক মৃত্যু আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখাল, এমন একটা শ্রেণিও রয়েছে যারা ঘর ছেড়ে এইভাবে বাঁচতে বাধ্য হচ্ছে। চোখের সামনে নারীর অবিরত শ্রমদান চললেও তা চোখের আড়ালে থেকে যায়। লিঙ্গবৈষম্যের সমীকরণ কাজ করে এভাবেই।’