কর্মপ্রার্থীদের ধৈর্য্য ধরতে হবে। প্রেম-প্রণয়ে আগ্রহ বাড়বে। নিকটস্থানীয় কারও প্রতি আকর্ষণ বাড়বে। পুরোনো কোনও বন্ধুর ... বিশদ
১৯৬৯ সালে তিনি মিস্ ইন্ডিয়া প্রতিযোগিতায় দ্বিতীয় স্থান লাভ করেছিলেন। সেন্ট জন্স ডায়াসেশান গার্লস স্কুল-এর ছাত্রী ছিলেন। প্রথম নৃত্য প্রদর্শন মঞ্চে, যখন মাত্র চার বছর বয়স, তারপর প্রায় ছয় দশক পেরিয়ে তিনি আজও নৃত্যরত। শিল্পী অলকানন্দার কৃতিত্ব কেবল নৃত্যাঙ্গনেই নয়, তিনি আর এক ভূমিকায় মহীয়সী নারী। প্রবীণ নৃত্যশিল্পী অলকানন্দা অবশ্যই স্বমহিমায় স্বতন্ত্ররূপে প্রতিষ্ঠিত। পণ্ডিচেরির অরবিন্দ আশ্রমে গত পুজোর মরশুমেও নৃত্য প্রদর্শন করেছেন। অসামান্য এই শিল্পীর চিন্তাভাবনা এবং কর্মকাণ্ড অতুলনীয়। ওঁর অনুপ্রেরণা মা ও মামার বাড়ি। মা দেবী চাকলাদার, বিখ্যাত সঙ্গীতশিক্ষা প্রতিষ্ঠান ‘দক্ষিণী’-তে গান শেখাতেন। সঙ্গীতশিল্পী মায়ের আশীর্বাদধন্য হয়ে অলকানন্দার শিল্পী জীবন শুরু হয়েছিল। দাদার প্রতি বিশেষভাবে কৃতজ্ঞ।
সাত দশকের নৃত্য জীবনে, সাত মাসের ছেদ পড়েছিল প্রথম যখন, অলকানন্দার স্বামী ইহলোক ত্যাগ করেছিলেন। সেটা ছিল ১৯৮৮ সাল। ‘উনি চলে গেলেন। ছেলে এবং মেয়ে দুই সন্তানকে নিয়ে আমি নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু দুই সন্তানই আমাকে সেই সময় মনোবল জুগিয়েছিলেন, ওরাই নানাভাবে সহযোগিতা করেছে। ওদের জন্যই আমি দুর্বলতা কাটিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছিলাম’— স্মৃতিচারণ করলেন শিল্পী। নৃত্যমঞ্চে পুনরাগমনে ওঁর সন্তানদের অকল্পনীয়ভাবে কো-অপারেশন ছিল। দ্বিতীয়বার ১৯৯৬ সালে অলকানন্দার একটা পা প্যারালাইসড হয়ে গিয়েছিল, কোনও এক দুর্ঘটনায়। সেই কঠিন পরিস্থিতিতেও ওঁর নাচের প্রতি অত্যন্ত গভীর ডিভোশন, অসম্ভব আত্মপ্রত্যয় এবং সেই সঙ্গে সুপার-পাওয়ারে বিশ্বাসের জন্য তিনি সুস্থ হয়ে নৃত্যাঙ্গনে ফিরে এসেছেন। শুরু হয়েছিল শিল্পীর আর এক অধ্যায়।
অলকানন্দা নতুন উদ্যামে নতুন কাজ আরম্ভ করেছিলেন। শিল্পী নতুন এক পরিচয় পেলেন, তিনি মা হলেন, অনেক দিশাহীন মানুষের। ওঁর জবানিতে জেনে নেওয়া জাক। ‘সেটা ছিল ২০০৭ সালের আন্তর্জাতিক নারী দিবসের দিন। এক নৃত্যানুষ্ঠানে উপস্থিত হলাম। যেখানে বন্দিরা অংশ নিয়েছিল। যাদের দেখে আমার অন্তর কেঁদেছিল। মনে হয়েছিল ওদের সুস্থ-স্বাভাবিক জীবনে ফেরানো যায় এই নাচের মাধ্যমে। নৃত্যনাট্য দেখার পর তাদের মধ্যে পরিবর্তন দেখেছিলাম। তারা আপ্লুত হয়েছিল। আমি নানান প্রতিকূলতার মধ্যে নাচটা বাঁচিয়ে রেখেছি। অনুষ্ঠান শেষে আমার মায়ের কথা মনে পড়ল। যিনি বিশ্ব সংসারের মা তাঁর কথা। আর ওই ভাগ্যহতরাও আমাকে মা ডাকতে লাগল। পুরানোরা অনেকেই চিত্ত বিশুদ্ধ হলে সমাজ জীবনে ফিরে যায়। আবার নতুন যারা আসে সংশোধনাগারে আমি তাদেরও মা হয়ে যাই। এমনি করে শতাধিক পথভ্রষ্ট মানুষ শাপমুক্ত হয়ে স্বাভাবিক জীবনযাপন করছে। ওদের সঙ্গে কাজ করতে করতে আমি ওই মানুষগুলোকে ভালোবাসতে শুরু করি, আর কোনও দিন তাদের অতীত সম্পর্কে জানতে চাই না। শুধু চাই ওরা ভালো থাকুক।’ শিল্পী ভীষণ রকমের আশাবাদী এবং দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন, তিনি সৌভাগ্যবতী। সত্যি অসম্ভবকে সম্ভব করার মনোবল ওঁর আছে। সংশোধন করে মানুষগুলোকে সমাজের মূলস্রোতে ফিরিয়ে দিয়ে, অদ্ভুত এক আত্মতৃপ্তি লাভ করেন। ওঁর কথায়, ‘যদি কোনও মানুষ ভুল করে তার যেন অপরাধবোধটা থাকে। আমি ক্ষমা করে দিই। এই কাজ কেবল আমার বলে ভাবি না, এছাড়া পরক্ষেভাবে সমাজও লাভবান হয়।’
অলকানন্দা কিছুটা প্রচারবিমুখই বলা যায়। ‘মুক্তধারা’ সিনেমাতে শিল্পীকে দেখানোর প্রয়াস প্রশংসনীয় হলেও, ওই বায়োপিকে ওঁর আসল জীবন ও স্ট্রাগল তেমনভাবে ধরা পড়েনি বলেই শিল্পী আক্ষেপ করেন। যদিও রিয়েল লাইফকে চিত্রনাট্যে প্রায় সব সময় নাটকীয় করা হয়। শোনা যায় চলচ্চিত্রে উপস্থাপনার ধরণটাই এমন। সাহিত্য ও সিনেমার মধ্যেও পার্থক্য থাকেই। যাই হোক, এই ছবিটি মুক্তি পাবার আগে মাতৃরূপী অলকানন্দাকে অনেকেই জানত না। ‘কোনও দিন আমি প্রচার উন্মুখ ছিলাম না। জীবনে যা পেয়েছি তা অনেক।’ এই সুন্দর আত্মোপলব্ধি ও সহজ দর্শন অবশ্যই সাধুবাদাই। সংশোধনাগারের ছেলেমেয়েরা কখনও রবীন্দ্রনাথের ‘বাল্মীকি প্রতিভা’, কখনও যিশুখ্রিষ্টের বা কাজী নজরুলের জীবনী নিয়ে নৃত্যনাট্য করেছে। সম্রাট অশোকের কলিঙ্গ যুদ্ধ জয় অবলম্বনে নৃত্যনাট্য ‘মোক্ষগতি’। নৃত্যনাট্যটি উপস্থাপিত হওয়ার পর উচ্ছ্বসিত প্রশংসা পেয়েছে।
অলকানন্দা বলেন, মোক্ষগতিতে একজন মা গল্প বলছে, সে সকলের মা। ট্রান্সফরমেশন এবং রিয়ালাইজেন-এর যে মিলিত অনুভূতি হয় সেটাই মোক্ষলাভ। এটাই দেখানো হয়েছে। চিত্রনাট্য লিখেছেন শিল্পী নিজেই।
এই অভিনব সুন্দর কাজের কোনও উত্তরসূরি তৈরি হয়েছে বা হবে? অলকানন্দার অসামান্য দার্শনিক উত্তর— ‘কোনও কিছুই থেমে থাকে না। পরের প্রজন্ম নতুন ভাবনায় কিছু করবে, নিশ্চয় কাজ চলবে। তবে আমি যেভাবে ওদের ভালোবেসে আপন করি বা ওরা যেভাবে আমাকে মায়ের মতো গ্রহণ করে, সেখানে এই মুহূর্তে অন্য কাউকে ওরা নিতে পারছে না। ওইসব মানুষগুলোকে নিয়ে প্রায় ১৮৭/১৮৮টা শো করেছি। মাঝে মধ্যে অনেক দূরে গিয়েছি ওদের নিয়ে, কিন্তু ওরা কোনও দিন আমার মাথা নীচু হতে দেয়নি।’
একটা ভাবনা শিল্পীকে ভাবায়, ওঁর কথায় এখানকার বেশির ভাগ মানুষ যেন দুঃখবিলাসী। জীবনে ভালোটা মনে রেখে কষ্ট ভুলতে হয়। যারা পারে না তাদের কোনও কাউন্সেলিংও হেল্প করবে না। নেগেটিভিটিতে কখনও কোনও লাভ হয় না। এটাই ওঁর জীবন দর্শন। ‘লাভ থেরাপি ইন মাই সেকেন্ড হোম’— অলকানন্দার এই ডকুমেন্টারি ফিল্মটা লস এঞ্জেলসের জেলে দেখানো হয়েছে। ওখানে গিয়ে শিল্পী অভিভূত হয়েছেন। ওখানকার বন্দিরাও ওঁকে ‘মামা রয়’ বলে ডাকে। ওখানে ডকুফিল্ম দেখে সকলেই মুগ্ধ হয়েছে। গত ১৪ আগস্ট পোস্টাল এক স্ট্যাম্পে দেখা গিয়েছে, এই সম্মান যাতে শিল্পী ‘বিমোহিত’। তিনি বলেন, ‘আমি শুধু কাজ করেছি।’ শিল্পীর জীবন এবং কাজ এক অনন্য সংগ্রাম। যেখানে এক অদ্ভুত রিভোলিউশন আছে। ‘আমাকে যারা ভালোবাসে কোনও না কোনাওভাবে তারাই আমার অনুপ্রেরণা’
শাকিলা খাতুন