কর্মপ্রার্থীদের ধৈর্য্য ধরতে হবে। প্রেম-প্রণয়ে আগ্রহ বাড়বে। নিকটস্থানীয় কারও প্রতি আকর্ষণ বাড়বে। পুরোনো কোনও বন্ধুর ... বিশদ
ঘটনা এক: রুমির বাচ্চার মুখেভাতের পর ও কিছুদিন বাচ্চাকে নিয়ে শ্বশুরবাড়িতেই ছিল। আর রুমির বর কর্মস্থলে ফিরে গিয়েছিল। বাচ্চাকে যেহেতু রেখে এসেছে, তাই বরের প্রাণ সেখানেই পড়ে থাকত। প্রায় ঘণ্টায় ঘণ্টায় বাচ্চার খোঁজ নেওয়ার জন্য রুমির বর রুমিকে ফোন করত। এটা দেখে রুমির শাশুড়ি গেলেন চটে। তিনি তাঁর ছেলেকে বলে বসেন, ‘কীরে ছেলে পেয়ে মাকে ভুলে গেলি?’।
ঘটনা দুই: রিঙ্কির বাড়িতে যখনই দুই ননদ আসে তখনই তার শাশুড়ি আর ননদরা মিলে গুজুর গুজুর, ফুসুর ফুসুর করেই চলে। আর রিঙ্কি সামনে গেলেই সবাই হঠাৎ চুপ করে যায়। এদিকে রিঙ্কির ছোট ননদের শাশুড়ি নাকি এতই খারাপ যে তিনি ছেলে আর তার বউকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছেন। রিঙ্কির ননদরা একদিকে ভাই-বউয়ের নামে কুৎসা রটায় আবার অন্যদিকে নিজের শাশুড়ির নামে বদনাম করে। একদিন রিঙ্কি এই নিয়ে নিজের শ্বাশুড়িকে প্রশ্ন করলে তিনি বললেন বয়সকালে তাঁর মেয়েরাই তাঁর ভরসা হবে এ বিষয়ে তিনি নিশ্চিত। এসব দেখে দেখে রিঙ্কির এদের প্রতি ঘেন্না ধরে গেছে।
ঘটনা তিন: বিয়ের কয়েক মাসের মাথায় বাপের বাড়ি এসেছে সুমিতা। বিয়ের আগে একটু মোটাসোটা ছিল সে। কিন্তু এখন বেশ রোগা হয়েছে। আসলে ওর বরের চাপে পড়ে নিয়মিত যোগাসন করছে এখন। তাই চেহারার এত পরিবর্তন। কিন্তু এই রোগা হওয়াটা পাড়ার কাকিমার চোখে ধরা পড়তেই তিনি বলে বসলেন, ‘কী রে বরে খেতে-টেতে দেয় না নাকি?’ সুমিতার রাগ হলেও মায়ের শিক্ষার কারণে কিছু বলেনি।
উপরের বাস্তব ঘটনাগুলোর মাধ্যমে মেয়েদের স্বভাবের বিভিন্ন দিক তুলে ধরা হল। অস্বাভাবিক অধিকারবোধ, হিংসা, টোন-টিটকিরি কেটে আনন্দ পাওয়া ইত্যাদি নিয়েই তাদের জীবন।
আগেকার দিনে মেয়েদের জীবন একটা গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ ছিল। স্বামী এবং সংসার এই ছিল তাদের পুরো জগৎ। এই জগতে থাকার কারণে তারা বাইরের জগতের সম্বন্ধে অবগত ছিল না। তাই তাদের আলোচনার পরিধিও কম ছিল। তখন সুযোগ পেলেই তারা নিজের আনন্দের জন্য আর পাঁচজন মহিলার সঙ্গে নিন্দে-মন্দর ঝাঁপি খুলে বসত। আর সেই ঝাঁপি থেকে একে একে পাড়ার কেচ্ছা, নিজের ছেলের বউয়ের খারাপ স্বভাব, মেয়ের শাশুড়ির শয়তানি, ছেলের ওপর অধিকারবোধ সব কিছু বেরিয়ে আসত।
শুধু বাস্তবে নয়, সাহিত্যেও এই ধরনের মহিলাদের দেখা পাওয়া যায়। শরৎচন্দ্রের অরক্ষণীয়া উপন্যাসে জ্ঞানদাকে বিয়ে দিতে না পারার জন্য তার মাকে হাজার রকম কথার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। এছাড়াও গৃহদাহ, চোখের বালি সহ হাল আমলের বহু উপন্যাস বা গল্পে আমরা মেয়েদেরকে সাংসারিক কূট-কচালি বা নিন্দে-মন্দ অথবা নিজস্ব অধিকার সচেতন জীব হিসেবেই দেখতে পাই। এক্ষেত্রে বর্তমান মেগা ধারাবাহিকগুলোও কোনও অংশে পিছিয়ে নেই।
আগেকার দিনের পর্দানসিন মেয়েদের কোনও জগৎ না থাকার কারণে ধরে নেওয়া যেতেই পারে যে, তারা নিজেদেরকে ভালো রাখার জন্য পরনিন্দা পরচর্চা থেকে শুরু করে অন্যের প্রতি হিংসা, অন্যকে কটু কথা শুনিয়ে আনন্দ লাভ প্রভৃতি কাজে মেতে থাকত। কিন্তু বর্তমান যুগের মেয়েরা কাজের সুবাদে বাইরে বের হচ্ছে, বাইরের পৃথিবীকে দেখতে পাচ্ছে। স্থল, জল আর আকাশকে নিজের হাতের মুঠোর মধ্যে নিতে সক্ষম হচ্ছে। তবুও তাদের মধ্যে এখনও অধিকারবোধ, হিংসা, পরনিন্দা করার প্রবৃত্তি প্রবল। এতটা শিক্ষিত হওয়ার পরেও মেয়েদের এরকম স্বভাবের কারণ কী? কী বলছেন মনস্তত্ত্ববিদ।
মনস্তত্ত্ববিদ রাজ্যশ্রী বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা অনুযায়ী সোশ্যাল সাইকোলজি মনস্তত্ত্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ। এই শাস্ত্রে Stereotyp (স্টিরিওটাইপ) বলে একটি কথা আছে। স্টিরিওটাইপ অর্থাৎ প্রচলিত ধারণা। সেই ধারণার কোনও মানুষ, জাতি বা বিজ্ঞানের সঙ্গে মিল নাও থাকতে পারে। মহিলাদের ক্ষেত্রে একটি স্টিরিওটিপিকাল (Stereotypical) কিছু ধারণা মানুষের মধ্যে রয়েছে। সেইসব ধারণা অনুযায়ী তারা পেটে কোনও কথা রাখতে পারে না। শুধু মেয়েলি গসিপ করে ইত্যাদি।
আগেকার দিনের মহিলারা পুরুষদের সঙ্গে বিশেষ দূরত্ব রক্ষা করেই চলতেন আর নিজেদের অন্দরমহলেই আবদ্ধ করে রাখতেন। তাই ঘরোয়া আলোচনাই তাঁদের কথাবার্তার মুখ্য উপাদান ছিল। সেই থেকেই এমন স্টেরোটাইপ তৈরি হয়েছে। সব মহিলা সমান নয়। আগেও সমান ছিল না। এখনও তাই। এর সঙ্গে চাকরি করা বা না করার যেমন সম্বন্ধ নেই, তেমনই সমাজের স্তরেরও কোনও সম্বন্ধ নেই। গসিপ করা না-করাটা ব্যক্তিগত রুচির ওপর নির্ভর করে। সাধারণত হাই সোসাইটি এবং মধ্যবিত্ত মহিলাদের মধ্যে গসিপ করা, একের কথা অন্যের কাছে লাগানোর প্রবণতা বেশি দেখা যায়। তুলনামূলকভাবে যে সব মহিলারা শ্রমিকের কাজ করেন তাঁদের মধ্যে এই স্বভাব ততটা লক্ষ করা যায় না।
মানুষের লাইফস্টাইল, তার নিজের পছন্দ-অপছন্দ, মূল্যবোধ প্রভৃতি তার চরিত্রের প্রধান দিক। তাই সব মহিলা একই রকম হবে, ভাবাটা বোকামি।
আজকের নারী প্রাচীন গণ্ডি ভেঙে অনেক পরিবর্তিত ও পরিবর্ধিত হয়েছে। তাই আজ আর তাদের সম্পর্কে বিশেষ কোনও একটা প্রচলিত ধারণা পোষণ করাটা ঠিক নয়।
পরিশেষে এটাই বলব যে, মেয়েলি আচার-ব্যবহার সম্পর্কে যে ধারণা লোকের মনে গেঁথে আছে তা মূলত প্রচলিত। সেই ধারণা ভাঙতে না পারলে মেয়েরা সমাজে উন্নতি করতে পারবে না।
কাকলি পাল বিশ্বাস