একবিংশ শতাব্দীতে পদার্পণের আগে মুসলিম সমাজে নারী স্বাধীনতা প্রহসন ছিল বললে অত্যুক্তি হয় না। মাত্র কয়েক দশক আগেও মুসলিম নারী ছিল অন্তঃপুরবাসিনী। অবগুণ্ঠনের আড়াল থেকেই তাদের বিশ্বদর্শন হতো। কিন্তু সেই চিত্র আজ অনেকটাই বদলে গিয়েছে। এই প্রজন্মের শিক্ষিতা নারী নিজস্ব সত্তা আবিষ্কার করতে মরিয়া। সেই সংগ্রামে জোরকদমে এগিয়ে চলেছে মুসলিম মহিলা সমাজ। আধুনিকতা ও শিক্ষার আলোকস্পর্শে সমাজের রূপান্তর ঘটছে প্রতিনিয়ত।
১৯৭৫ সালের ৮ মার্চ শুরু হয় আন্তর্জাতিক নারী দিবস। জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে বিশ্বের সমস্ত মহিলা ঐক্য প্রদর্শন করেছিল। জাতিসংঘের আহ্বানে সেখানে মুসলিম মহিলারাও অংশগ্রহণ করেছিল। সামান্য পর্যালোচনায় দেখা যাক এই সমাজের বর্তমান অবস্থান। শিক্ষার অধিকারই এই মুসলিম কমিউনিটির প্রথম ও প্রধান আলোচ্য বিষয়। কারণ, শিক্ষার আলো ছাড়া কোনও জাতির অগ্রগতি কল্পনাও করা যায় না। সেইসঙ্গে দেশ ও সমাজের উন্নতিও অসম্ভব। উনিশ শতকের ভারতবর্ষের অর্থাৎ গত কয়েক দশক পেছনে তাকালে দেখা যায় এমন এক নারী-সমাজের ছবি, যা এই মুহূর্তে ভাবলে অনেক মহিলাই আতঙ্কিত হবেন। বর্ণবিদ্বেষ ছিল তুঙ্গে। নিম্নবর্গের শিক্ষার অধিকার ছিল না, পড়ালেখা করার ইচ্ছাপ্রকাশও অপরাধ হিসেবে গণ্য হতো। ধীরে ধীরে সমাজ সংস্কারকদের আপ্রাণ চেষ্টায় সেইসব কুপ্রথা দূর হয়েছে। আমূল পরিবর্তন হয়েছে সমাজের। মুসলিম সমাজের ধ্বজাধারীদেরও কিছুটা বোধোদয় হয়েছে। উপলব্ধি করেছে, নারীজাতির কল্যাণ ও শিক্ষা ছাড়া সুন্দর সমাজ ও উন্নত দেশের কল্পনা করা যায় না।
একসময় অভিভাবকদের দৃষ্টিভঙ্গি বিশেষভাবে মেয়েদের প্রতিষ্ঠিত ও স্বনির্ভর হওয়ার পথে অন্তরায় ছিল। কিন্তু সেই জায়গায় মেয়েরা এখন সাহস সঞ্চয় করে সমস্ত বাধা-বিপত্তির মোকাবিলা করতে শিখেছে। মুসলিম সমাজের অন্দরমহলের জীবনযাত্রার দিকে একটু নজর দিলেই দেখা যাবে সম্প্রতি পর্দাপ্রথা কিছুটা শিথিল হয়েছে। ধর্মের গোঁড়ামি থেকে মুক্ত, উদারমনস্ক হয়েছে অনেকেই। পরিবেশ ও পরিস্থিতি এই মানসিক পরিবর্তনে বাধ্য করেছে। যদিও পর্দাপ্রথা ইসলাম ধর্মের বিশেষ অঙ্গ, কিন্তু এই প্রথা ও স্বনির্ভর হওয়ার মধ্যে কোনও বিরোধ নেই। শালীনতা রক্ষা করেও প্রতিষ্ঠিত হওয়া যায়, যার অন্যতম দৃষ্টান্ত বেগম রোকেয়া।
এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী গত ২৫-৩০ বছরে ছেলেদের তুলনায় মুসলিম মেয়েদের শিক্ষাগ্রহণে আগ্রহ আশাতীত ভাবে বেড়েছে। মেয়েরা যে-কোনও বিরূপ সিদ্ধান্তের এবং অন্যায়ের প্রতিবাদ করার মতো সাহসী হয়েছে। এই শতাব্দীর মেয়েদের শিক্ষানুরাগও যেমন বেড়েছে তেমনই স্বাবলম্বী হওয়ার ইচ্ছেও জেগেছে। কেবল বড় শহরেই নয় প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের মেয়েদের দূরে গিয়ে অথবা আবাসিক হিসেবে থেকেও উচ্চশিক্ষিত হতে দেখা যাচ্ছে। প্রায় নব্বই শতাংশ মেয়েই বলছে, প্রথমে প্রতিষ্ঠিত হই, পরে বিয়ে। ভবিষ্যৎ সুনিশ্চিত করার লক্ষ্যে এগিয়ে চলেছে এই প্রজন্ম। আনন্দের বিষয়, এযুগে অভিভাবকরা মেয়েদের পক্ষেই মত দেন। অন্যদিকে আর্থিক সঙ্গতিসম্পন্ন হওয়ার ফলে নারীর মর্যাদাও বেড়েছে। চাকরি না করলেও মেয়েরা শিক্ষা সম্পূর্ণ করে, উপার্জনক্ষম তথা যোগ্যতা অর্জন করেই বিয়েতে রাজি হচ্ছে।
কোরান-এ প্রথম ঐশ্বরিক বাণী ছিল ‘ইকরা’-মানে পড়াশোনা করা। ওই নির্দেশ নারী-পুরুষ সবার জন্যই। ইসলামে নারীর অধিকার খর্ব করা হয়নি। যদিও মুসলিম মহিলা সমাজ অনগ্রসর বলেই অভিহিত এবং একথা অনস্বীকার্য, তুলনামূলকভাবে মুসলিম মহিলাদের অনেক বেশি সংখ্যায় লাঞ্ছনা ও নিপীড়নের শিকার হতে দেখা যায়। কিন্তু ইসলামের অভ্যুত্থানের যুগে শাস্ত্রে নারীর যে সমস্ত অধিকারের উল্লেখ আছে তা প্রায় অনেকাংশেই কল্পনাতীত। ইসলামে নারীর সম্মতি ছাড়া বিবাহ সম্পন্ন হয় না। নারী চাইলে এবং সঙ্গত কারণে বিবাহ-বিচ্ছেদও ঘটাতে পারে, এছাড়া নারীর বিধবাবিবাহ ও পুনর্বিবাহ স্বীকৃত ছিলই। নারী শিক্ষার প্রয়োজনীয়তার কথাও বিশেষভাবে বলা হয়েছে। উত্তরাধিকার সূত্রে মেয়েরাও সম্পত্তির অংশীদার কিন্তু সমস্ত অধিকার থাকা সত্ত্বেও এই সমাজের মহিলাদের দুরবস্থার প্রথম ও প্রধান কারণ অবশ্যই অশিক্ষা।
সম্প্রতি ভিন্ন এক পরিবর্তনও বিশেষভাবে দৃশ্যমান। কন্যাসন্তানদের ভবিষ্যৎ সুনিশ্চিত করার লক্ষ্যেই আজ উচ্চশিক্ষা যে জরুরি তা অভিভাবকরা অনুধাবন করেছে। সেক্ষেত্রে অভিজাত ও উচ্চবিত্ত ছাড়া নিম্নবিত্ত এবং সামর্থ্যানুসারে গ্রামাঞ্চলের মুসলিম সমাজের মেয়েরা শিক্ষাগ্রহণে বিশেষভাবে আগ্রহী। এমনকী তারা বিয়ের পরে নানা ধরনের বাধা ও কষ্টের সম্মুখীনও হয়ে।
পোশাক-পরিচ্ছদ, চিন্তাভাবনায় আধুনিক হওয়ার পর আত্মমর্যাদা সম্পর্কে সচেতন হওয়ার প্রয়োজন। এই মহিলা সমাজের পিছিয়ে পড়া সমাজ বলে যে দুর্নাম লাগানো আছে তা ঘোচাতে হবে। সচেতন হয়েছে অনেকেই। এই শতাব্দীর প্রারম্ভে যে লড়াই শুরু হয়েছিল ইতিমধ্যে অনেকে সেই সংগ্রামে জয়ী হয়েছে।
শিরিণ আখতার ও সারমিন খানদের মতো তরুণীদের জীবনের একমাত্র লক্ষ্য নিজের স্বতন্ত্র পরিচয় এবং আর্থিকভাবে স্বনির্ভর তথা প্রতিষ্ঠিত হওয়া। অর্থনৈতিক ভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার পরই বিয়েতে রাজি হয়েছিল শিরিণ। বিয়ের পর শিরিণকে স্বামীর সঙ্গে বিদেশে পাড়ি দিতে হয়েছিল। কিন্তু সেখানেও যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে কাজ করেছেন। ওঁর বক্তব্য, আমেরিকায় মুসলিম মেয়েদের আরও বেশি স্বাধীন চিন্তায় ঋদ্ধ দেখেছি। বৈষম্যও কম। আমি একান্তভাবে কামনা করি আমাদের দেশের মুসলিম মেয়েরাও অদূর ভবিষ্যতে এমনই স্বাবলম্বী স্বাধীনচেতা হবে এবং বিশ্বের দরবারে প্রতিষ্ঠিত হবে। এই স্বপ্নপূরণে এগিয়ে চলেছে আজকের প্রজন্ম। ছেলেদের মতোই তারাও মসজিদে ইফতার করে এবং নামাজ পড়ে। কেবল পৃথক জায়গায় আসন থাকে। সম্প্রতি কলকাতার দুটি বিখ্যাত মসজিদে মেয়েদের নামাজ পড়ার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। এই উদারচিন্তাও মহিলা সমাজের অগ্রগতির পথে এক শুভ পদক্ষেপ। শিরিণ আশাবাদী, ভারতীয় মুসলিম মেয়েরাও হার মানবে না। সারমিন কম্পিউটার সায়েন্স নিয়ে গ্র্যাজুয়েশন করেছে, খুব ভালো ছাত্রী কিন্তু বিয়ের জন্য এই মুহূর্তে একেবারে প্রস্তুত নয়। কথা প্রসঙ্গে জানাল, বিয়ে নয়, একমাত্র স্বপ্ন একটা ভালো চাকরি। অর্থাৎ স্বনির্ভর হতেই হবে। এই স্বপ্নপূরণ করার জন্য ওর অভিভাবকরাও প্রস্তুত। ওঁদের সহযোগিতার জন্য সারমিন কৃতজ্ঞ।
শুধুমাত্র শিরিণ, সারমিন নয়, এই প্রজন্মের বহু মুসলিম মেয়েই স্বাবলম্বী হয়ে বিয়ে করছে। আজ আক্ষরিক অর্থে স্বাধীনচেতা ও আধুনিক হওয়ার সংস্কার গড়ে উঠেছে। শুরু হয়েছে অবরোধবাসিনীর যথার্থ অন্বেষণ, জীবনের অর্থ খুঁজে পেয়েছে। অগ্রগতির দ্বার আজ রুদ্ধ নয়। চলেছিল শম্বুকগতিতে কিন্তু সেখানেও গতি এসেছে, পরিবর্তনের ঢেউ লেগেছে একথা নিশ্চয়ই বলা যায়। মুসলিম মেয়েরাও উন্মুক্ত আকাশে বিচরণের স্বপ্ন দেখছে। আকাশদর্শনের সেই স্বপ্ন পূরণ হোক।
শাকিলা খাতুন