সঠিক বন্ধু নির্বাচন আবশ্যক। কর্মরতদের ক্ষেত্রে শুভ। বদলির কোনও সম্ভাবনা এই মুহূর্তে নেই। শেয়ার বা ... বিশদ
রাজা শর্যাতির অপরূপ সুন্দরী কন্যা সুকন্যা। নামের সঙ্গে মিল রেখে সত্যিই সুকন্যা সে। অত্যন্ত বুদ্ধিমতী এবং পরমাসুন্দরী। আদরের কন্যা বাবার সঙ্গে বেড়াতে এসেছে এক মনোরম স্থানে। সরোবর, বন, বনানী দেখে সুকন্যার মনে তো আনন্দ ধরে না। ঘুরে বেড়াচ্ছে সে এদিক সেদিক। নানা সুন্দর ফুল গাছের সমাহার দেখে তার প্রশ্নের শেষ নেই। সখীরা তার প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে ঘুরে বেড়াতে লাগল এদিক-সেদিক। এদিকে ওই বনেই ভৃগুর পুত্র মহর্ষি চ্যবন সরোবরের ধারে একই জায়গায় বসে বহুকাল ধরে তপস্যারত ছিলেন। ক্রমে তাঁর শরীর ধুলোয় ঢেকে তাঁর উপরে গাছপালার জন্ম হল, পিঁপড়ের বাসা হল তবু তাঁর তপস্যার শেষ নেই। ধীরে ধীরে এমন অবস্থা হল যে তাঁকে দেখলে মনে হতো যেন ছোটখাট একটা উইয়ের ঢিপি। তবে লোকজন অত্যন্ত ভক্তি করত এই বলে যে উইঢিপির ভেতর মহামুনি চ্যবন তপস্যা করছেন। এইভাবে সুদীর্ঘকাল অতিবাহিত হওয়ার পর একদিন সুকন্যার আগমন ঘটে সেই স্থানে। রাজকন্যা প্রফুল্ল মনে গাইছেন, হাত বাড়িয়ে ফুল তুলছেন, অকারণ হাসিতে গড়িয়ে পড়ছেন; বেড়াতে বেড়াতে অজান্তেই সেই উইয়ের ঢিপির সামনে এসে উপস্থিত হয়েছেন। এমন সময় সদ্য মুনির ধ্যান শেষ হয়েছে তিনি চোখ মেলে দেখেন এক অপরূপা রূপবতী কন্যা তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে। চ্যবন মুনির খুব ইচ্ছে হল যে তিনি ওই অসামান্যা রূপসীর সঙ্গে দুটো কথা বলবেন। যেমন ভাবা তেমন কাজ। তিনি ডাকলেন তবে অত্যন্ত ক্ষীণ কণ্ঠে। বহুকালের অনভ্যস্ততায় ও অনাহারে তাঁর গলা দিয়ে সামান্য আওয়াজ হল। কিন্তু বিধাতার এমনই পরিহাস যে সুকন্যা নিজ আনন্দে নিমগ্ন থাকায় সে ডাক শুনতে পায় না। বরং মাটির নীচে উইয়ের ঢিপির উপর জ্বলজ্বলে দুচোখ দেখে কৌতূহলবশে কাঁটা দিয়ে সেটা খুঁচিয়ে দেয়। এতে অত্যন্ত রেগে যান মুনি। তাঁর অভিশাপে শর্যাতি রাজার সৈন্যদের প্রাত্যহিক ক্রিয়াকর্ম বন্ধ হয়ে যায়। রাজা অত্যন্ত বিচলিত হন এবং খোঁজখবর নিয়ে জানতে পারেন যে তাঁর কন্যার জন্যই এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। তৎক্ষণাৎ শর্যাতি চ্যবন মুনির কাছে এসে নিঃশর্ত ক্ষমা চান এবং বলেন তার কন্যা বয়েসে ছোট, অজ্ঞানতা বশে অজান্তেই এই কাজ করে ফেলেছে। কিন্তু লাভ হয় না। মুনির ক্রোধ প্রশমিত হয় না এতটুকুও। তিনি বলেন অহঙ্কার বসে তাঁকে হীন জ্ঞান করেই রাজদুহিতা এই কাজ করেছে। অনেক কথোপকথনের পর মুনি জানান যে রাজা যদি তার কন্যাকে মুনিকে দান করেন তবেই তিনি ক্ষমা করবেন।
সুন্দরী রাজকন্যা বা নারী বা রানিকে দেখে মুনি ঋষিরা বিচলিত হতেন এমন উল্লেখ আমরা পুরাণে বহুবার পেয়েছি। অনেক সময় রাজারাজড়ারাও মুনি ঋষিদের শরণাপন্ন হতেন বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে এঁদের দিয়ে নিজ নিজ স্ত্রীদের গর্ভে সন্তান উৎপাদনের জন্য। এক্ষেত্রেও অবশেষে চ্যবন মুনির ইচ্ছেকে মান্যতা দিয়ে সুকন্যার মতামতের অপেক্ষা না করেই রাজা শর্যাতি নিজ কন্যাকে ওই জরাগ্রস্ত বয়স্ক মুনির কাছে কোনও দ্বিধা ছাড়াই সমর্পণ করেন। কী আশ্চর্যের তাই না? পূর্বাপর কোনও বিচার বিবেচনা নেই। কারও সঙ্গে শলাপরামর্শ নেই, কন্যার ইচ্ছে-অনিচ্ছের প্রশ্ন নেই, একতরফা সিদ্ধান্ত গ্রহণ। একজন নারীর মান, সম্মান, আত্মমর্যাদা সবই মূল্যহীন সেখানে। এই সমস্ত ক্ষেত্রে আমরা বারবার দেখেছি এইরকম কঠিন পরিস্থিতিতে নারী কিন্তু সবসময়ই আত্মবলিদান দিতে প্রস্তুত। কখনও স্বামীর জন্য, কখনও পিতার জন্য। পুরুষে পুরুষে যুদ্ধ, কার্যোদ্ধারে, মধ্যস্থতায় ফন্দিফিকিরে ঘুঁটি সেই নারী। এমন সহজলভ্যা সমাজে সংসারে আর কে আছে।
বিয়ে তো হয়ে গেল মুনির ইচ্ছানুযায়ী সুকন্যার। আঘাত সব নারীর জন্য। লোভনীয় নারীর সেবা পেয়ে চ্যবন যার পর নাই খুশি। নিশ্চুপ সুকন্যা সর্বশক্তিমান পুরুষের আধিপত্যে ঠিক ভুলের ক্ষুদ্রতা মুছে নিজের অন্তর্নিহিত শক্তিকে পাথেয় করে জীবনের পথে চলার সাহস দেখায়।
কিছুদিন পর একদিন সুকন্যা সরোবরের জলে আপন মনে অবগাহন করছেন। তার রূপের বিভায় উদ্ভাসিত চারপাশ। সেই সময়ই অশ্বিনীকুমারেরা তাঁকে দেখে ফেলেন। এবং তার রূপে মোহিত হয়ে যান। আশ্চর্য হয়ে জানতে চান এমন সুন্দরী রমণী কেন ওই জরাজর্জরিত অক্ষম বৃদ্ধের কাছে পড়ে রয়েছেন? ওই বৃদ্ধের সংস্রব ত্যাগ করে তাদের মধ্যে কোনও একজনকে বরণ করুন রাজকন্যা। উত্তরে দুঃখ সাগরে ডুবে থাকা অবিচলিত অলোকসামান্যা নারী দৃঢ় কণ্ঠে জানায় যে তিনি তাঁর স্বামীর প্রতি অনুরক্ত। পৃথিবীর সবকিছু ত্যাগ করে তিনি স্বামীকে আঁকড়েই বেঁচে আছেন। এবং এভাবেই বাঁচতে চান। কিছুটা আশাহত হলেও চেষ্টার কসুর নেই দেবচিকিৎসক যুগলের। তাঁরা আবার বলেন যে চাইলে তাঁদের সুচিকিৎসার দ্বারা মুনি তার রূপ যৌবন ফিরে পেতে পারেন। শর্ত একটাই তখন এই তিন জনের মধ্যে থেকে একজনকে সুকন্যাকে বরণ করতে হবে। আবার চুক্তি। আবার শর্ত। প্রাপ্য বুঝে নেওয়ার খেলা। নিষ্ঠুর স্বার্থপর মনোহরণ, বহুগামী পুরুষের বীরত্বের দম্ভ। কিন্তু নারী যুগযুগান্তের অবহেলা আর অপমানের পরেও নিঃশর্তে ভালোবাসতে পারে। চ্যবন জানতে পেরে এই প্রস্তাবে সম্মত হন। অশ্বিনীকুমারদ্বয় এবং চ্যবন এই তিনজনে জলে প্রবেশ করলে মুহূর্তকাল পরে তিন জনেরই দিব্য রূপ ও একই বেশ ধারণ করে জল থেকে উঠলেন। এবার সুকন্যার সমানরূপও বেশধারী তিন জনের মধ্যে একজনকে বরণ করে নেওয়ার পালা।
পুরুষের ইচ্ছের দাস কোণঠাসা নারী আবার কঠিন পরীক্ষার সামনে। সমস্ত দুঃখ, দহন আর্তি বিশ্বাস, ভালোবাসা, সম্পর্ককে দু’হাতে আঁকড়ে প্রস্তুত সুকন্যা। সুবেশা, সুপুরুষ তিনজনের মধ্যে অব্যর্থভাবে চ্যবনকেই বেছে নেন তিনি অবলীলায়।
বিষয়টা গল্প শুনতে যতটা সহজ মনে হয় ঠিক ততটা সহজ নয় একেবারেই। একজন নারী উপেক্ষায়, অপেক্ষায়, অবহেলায়, নিরূপায় বশ্যতা স্বীকার করে নেয় স্বপ্ন, আশা আর অধিকার বুঝে ওঠার আগেই। পুরাকাল থেকে কবির রচনায় উঠে এসেছে অনামা এমন বহু নারী চরিত্র। পুরাণের বিবর্ণ পাতায় পাতায় তাঁরা ঘুমিয়ে থাকে, না জাগার শপথ নিয়ে। বহু যুগের ওপার থেকে শূন্যতার অন্তঃপুরে বোবা কান্নায় গুমরে মরে সুকন্যারা আজও।
তনুশ্রী কাঞ্জিলাল মাশ্চরক