উপস্থিত বুদ্ধি ও সময়োচিত সিদ্ধান্তে শত্রুদমন ও কর্মে সাফল্য। ব্যবসায় গোলযোগ। প্রিয়জনের শরীর-স্বাস্থ্যে অবনতি। উচ্চশিক্ষায় ... বিশদ
বর্তমানে মেয়েরা এগিয়ে গিয়েছি অনেকটাই। ছেলেদের সঙ্গে সমান তালে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলেছি এ বিষযে সন্দেহ নেই। একই পেশায় সমানতালে কাজ করছেন নারী ও পুরুষ। তৈরি হচ্ছে বন্ধুত্বের সম্পর্ক। আবার বন্ধুত্বের বিনি সুতোর মালাতেই গাঁথা হয়ে যাচ্ছে দুটি জীবন। তাঁরা বাঁধা পড়ছেন নতুন বন্ধনে। পেশাগত বন্ধুত্ব থেকেই তৈরি হচ্ছে পারিবারিক বন্ধন। এক পেশাতে কাজ করছেন স্বামী-স্ত্রী। বিয়ের পরেও একজোট হয়ে তাঁরা এগিয়ে চলেছেন কয়েক কদম।
এই যেমন তরী আর ঋষভের কথাই ধরি। দুজনেই কাজ করেন একটি চার্টার্ড ফার্মে। অ্যাকাউন্টেন্সি পড়ার সময় আলাপ গড়ায় বন্ধুত্বে। আর বন্ধুত্ব থেকে ভালোবাসা, প্রেম, বিয়ে। সময় যত গড়িয়েছে ততই গাঢ় হয়েছে দুজনের সম্পর্ক। চাকরি, কেরিযার পাকা হতেই আর দেরি করেনি ওরা। চার হাত এক করে নিয়েছে। তরীর বাবার নিজের চার্টার্ড ফার্মেই কাজ শুরু দুজনের। কিন্তু গোল বাধল বিয়ের পর। ঋষভ কিছুতেই সেখানে যুক্ত থাকতে চাইল না। ঋষভের ইচ্ছে বিদেশি কোম্পানিতে হাই প্রোফাইল জব। তরীও বাইরে যাক তার সঙ্গে। বিদেশে সেটল করার ইচ্ছে তরীর থাকলেও বৃদ্ধ বাবা-মাকে ছাড়তেও পারছিল না। কেরিয়ার নিযে দ্বন্দ্ব আর সম্পর্কের টানাপোড়েনে জেরবার দুজন। অথচ একমাত্র মেয়ে আর জামাইয়ের ভবিষ্যতের কথা ভেবেই তরীর বাবা চার্টার্ড ফার্মটি নতুন করে সাজান।
সাইকিয়াট্রিস্ট ডঃ রীমা মুখোপাধ্যায় বললেন, এক পেশায় থাকা দম্পতির সমস্যা এড়িযে যাওয়া যায় সহজেই। সম্পর্কের জটিলতার আরও কিছু প্রশ্ন রেখেছিলাম তাঁর কাছে। সমাধান দিলেন সহজ কথায়।
এক পেশায় স্বামী স্ত্রী থাকলে তাদের সম্পর্ক কেমন হয়?
অনেক দিক থেকেই সুবিধা আছে। এক পেশায থাকলে দুজনেই পেশাগত সমস্যার দিকটা বুঝতে পারেন। যেটা অন্য পেশার মানুষ চট করে বুঝতে পারেন না। দুজনের মধ্যে একটা আলাদা বোঝাপড়া কাজ করে। কাজের জগতে নাইট শিফট থাকলে দুজনেই এক ফিল্ডের হলে বুঝতে পারেন সেটা কতটা জরুরি। স্বামীও যেমন স্ত্রী কেন করছেন বুঝতে পারেন, তেমন স্ত্রীও তখন স্বামীর পেশাগত প্রেশারটা বুঝে শপিং বা বেড়াতে নিয়ে যাওযার আবদার করে বসেন না, ফলে আমরা বলতে পারি এতে ভুল বোঝাবুঝির সম্ভবনা অনেকটাই কম। একটা উদাহরণ দিই। অভিনয় জগতে স্বামী স্ত্রী উভয়েই থাকলে বহু অভিনেতা-অভিনেত্রীর সঙ্গে কাজ করার যে পরিস্থিতি সেটা সহজে বুঝে নিতে পারবেন। প্রথম থেকেই এই আন্ডারস্ট্যান্ডিংটা থাকে। তবেই তো সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
এক পেশায় থাকলে বয়সজনিত কারণে সমস্যা তৈরি হতে পারে কি?
হতে পারে। এর সামাজিক দিক রয়েছে। যদিও আমাদের সমাজের হিসেবে ছেলেরা সাধারণত চাকরি পেয়ে তবেই বিয়ে করে। তবে বয়সের ফারাক থেকে সমস্যা হতেই পারে।
রেষারেষি হওযার সম্ভবনা কতটা? কেন এই রেষারেষি হয?
এক পেশায় থাকলে এই রেষারেষিটা অনেক সময়েই দেখা যায়। কারণ সামাজিক তুলনার সামনে পড়ে দুজনের মধ্যের বোঝাপড়াটা নষ্ট হয়ে যায়। একই নেটওয়ার্কের মধ্যে পড়ে একজন সম্মান পায় এবং অন্যজন পায় না, এই ঘটনা তো সারাক্ষণই ঘটে। সেক্ষেত্রে স্বামী-স্ত্রী হলে সমস্যা গম্ভীর হয়ে যায়। বলিউডি সিনেমা অভিমান থেকে শুরু করে হালফিলের আশিকি সর্বত্রই আমরা দেখেছি পেশাগত দ্বন্দ্ব কীভাবে একটা সম্পর্ক নষ্ট করে দেয়।
একই কাজ যদি দুজনে করে তাহলে শেয়ারিংয়ের মনোভাব কতটা থাকে?
এক পেশায় দুজনে থাকলে অবশ্যই একটা শেয়ারিংয়ের মনোভাব থাকে। সেটাই স্বাভাবিক। আর এটাই বিরাট অ্যাডভানটেজ। বন্ধুত্বের দিকটা প্রকাশ পায় বইকি এর মাধ্যমে। তেমনি সব পেশাতেই অনেক সমস্যা থাকে। পেশাগত সমস্যাগুলো কীভাবে ডিল করা যায়, এমনকী সমস্যাটা বলতে পারা, প্রকাশ করতে পারার একটা জায়গাও থাকে। সম্পর্ক যতটা ম্যাচিওরড হয় ততটাই সঙ্গীরা খোলামেলা হয়ে ওঠে।
শেয়ারিং থেকে কি অন্যরকম একটা বন্ধুত্ব জন্মাতে পারে যেটা স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ককে অন্যরকম করে তুলতে সক্ষম হয়?
সব সম্পর্কেই কিছু না কিছু সমস্যা থাকে। তার সুবিধার দিকগুলোই তো দেখতে হবে। অসুবিধার দিকগুলো মেনে নিয়ে বা সামলে নিয়ে সুবিধার দিকটা ফোকাস করতে হবে। তবেই তো সম্পর্ক এগিয়ে যাবে। আমরা জানি প্রত্যেক পেশাতেই একটা ফ্রাস্ট্রেশন থাকে। দিনের শেষে বাড়িতে সেটা বলতে পারার অন্তত একজন আছে যার কাছ থেকে আপনি একটা পথ পাবেন। কিছু না হোক অন্তত তিনি বুঝবেন আপনার সমস্যাটা। সঙ্গীর কাছে এই বলতে পারাটাই অনেক সময় খুব দরকারি হযে ওঠে।
অনেক সময় এমন হয় যে খোলাখুলি কোনও ঝগড়া হল না, কিন্তু হিংসে বা রেষারেষির জন্য বিবাহিত সম্পর্ক ক্রমশ নষ্ট হয়ে গেল। এক পেশায় থাকলে এটা কি হয়?
সামাজিক পরিবেশ এক্ষেত্রে অনেকটাই বড় ভূমিকা নেয়। সমস্যাটা বাড়িয়ে দেয় বা তৈরি করে। মেয়েরা এখনও সমাজে সেকেন্ড ক্লাস সিটিজেন। পুরুষশাসিত সমাজে একটি মেয়ে কাজ করছেন, টাকা রোজগার করছেন, দিনের শেষে সেটাই বড় কথা। কিন্তু তার খুব নাম ডাক হল এটা এখনও অনেকেই নিতে পারেন না। কিছু লোক আছেন যারা এইসব নিয়ে অন্যের সংসারে নাক গলায়। সমস্যা তৈরি করতে চেষ্টা করে। আবার অনেকক্ষেত্রে ছেলের বাড়ির লোকেরা বাড়ির বউয়ের পেশার তাগিদে ডেডিকেশনের মূল্য কম দেন। বউটি বেশি নামডাক করে ফেললেই গেল গেল রব ওঠে। বিবাহিত মেয়েরা অবশ্যই কাজ করছেন। কিন্তু ছেলেকে ছাপিয়ে গেলেই সমস্যা। এইসব বাড়ির লোকের আচরণ থেকেও স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক বিষিয়ে যেতে পারে। বরং দেখেছি চাকরিরত দম্পতিরা যাঁরা বাইরে থাকেন, তাঁরা এই পরিস্থিতিতে দুজনেই বেশ মানিয়ে নেন।
রেষারেষি থেকে যদি সম্পর্কে দ্বন্দ্ব আসে তাহলে তা সামলানোর উপায় কি?
পেশাগত ও ব্যক্তিগত জীবনের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা সুস্থ সম্পর্কের জন্য খুব জরুরি। দূরত্ব তৈরি হলে তখন দুজনেই যদি নিজের ইগো নিয়ে থাকেন তাহলে তো সমস্যা বাড়বেই। তবে এটা বললে পুরুষ পাঠকরা ভুল বুঝবেন তবুও বলছি মেয়েদের ইগো তুলনায় অনেক কম। তাই তারা স্বামীর সাফল্যে, এগিয়ে থাকায় গর্বিত হয়। অবশ্য অনেক স্বামীও স্ত্রী-র সাফল্যে গর্ববোধ করেন। আসলে সত্যি ভালো বন্ডিং আন্ডারস্ট্যান্ডিং থাকলে এই সাফল্য বা পিছিয়ে পড়া কোনওটাই বড় ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায় না। তবে একজনের অফিস পার্টিতে অন্যজন যেতে অপছন্দ করলে সেটা মেনে নেওয়া উচিত। একে অন্যের ভালো খারাপ পছন্দ অপছন্দটা বুঝতে হবে। স্ত্রী যদি বোঝেন কোনটা তাঁর স্বামীর অপছন্দ সেটা তিনি নাই বা করলেন। অপরদিকটাও সত্যি। আমার মনে হয় কোনও মহিলাই তাঁর বিবাহিত জীবনটা চট করে নষ্ট করতে চান না। আজকের যুগে দাঁড়িয়েও বলছি, কেরিয়ার সামলেও মেয়েদের কাছে পরিবার যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ । তাই দুজনকেই বুঝে চলতে হবে। কিছু বিষয় এড়িয়ে যেতে হবে, কিছু সামলে নিতে হবে। তাহলে এক পেশা বা অন্য পেশা কোনওটাই সমস্যা তৈরি করবে না। স্বামীকেও ইগো ঝেড়ে স্ত্রীয়ের মন বুঝতে হবে। অ্যাটিটিউডটা ঠিক রেখে যদি চলা যায়, সেটাই কাম্য। স্বামী যদি বলেন কাজটাই ছেড়ে দাও, সেটা অযৌক্তিক কথা। কারণ আজকের যুগে উভয়ের কাজ করাটাই প্রয়োজনীয়।
রেষারেষি হলে, পেশা বদল না করেও ভালো থাকার উপায় কি?
কোন পরিস্থিতিতে কি হচ্ছে সেটা খোলা মনে আলোচনা করে নেওয়াই ভালো। তিক্ততা না বাড়িযে মিটিয়ে নিন। সব জায়গায় দুজনে গেলে যদি সমস্যা হয় তাহলে ক্ষেত্র বিশেষে একজনের যাওয়াই ভালো। মনে রাখুন দুজনেরই আইডেন্টিটি আছে। কিছু লোককে অ্যাভয়েড করতে হবে যারা সমস্যা তৈরি করছে। একে অপরের কাছে নিজেদের গুরুত্বটা বুঝুন। সম্পর্কের দাম দিন। কিছু জিনিস পেতে গেলে কিছু ছাড়তেই হবে। সব একসঙ্গে পাওয়া যায় না। তাই দেখতে হবে কোনটা করলে সম্পর্কটা ভালো থাকবে। অ্যাডজাস্টমেন্ট আর কম্প্রোমাইজ উভয়কেই করতে হবে। জীবনে চলতে গেলে এই দুটোই সমানভাবে দরকার। পেশাদারিত্বকে গুরুত্ব দিয়েও সম্পর্কের দাম দিতে জানতে হয়।
সব শেষে বলি, এক অফিসে স্বামী স্ত্রী, প্রেমিক প্রেমিকা কাজ করলে যেমন পজিটিভ দিক আছে, তেমন কিছু সমস্যাও তৈরি হতে পারে। তাই মেনে চলা উচিত অফিস ডেকোরাম। ব্যক্তিগত সম্পর্ক যাই হোক, অফিসে দুজন সহকর্মী। ফলে উভয়কেই পেশাদার আচরণ করতে হবে। একান্তে সময় কাটাতে ইচ্ছে হলেও দৃষ্টিকটু কাজ করা উচিত নয় অফিস চত্বরে। অন্য সহকর্মীদের মতোই মিশুন, বন্ডিং ঠিক থাকলে সম্পর্ক ভালো থাকবেই। স্বাভাবিক আচরণেই নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখুন।
সাক্ষাৎকার শেরী ঘোষ