বিতর্ক বিবাদ এড়িয়ে চলা প্রয়োজন। প্রেম পরিণয়ে মানসিক স্থিরতা নষ্ট। নানা উপায়ে অর্থ উপার্জনের সুযোগ। ... বিশদ
একটা সময় পর্যন্ত সমাজজীবনে কন্যা মানেই পাড়া-পড়শী সহ পরিবার পরিজনদের মুখ ভার। আনন্দ, হাসি, মজা উধাও। কোনও কোনও পরিবারে তো রীতিমতো শোকের ছায়া। অথচ পুত্র সন্তান জন্ম নিলে সেখানে হইহই, বাজনা, বাজি সহ আরও কত কী! যদিও তর্কের খাতিরে এটা সেকালের বা সেযুগের কথা হিসেবে ধরি তাহলেও আজকের উত্তর আধুনিক সময়ে দাঁড়িয়ে এই চিত্রটার যে খুব বেশি পরিবর্তন হয়েছে তেমনটাও নয়। ব্যতিক্রমকে বাদ দিলে আজও কন্যা সন্তান জন্মগ্রহণ করলে অত্যাধুনিক মায়ের বুক কাঁপে অজানা আশঙ্কায়। না না, দায় ভেবে তা কখনই নয়। অর্থাত্ কন্যা মানেই দায় আর পুত্র মানেই সম্পদ। এই ভাবনা আজকের দিনে যথেষ্টই ফিকে। বরং কোনও কোনও পরিসরে মেয়েরা তাদের নিজ যোগ্যতায় ছেলেদের থেকেও অনেক বেশি প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেই এগিয়েছে। তাহলে এই গতির যুগে, তথ্যপ্রযুক্তির যুগান্তকারী উদ্ভাবনের সময়ে দাঁড়িয়ে কন্যা সন্তান ভূমিষ্ঠ হলে কিসের ভয়? ভয়টা এই জায়গায় যে, সমাজ আমাদের এমন পরিবেশ পরিস্থিতির সামনে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে যে কন্যা সন্তান হলে একটা ভয়ানক দুশ্চিন্তা নিয়েই মায়ের দিনাতিপাত চলে।
কেন না, ভয়ঙ্কর সামাজিক অবক্ষয়ের কারণে একেবারে শৈশবেই শিশু কন্যারা যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। সংবাদপত্র কিংবা বৈদ্যুতিন সংবাদ মাধ্যমের দৌলতে গোটা ঘটনার বিভত্সতায় শিউরে উঠছি আমরা। তাই কন্যা সন্তান দায় না হলেও গভীর চিন্তার বিষয় হয়ে উঠছে দিন কে দিন।
সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার কিছুদিন পর থেকেই মায়ের মাথায় সর্বক্ষণ একটাই দুশ্চিন্তা যে মেয়ে সুরক্ষিত কিনা! গোটা সমাজকে শিশুকন্যাটির মা একটা বাঁকা দৃষ্টিতে দেখছে। সন্তানের একেবারে শিশুকাল থেকেই স্কুলের শিক্ষক, স্কুলবাস বা পুলকারের চালক অথবা পাড়া-প্রতিবেশি সহ নিকট আত্মীয় কেউই মায়ের চোখে সন্দেহের ঊর্ধ্বে থাকছে না।
এখন মায়েরা শিশুবয়েস থেকেই মেয়েকে গুড টাচ, ব্যাড টাচ শেখান। কার থেকে কীভাবে, কতটা দূরত্ব রাখবে এগুলো মায়েরাই শেখান তাদের ফুটফুটে শিশুকন্যাটিকে। ফলে মায়েদের ভূমিকাও ক্রমশ বদলাচ্ছে। কারণ, এই বিষয়টা নিয়ে তাদেরও সন্দেহ, সংশয়, দ্বিধা, দ্বন্দ্ব কাজ করছে মনে।
একই সঙ্গে সন্তানকে বোঝাতে হয় কঠিন কঠোর বাস্তবের সঙ্গে মোকাবিলার কলাকৌশল। আবার পাশাপাশি মেয়ের নরম, কোমল সুকুমার মনও যেন ক্ষতবিক্ষত না হয়ে যায়, সমাজ সংসারের প্রতি তার যেন রাগ, ক্ষোভ, বিদ্বেষ না জন্মায় সেটাও মাকে খেয়াল রাখতে হয়। বালিকা বয়সে পৌঁছনোর আগেই ছোট্ট শিশুকে শিখতে হচ্ছে কোনটা ‘গুড টাচ’ আর কোনটা ‘ব্যাড টাচ’। পার্থক্যটা বুঝিয়ে দিচ্ছেন মা। কারণ তিনি নিরুপায়। নানা অনভিপ্রেত ঘটনা যখন ঘটছে তখন মানসিক প্রস্তুতি নিয়েই বড় হতে হচ্ছে একটি শিশুকন্যাকে। আসলে সমাজ বড় দ্রুত পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে। সমাজের কিছু মানুষের বিকৃত রুচি প্রতিদিন রক্তাক্ত করে চলেছে মায়েদের মনকে। স্বভাবতই বালিকা বয়েসে পৌঁছনোর আগেই একেবারে শৈশবেই এসব শিখিয়ে দিতে বাধ্য হচ্ছেন মা।
সবচেয়ে বড় কথা, বাড়ির বাইরের লোকজন সম্পর্কে সাবধান করা সহজ হলেও নিজের আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব সম্পর্কেও সতর্ক থাকার শিক্ষা দিতে বাধ্য হচ্ছেন মা। মায়েরা তো নিরুপায়! যে বয়েসে এতকিছু বোঝারই কথা নয় শিশুকন্যাটির সে বয়েস থেকেই এমনভাবে পা ছড়িয়ে বসতে নেই, ছেলেদের গলা জড়িয়ে খেলা করতে নেই, পাশের বাড়ির কাকু, পিছন পাড়ার মামার কোলে উঠতে নেই, আদর খেতে নেই... এমন আরও হাজারো ‘নেই’-এর ম্যারাথন মিছিল। একটি মেয়ের স্বতঃস্ফূর্ত, প্রাণবন্ত বেড়ে ওঠার প্রতি পদে তাকে বাধা দিতে শুরু করেন মা। শৈশব থেকেই মেয়েরা আর নিরাপদ নয়। মায়েদের দায়িত্বটা অস্বাভাবিক বেড়ে যাচ্ছে। তাই এই নারী ক্ষমতায়ণ ও লিঙ্গ বৈষম্য দূরীকরণের জোরাল সময়েও পুত্রের থেকে কন্যা অনেক বেশি প্রার্থিত হলেও কন্যার ক্ষেত্রে মায়ের দায়িত্বটা যে বেড়ে যায় এ কথা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
একজন বাবার কাছে মেয়েটি সারাজীবনই তাঁর আদরের ছোট্ট রাজকন্যা থেকে যায়। বাবাদের কাছে মেয়েরা তাঁদের আদরের ‘খুকি’ বা ‘বুড়িমা’ই হয়ে থাকে। আর মেয়েদের কাছে মেয়ের জন্য সবসময় বাড়তি মনোযোগ, মেয়ে সুরক্ষিত কিনা? নিশ্চিন্ত হওয়ার কোনও অবকাশ নেই।
ফ্রক পরা বয়েসে যদিও বা মেয়েটি কোনও প্রশ্ন না করে, যখন সে বয়ঃসন্ধিকালে পৌঁছয়, যখন সবকিছুর বিরুদ্ধাচারণ করতে ইচ্ছে করে তখনই সে মায়ের কাছে প্রশ্ন ছোঁড়ে, কেন আমার সমবয়সী আর পাঁচজন ছেলে বন্ধু রাত করে আড্ডা মেরে বাড়ি ফিরতে পারে, কোচিংয়ের পড়ার শেষ আমাকে নিয়ে আসার জন্য বাড়ির অভিভাবকদের উপস্থিত থাকার কী দরকার? বন্ধুদের সঙ্গে সিনেমা দেখতে গেলে কেন আমি বেশি রাত করতে পারব না? কেন আমি ছোট জামা পরলে সবার আপত্তি? কেন জিনস টপ বা হট প্যান্ট পরব না? এমন নানান ‘কেন’ তখন ভিড় করে মেয়েটির মনে।
একজন মায়ের কাছে তো এর কোন সদুত্তর নেই। তবু মেয়ে বাইরে বেরলেই আশঙ্কায় মার মন তোলপাড় করতে শুরু করে। এক্ষেত্রে কতকটা অসহায় মা। মেয়েকে বহির্জগতে না ছেড়েও উপায় নেই, আবার ছেড়েও শান্তি নেই। আমাদের সমাজ কি কন্যা সন্তানের মায়েদের এই দুশ্চিন্তা থেকে মুক্ত করতে পারে?
তনুশ্রী কাঞ্জিলাল মাশ্চরক