মাতৃকুল থেকে সম্পত্তি প্রাপ্তির যোগ। ডাক্তার, আইনজীবী, প্রমুখের পেশার প্রসার, সুনাম ও উপার্জন বৃদ্ধির সম্ভাবনা। ... বিশদ
বিজেপি তথা সঙ্ঘ পরিবারের হিন্দুত্ব প্রজেক্ট ভোটে জেতার ক্ষেত্রে আচমকা বড়সড় চ্যালেঞ্জের মুখে। কোনও রাজ্যেই দেখা যাচ্ছে না যে, বিজেপি এই আর্থিক খয়রাতির সামনে নিজেকে শক্ত করে ধরে রেখে হিন্দুত্বকেই একমাত্র প্রচার এবং ভোটের ইস্যুতে কায়েম থাকতে সমর্থ হয়েছে কিংবা হচ্ছে। পারছে না বিজেপি। বরং আত্মসমর্পণ করছে এই ফ্রি অনুদান দেওয়ার নীতির কাছে। হওয়ার কথা ছিল বিরোধীরা যদি আর্থিক অনুদানের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভোটের ময়দানে নামে, তাহলে বিজেপি ততোধিক উচ্চগ্রামে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে হিন্দুত্বকে আঁকড়ে ধরেই ধর্মের ভিত্তিতে ভোটের রাজনীতি করবে। কিন্তু কই! সেটা তো হচ্ছে না! মহারাষ্ট্রে বিজেপি সরকারকে ভোটের কয়েক মাস আগে ১৫০০ টাকার আর্থিক অনুদান চালু করতে হয়েছে। ঝাড়খণ্ড গরিব রাজ্য। সেখানে বিজেপি এক্সপেরিমেন্ট করেছে। হিন্দুত্বকেই চড়া সুরে প্রচারে ব্যবহার করেছে। কিন্তু হেমন্ত সোরেন তাঁর আর্থিক অনুদানের প্রকল্পকেই জোর দিয়েছেন। এবং বিজেপি পরাস্ত হয়েছে ঝাড়খণ্ডে। অর্থাৎ হেমন্ত সোরেনের মাঈয়া সম্মান যোজনার কাছে হেরে গিয়েছে বিজেপির হিন্দুত্ব। আর তারপরই দেখা যাচ্ছে বিজেপি হিন্দুত্বকে ব্যাকসিটে পাঠিয়ে দিয়েছে। অতএব ঝাড়খণ্ডের তুলনায় অনেক ধনী রাজ্য দেশের রাজধানী দিল্লির আসন্ন ভোটেও আম আদমি পার্টির দেখানো পথেই হাঁটতে বাধ্য হচ্ছে বিজেপি এবং কংগ্রেস উভয়পক্ষই। কেজরিওয়াল বলেছেন মহিলা সম্মান যোজনায় তিনি ক্ষমতায় এসে ২১০০ টাকা করে দেবেন মহিলাদের। কংগ্রেস ও বিজেপি নিলাম ডাকার মতো করে বলেছে, আমরা সরকারে এসে ২৫০০ টাকা করে দেব। এরকম ফ্রি পরিষেবা এবং সরাসরি আর্থিক অনুদান দেওয়ার ঘোর বিরোধী ছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। কিন্তু তাঁর বিরোধিতা ভেসে গিয়ে এখন বিজেপিও এই স্রোতে গা ভাসাতে বাধ্য হয়েছে। অর্থাৎ প্রমাণ হয়ে যাচ্ছে বিজেপির একান্ত নিজস্ব হিন্দুত্ব এজেন্ডাও পিছনের সারিতে চলে যাচ্ছে এই নতুন পপুলিজমের রাজনীতিতে।
প্রবল লড়াই শুরু হয়েছে। সকলের চোখের সামনে। অথচ আসলে যেন আড়ালে। একদিকে মনে হচ্ছে ভারত নামক দেশে হিন্দুরাষ্ট্র নামক একটি প্রজেক্ট চলছে। উত্তরাখণ্ডের ন্যায়াসু নামক একটি গ্রাম থেকে শুরু হয়েছিল একটি ঘোষণা। ক্রমেই সেই ঘোষণা ছড়িয়েছে অন্য গ্রামে। গ্রামের প্রবেশদ্বারে একটি বোর্ড লাগিয়ে বলা হয়েছে হিন্দু ছাড়া এই গ্রামে কেউ যেন না প্রবেশ করে। এই একই বোর্ড একে একে রুদ্রপ্রয়াগ জেলার অন্য গ্রামেও লাগানো হয়েছে। গুজরাতের বিভিন্ন জেলায় বহু গ্রামের প্রবেশপথে লেখা রয়েছে হিন্দুরাষ্ট্রে আপনাকে স্বাগত জানাই। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে একের পর এক মসজিদের নীচে মন্দির আছে বলে রাজ্যে রাজ্যে চলছে প্রবল উত্তেজনা। হিন্দুত্বের আগ্রাসী প্রচার। রাজনীতির সাম্প্রতিক চলন প্রত্যক্ষ করে ধরেই নেওয়া হয়েছে যে, বিজেপি এবং সঙ্ঘ পরিবার বাকি রাজনৈতিক দলগুলিকে হারিয়ে দিয়েছে নীতি ও আদর্শে। কারণ, বামপন্থা পিছিয়ে পড়েছে আগেই। জওহরলাল নেহরুর সমাজতন্ত্র ঘেঁষা অর্থনীতি কিংবা রাজনীতিও ক্রমেই হয়ে গিয়েছিল অতীত। নয়ের দশকে এসেছিল আইডেন্টিটি পলিটিক্স। অর্থাৎ জাতপাতের আইডেন্টিটি রাজনীতির হাত ধরে একে একে আবির্ভূত হয়েছিল নানাবিধ নতুন আঞ্চলিক দল। বিশেষ করে বিহার এবং উত্তরপ্রদেশে। অর্থাৎ হিন্দি হার্টল্যান্ডে। গোটা নয়ের দশক ধরেই চলেছিল যুযুধান দুই ধারা। একদিকে জাতপাতের আঞ্চলিক পলিটিক্স শক্তিশালী হয়েছে। আবার অন্যদিকে ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বরের পর আগ্রাসীভাবে অগ্রসর হয়েছে ধর্মের রাজনীতি। সোজা কথায় হিন্দুত্ব পলিটিক্স। সুফলও পেয়েছে সেই রাজনীতি। বহু বছর ধরে চেষ্টা করার পর অবশেষে ১৯৯৯ সালে ক্ষমতাসীন হয় বিজেপি জোটের সরকার। টিকে যায় পাঁচ বছর। এই গোটা পর্বে সবথেকে ক্ষতি হয়েছে কংগ্রেসের। তাদের ভোটব্যাঙ্ক চারদিক থেকে লুট হয়ে গিয়েছে। দলিত ভোট ছিনতাই করেছেন কাঁসিরাম, মায়াবতী। যাদব ভোট ছিনিয়ে নিয়েছেন মুলায়ম সিং যাদব, লালু প্রসাদ যাদবরা। উচ্চবর্ণের হিন্দু ভোট বিজেপির কাছে। মুসলিম ভোটেও যাদব কুলপতিরা ভাগ বসিয়েছে। কংগ্রেসের কাছে কোনও নির্দিষ্ট ভোটব্যাঙ্ক আর অবশিষ্ট ছিল না।
এভাবেই আগমন নরেন্দ্র মোদির। ২০১৪ সালের পর থেকে বিজেপির জনপ্রিয়তা এবং হিন্দুত্ব রাজনীতির আকাশছোঁয়া অগ্রগমন ঘটেছে। যখন মনে করা হচ্ছিল মোদি অপ্রতিরোধ্য। ঠিক তখনই ২০২৪ সালের লোকসভা ভোটে মোদি ধাক্কা খেলেন। যে বছর রামমন্দির উদ্বোধন হল, ঠিক কয়েকমাসের মধ্যেই বিজেপির জয়যাত্রা থমকে গেল। হয়তো সেটাই ছিল পূর্বাভাস। অর্থাৎ বিজেপির শীর্ষস্তর ছোঁয়া হয়ে গিয়েছে।
প্রতি ২৫ বছর অন্তর পাল্টে যাচ্ছে ভারত। ১৯৫০ সালে ভারত নিজস্ব সংবিধান গ্রহণ করেছিল। অগ্রসর হয়েছিল এক নতুন ভারত নির্মাণের পথে। যার চালিকাশক্তি এবং প্রধান শক্তি ছিল গণতন্ত্র। কিন্তু ঠিক ২৫ বছর পর সেই ভারতে সবথেকে বড় আঘাত এসেছিল গণতন্ত্রেই। সংবিধান সংশোধন করে জরুরি অবস্থা জারি করা হয় ১৯৭৫ সালে। তার আবার ২৫ বছরের মাথায় ১৯৯৮-৯৯ সালে হিন্দুত্ব রাজনীতি প্রথম সিংহাসন দখল করে বুঝিয়ে দিল যে, এবার কংগ্রেসের আকার আয়তন কমবে। বাড়বে বিজেপি। তাই হল। কিন্তু আবার ম্যাজিক ভারতীয় গণতন্ত্রের। কারণ আবার ২৫ বছর পর ২০২৫ সালে এসে দেখা যাচ্ছে হিন্দুত্ব রাজনীতির প্রোপাগান্ডা পলিটিক্স আচমকা ধাক্কা খেয়েছে। কিন্তু কোনও বিকল্প রাজনীতির কাছে নয়। পপুলিস্ট পলিটিক্সের কাছে। অর্থাৎ এখন আর কোনও দলকে নির্দিষ্ট কোনও ইজমের হওয়ার দরকার নেই। কোনও দলের পৃথক কোনও অস্তিত্ব আর দেখা যাচ্ছে না। সকলেই ভোটে জেতার জন্য একটিই অস্ত্র হাতে নিচ্ছে। বেশি বেশি আর্থিক অনুদান ও নানারকম ফ্রি পরিষেবা। এসবের মধ্যে বিজেপি হিন্দুত্বকেও মিশিয়ে দিচ্ছে বটে, কিন্তু তারা নিজেরাই বুঝতে পারছে হিন্দুত্ব যথেষ্ট নয় আর। যথেষ্ট হলে তো অন্যদের নকল করে এইসব ফ্রি সার্ভিস কিংবা টাকা দেওয়ার প্রকল্প বিজেপিকেও নিতে হতো না! সোশ্যালিজম, কমিউনিজম, কাস্ট পলিটিক্স এবং ধর্মীয় মেরুকরণ ক্রমেই পিছনের সারিতে। ভারতের নতুন রাজনীতির নাম ডিবিটি। ডাইরেক্ট ব্যাঙ্ক ট্রান্সফার!