সন্তানের স্বাস্থ্যহানির জন্য মানসিক অস্থিরতা ও উদ্বেগ। ক্রমোন্নতি ও প্রশাসনিক ক্ষমতা ও দায়িত্ব বৃদ্ধি। বিদ্যায় ... বিশদ
এইরূপ তিন বার সেই অন্ধকারসমুদ্র আলোড়িত হইল। তখন উত্তর হইল, ‘তোমার পণ কি?’
প্রত্যুত্তরে বলিল, ‘জীবন তুচ্ছ, সকলেই ত্যাগ করিতে পারে।’
‘আর কি আছে? আর কি দিব?’
তখন উত্তর হইল, ‘ভক্তি।’
—আনন্দমঠ
দুর্বলের অস্ত্র ভিক্ষা। সে শুধু চায়। আর সবলের হাতিয়ার ভক্তি। ত্যাগ। দুর্বলের চাহিদা নিজের জন্য। আর সবলের... জাতির জন্য। সমাজের জন্য। মানুষের জন্য। তাই সনাতনী ধর্মের ধ্বজা তুলে নরেন্দ্রনাথ দত্ত নামে এক পরিব্রাজক যখন পথে নামেন, তিনি তামাম বিশ্বকে নিজের করে নিতে পারেন। আহ্বান করেন তাদের ভ্রাতা ও ভগিনী বলে। তাঁর কণ্ঠে শোনা যায়, ‘প্রভু! আমি তোমার নিকট ধন, সন্তান বা বিদ্যা চাই না। যদি তোমার ইচ্ছা হয়, আমি শত বিপদের মধ্য দিয়া যাইব; কিন্তু আমার শুধু এই ইচ্ছা পূরণ করিও, কোন পুরস্কারের আশায় নয়, নিঃস্বার্থভাবে শুধু ভালবাসার জন্যই যেন তোমাকে ভালবাসতে পারি।’ এই তো ভক্তি। পরমাত্মার কাছে নিজেকে সমর্পণ করা। কর্মে বিশ্বাস করা। আর সেই কর্ম দেশের জন্য। জাতির জন্য। তাই যদি বলা হয়, স্বামী বিবেকানন্দের মতো স্বাধীনতা সংগ্রামী ভূভারতে খুব বেশি জন্ম নেননি, এতটুকু ভুল হবে না। ধর্ম, কর্ম এবং জাতীয়তাবাদ—এই তিন সূত্রকে এক মালায় গেঁথেছিলেন তিনি। আজ যখন আরএসএস জাতীয়তাবাদের কথা বলে, মনে পড়ে যায় অতীতটা। প্রশ্ন ওঠে, যে জাতীয়তাবাদে স্বামীজি বিশ্বাস করতেন, তার সঙ্গে আরএসএসের সংজ্ঞা মেলে না কেন? যে স্বদেশি আন্দোলনের আগুন বাংলা, পাঞ্জাব, মহারাষ্ট্রে জ্বলে উঠেছিল... ছারখার করে দিয়েছিল ব্রিটিশ শাসকের অহং, তার ধারেকাছে কেন সঙ্ঘকে দেখা যায়নি? জালিয়ানওয়ালাবাগ গণহত্যার পর প্রতিবাদের মৃদু স্বরও কেন শোনা যায়নি হিন্দু মহাসভার কণ্ঠে? লবণ সত্যাগ্রহ, ভারত ছাড়ো এবং সবশেষে ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট... ভারতের লড়াই এবং প্রাপ্তির সেই সফরে চার আনা ভূমিকাও ছিল না সঙ্ঘের। বরং তারা মানতে চায়নি স্বাধীনতা। ৫২ বছর ধরে তেরঙ্গা ওঠেনি তাদের দপ্তরে। কিন্তু স্বাধীনতার ৭৫ বছরে পৌঁছে তারাই ডাক দিয়েছে ‘ঘর ঘর তিরঙ্গা’ কর্মসূচির। এই মহান উদ্যোগ ঘোষণা করেছেন কে? নরেন্দ্র মোদি। সঙ্ঘের আদর্শে বেড়ে ওঠা আমাদের ‘রাষ্ট্রনায়ক’। আজ তাঁর দল, তাঁর সরসঙ্ঘই পরম জাতীয়তাবাদী! মানতে হবে? শাসক যখন বলছে... মানতে তো হবেই। তারা যদি বলে, কংগ্রেস স্বাধীনতার জন্য কিছু করেনি। মানতে হবে। তারা যদি বলে, বাংলার ঘরে ঘরে সেই সময় বিপ্লব জন্ম নেয়নি, বাঙালি স্বাধীনতার জন্য কিছু করেনি... মানতে হবে। তারা যদি বলে, ১৯৪৭ সালে অর্জন করা ‘আজাদি ঝুটা’... সেটাও মানতে হবে। কারণ, ওরাই যে এখন আমাদের মাইবাপ। প্রকৃত স্বাধীনতা তাহলে কবে এসেছে? ২২ জানুয়ারি, ২০২৪। সরসঙ্ঘ প্রধান মোহন ভাগবত ঘোষণা করে দিয়েছেন।
হিন্দু জাতীয়তাবাদ। সঠিক কোনও শব্দবন্ধ যদি সঙ্ঘ এবং বিজেপির জন্য লাগসই হতে পারে, তাহলে এটাই। ধর্ম নিয়ে রাজনীতি এদেশে নতুন নয়। কিন্তু বলতেই হবে, আরএসএস ও বিজেপি একে অন্য মাত্রায় নিয়ে গিয়েছে। হিন্দুধর্মকে বদলে দিয়েছে হিন্দুত্বে। মনে হতেই পারে, দুটোর ফারাক কোথায়? পার্থক্য আছে। কারণ, হিন্দুধর্ম হল আধার। মনুষ্যত্বের, ত্যাগের, ভক্তির। আর হিন্দুত্ব হল মাধ্যম। রাজনীতির মাধ্যম। ব্যবসার মাধ্যম। স্বার্থসিদ্ধির মাধ্যম। হিন্দুধর্ম কোনও বিশেষ সম্প্রদায়কে খাটো দেখিয়ে নিজেকে জাহির করে না। তাই স্বামীজি হিন্দুর সঙ্গে একসুরে নাম উচ্চারণ করেন ইহুদি এবং জরাথ্রুষ্টীয়দের। বৌদ্ধধর্মের ত্যাগ এবং ভক্তিকে পরমাত্মার কাছে পৌঁছনোর মসৃণ পথ বলে ঘোষণা করেন তিনি। বলেন শ্রীকৃষ্ণের কথাও... ‘মানুষ পদ্মপত্রের মত সংসারে বাস করিবে। পদ্মপত্র জলে থাকে, কিন্তু তাহাতে জল লাগে না; মানুষ তেমনি এই সংসারে থাকিবে, ঈশ্বরে হৃদয় সমর্পণ করিয়া হাতে কাজ করিবে।’ মহাভারতের মতো রাজনৈতিক ‘এপিক’ আর একটিও নেই। ছত্রে ছত্রে ওই মহাকাব্যে ঝরে পড়ে রাজনীতির বারুদ। তাতে কখনও অগ্নিসংযোগ করে দেবকুল, কখনও মানুষ। কিন্তু ধর্মকে রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার তো মহাভারতেও করা হয় না! শ্রীকৃষ্ণ দেখিয়ে যান, রাজনীতির থেকে ধর্মকে কীভাবে পৃথক করতে হয়। তাঁর ব্যক্ত করা গীতার প্রতিটা শ্লোক অর্জুনকে কর্ম, ভক্তি এবং কর্তব্যে নিয়োজিত হওয়ার শিক্ষা দেয়। গীতাকে নিছক রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির জন্য ব্যবহার করতে বলে না! আজ সঙ্ঘের তত্ত্ব মেনে নিলে প্রশ্ন করতে হয়, কে ভুল? স্বামী বিবেকানন্দ? নাকি শ্রীকৃষ্ণ? ২২ জানুয়ারি রামমন্দির উদ্বোধনের মাধ্যমে রামরাজ্য প্রতিষ্ঠার কথা বলে তারা। ওই মুহূর্ত থেকে নতুন যুগের, নতুন কালচক্রের সূচনার হুংকার দেয়। শ্রীরাম নিজেও কি এই ঔদ্ধত্য মেনে নিতেন?
সঙ্ঘের হিন্দু জাতীয়তাবাদ ইন্ধন দেয় সাম্প্রদায়িকতায়। আর তার ফল দশকের পর দশক ধরে ভুগতে হয় ভারতকে। কখনও মহাত্মা গান্ধীর মৃত্যুর দৃশ্যে, কখনও সংখ্যালঘুদের অধিকার অস্বীকার করে। সঙ্ঘের প্রতিষ্ঠাতা কেশব বলিরাম হেডগেওয়ার কার অনুরাগী ছিলেন? হিন্দু মহাসভার নেতা বি এস মুঞ্জের... যিনি ইতালি গিয়ে দেখা করেছিলেন মুসোলিনির সঙ্গে। পাঠ নিয়েছিলেন ফ্যাসিজমের। হিন্দু মহাসভার এই নেতার প্রভাব আর কার উপর প্রবলভাবে ছিল? বিনায়ক দামোদর সাভারকর। হিন্দুধর্মকে যে হিন্দুত্বে বদলে ফেলা যায়, সেটা দেখিয়েছিলেন তিনিই। মুঞ্জের যদি ফ্যাসিজমের প্রশংসক হন, সাভারকর ছিলেন নাৎসিদের। ভারতকে ধর্মনিরপেক্ষ বলে মানতেন না তিনি। ভারত তাঁর কাছে ছিল হিন্দুরাষ্ট্র। হিন্দুদের পুণ্যভূমি। কাজেই আজ যদি আরএসএস তাঁর সুরেই রামরাজ্য প্রতিষ্ঠার কথা বলে, সংখ্যালঘুদের অস্বীকার করে এবং দেশের স্বাধীনতার দিনটিকেই ভুলে যেতে যায়, তাতে অস্বাভাবিক কিছু আছে কি? ধর্মের নামে বিভেদের রাজনীতি যে এমনই এক শ্রেণির হাড়েমজ্জায় ঢুকে পড়েছে। আমরা সেটাই হজম করছি। কেউ স্বেচ্ছায়, কেউ নিরুপায় হয়ে, আবার কেউ প্রতিবাদের স্বর হারিয়ে। গণতান্ত্রিক ভারতে তাই স্বাধীনতার গুরুত্ব কেউ অস্বীকার করলেও তাকে ভর্ৎসনা করার কণ্ঠ নেই। শাসক দেশের সংবিধান বদলে দিতে চাইলেও তাকে উপড়ে ফেলার মতো শক্ত কাঁধ নেই। গুটিকয় প্রতিবাদ এই উপমহাদেশের কয়েকটি প্রান্ত থেকে ওঠে, আবার হারিয়ে যায় আগ্রাসী রাজনীতির নিনাদে। আমরা মেনে নিই অসহায়তাকে। মূল্যবৃদ্ধি, বেকারত্ব, হিন্দুধর্মের নতুন সংজ্ঞাকে। কেন? ভারতীয় নামে যে জাতি কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী পর্যন্ত অবস্থান করে, আজ তারা কি এতই দুর্বল? যে জাতি এক সময় বিদেশি রাজদণ্ড ভেঙে ফেলতে জীবন তুচ্ছ করেছিল, দেশমাতৃকার প্রতি ভক্তিকে হাতিয়ার করে নেমে পড়েছিল নিঃস্বার্থ সংগ্রামে, তারা আজ কোথায়?
অসহযোগ আন্দোলনের সময় হেডগেওয়ার কারাবরণ করেছিলেন। কিন্তু তাঁর সাফ কথা ছিল, ব্যক্তি হিসেবে তিনি এই আন্দোলনে যোগ দিয়েছেন। আরএসএস আদর্শগতভাবে দেয়নি। অর্থাৎ, কৌশলে সঙ্ঘকে স্বাধীনতা সংগ্রামের বাইরে রেখে দিয়েছিলেন তিনি। অথচ, জাতীয়তাবাদের স্ট্যাম্পটুকু জোগাড় করে নিতে অসুবিধা হয়নি তাঁর। এমন সংগঠনের থেকে আজ ভারতকে ‘প্রকৃত স্বাধীনতা’ শিখতে হবে?
আন্দামানের জেলে থাকাকালীন ক্ষমাপ্রার্থনা করে চিঠি দিয়েছিলেন সাভারকর। মুক্তি চেয়েছিলেন তিনি। পেয়েওছিলেন। শর্ত চাপিয়েছিল ব্রিটিশ সরকার। রাজনীতি করতে পারবেন না তিনি। আর রত্নগিরির বাইরে যেতে পারবেন না। মেনে নিয়েছিলেন সাভারকর। শোনা যায়, সে জন্য নাকি তাঁকে মাসোহারাও দেওয়া হতো। রত্নগিরির বাইরে তিনি যাননি ঠিকই, কিন্তু পর্দার আড়াল থেকে হিন্দু মহাসভা এবং সঙ্ঘের জন্য ঘুঁটি সাজিয়ে গিয়েছেন। আর যখন ‘ছাড়পত্র’ পেয়েছেন, ছ’বছরের জন্য হিন্দু মহাসভার সভাপতি পদ অলঙ্কৃত করেছেন সাভারকর। প্রকাশ্যে এনেছেন ‘দ্বিরাষ্ট্র তত্ত্ব’। অর্থাৎ, হিন্দু ও মুসলিমদের জন্য আলাদা দেশ। সাম্প্রদায়িক রাজনীতি। বিভাজন। আজ তাঁর অনুগামীদের কাছে আমরা শিখব, কবে আমাদের স্বাধীনতা দিবস?
শ্রীকৃষ্ণের বাণী উদ্ধৃত করে স্বামীজি বলেছিলেন, ‘সূত্র যেমন মণিগণের মধ্যে, আমিও সেইরূপ সকল ধর্মের মধ্যে অনুস্যূত। যাহা কিছু অতিশয় পবিত্র ও প্রভাবশালী, মানবজাতির উন্নতিকারক ও পাবনকারী, জানিবে—সেখানেই আমি আছি।’ সর্বধর্ম সমন্বয়ের ডাক দিয়েছিলেন স্বামীজি। যেখানে মারামারি, কাটাকাটি থাকবে না। জাত, বর্ণের ভিত্তিতে মনুষ্যত্বের বিচার হবে না। পরমাত্মার কাছে পৌঁছোনই হবে উদ্দেশ্য। প্রত্যেকের অধিকার সমান হবে। আর... মানুষ প্রকৃতভাবে স্বাধীন হবে। মোহন ভাগবত নিশ্চয়ই তেমন কোনও রাষ্ট্রের কথা বলছেন না?