স্ত্রীর শরীর স্বাস্থ্য নিয়ে হঠাৎ সমস্যায় মানসিক চিন্তা ও উদ্বেগ। কাজকর্ম কমবেশি এগবে। অতিরিক্ত পরিশ্রমে ... বিশদ
ভারত আমার কাছে শুধু দেশ নয়, এটি একটি অনুভূতি। মার্কিন রাষ্ট্রদূত হিসেবে এই অসাধারণ দেশটির বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। মুম্বইয়ের ব্যস্ত রাস্তা, কলকাতার সাংস্কৃতিক মন, হিমালয়ের শান্তি, অরুণাচল প্রদেশ কিংবা কন্যাকুমারীর সাগরের বিস্তৃতি—এই দেশের প্রতিটি কোণ আমাকে নতুন করে জীবনকে উপলব্ধি করতে শিখিয়েছে। আমাকে শিখিয়েছে যে, আমেরিকা এবং ভারত যখন একসঙ্গে কাজ করে, তখন আমাদের সম্ভাবনা সীমাহীন।
সংখ্যা নয়, সম্পর্কের উষ্ণতা
ভারত এবং আমেরিকার সম্পর্কের গভীরতা শুধু পরিসংখ্যান দিয়ে বোঝানো যায় না। প্রায় ২০০ বিলিয়ন ডলারের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য। আমেরিকাকে এখন ভারতের বৃহত্তম ব্যবসায়িক পার্টনার। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অধ্যয়নরত বিদেশি পড়ুয়াদের অধিকাংশই ভারতীয়। এবং সংখ্যাটা ৩ লক্ষাধিক। টানা দু’বছর ১০ লক্ষেরও বেশি ননইমিগ্র্যান্ট ভিসা ইস্যু করা হয়েছে ভারতীয়দের জন্য। রয়েছে পৃথিবীকে রক্ষা করতে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় ৯.২৫ বিলিয়ন ডলারের সহযোগিতা। স্বাস্থ্যক্ষেত্রে একসঙ্গে ৯০টিরও বেশি সামগ্রীর উদ্ভাবন, যাতে উপকৃত হয়েছেন সাড়ে চার কোটিরও বেশি ভারতবাসী। অবাক করা এই পরিসংখ্যান! কিন্তু তার নেপথ্যে রয়েছে এমন সব অবিশ্বাস্য কাহিনি, যা দু’দেশের সম্পর্ককে আরও প্রাণবন্ত করে তুলেছে।
শান্তি, সমৃদ্ধি, পৃথিবী এবং মানুষ
মার্কিন রাষ্ট্রদূত হিসেবে ভারতে আসার পর দু’দেশের যৌথ কাজকর্মের ব্যাপ্তি আমাকে মুগ্ধ করেছিল। প্রযুক্তি থেকে বাণিজ্য, নারীর ক্ষমতায়ন থেকে স্বাস্থ্যসেবা, নিরাপদ ও সুরক্ষিত ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল থেকে মহাকাশ—আরও আরও অনেক ক্ষেত্রেই একসঙ্গে কাজ করেছে ভারতীয় এবং মার্কিনীরা। সেটা আমার কল্পনারও বাইরে ছিল। চারটি ‘পি’ বা পিস, প্রসপারিটি, প্ল্যানেট অ্যান্ড পিপল (শান্তি, সমৃদ্ধি, পৃথিবী এবং মানুষ) আমাদের সম্পর্কের ভিত্তি। এর মাধ্যমে কীভাবে আমরা এক উন্নত বিশ্ব এবং উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ গড়ে তুলেছি, আমি তার প্রত্যক্ষ সাক্ষী!
একেবার প্রথম সরকারি সফরেই, আমেদাবাদে স্বনির্ভর মহিলা সংগঠনের (এসইডব্লুএ) নেত্রীদের সঙ্গে দেখা করেছিলাম। জলবায়ু সঙ্কটের বিরুদ্ধে জরুরি ভিত্তিতে বিশ্বব্যাপী পদক্ষেপ নেওয়া যে কতটা প্রয়োজন, তা স্মরণ করিয়ে দেয় তাঁদের কাহিনি।
পুনের সিরাম ইনস্টিটিউটে তৈরি ম্যালেরিয়া ভ্যাকসিনের প্রথম ব্যাচটির ট্রাকে ওঠার মুহূর্তটিও যেমন জীবনেও ভুলতে পারব না। একটি ভারতীয় নির্মাতা, একটি মার্কিন জৈবপ্রযুক্তি সংস্থা এবং ব্রিটেনের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌথ প্রচেষ্টার ফল ছিল এটি। সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিকের জন্য তা পাঠানো হচ্ছিল।
ভারতীয় উদ্যোগপতিদের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বড় সম্মেলনগুলোতে যোগ দিতে পেরেও আমি গর্বিত। ‘সিলেক্টইউএসএ’ সামিটে আমেরিকায় ৩.৪ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ ঘোষণা করেছিল ভারতের সবচেয়ে বড় প্রতিনিধি দল। আমি সেই মাহেন্দ্রক্ষণের সাক্ষী। দেখা করেছি মার্কিন-ভারত এভিয়েশন সামিটে অংশ নেওয়া বেসরকারি সেক্টরের উদ্যোগপতিদের সঙ্গেও। ভারতের অসামরিক উড়ান পরিষেবার উন্নয়নে ১৫০ বিলিয়ন ডলারের মার্কিন বিমানের বরাত দিয়েছেন তাঁরা। এছাড়া হরিয়ানায় একটি এভিয়েশন হাব তৈরির পরিকল্পনাও করা হয়েছে।
সম্পর্কের সেতু সংস্কৃতি ও ক্রিকেট
ভারতের মহান সংস্কৃতি সবসময় আমাকে মুগ্ধ করেছে। তাই দু’দেশের একটি সাংস্কৃতিক চুক্তি স্বাক্ষর করতে পেরে আমি গর্বিত। এই চুক্তি আমাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের বিনিময়কে আরও সহজ করে তুলেছে।
আর রয়েছে ক্রিকেট, যা ভারতের হৃৎস্পন্দন। সেটি এখন আমেরিকাতেও জায়গা করে নিচ্ছে। ২০২৩ সালে মেজর লিগ ক্রিকেটের সূচনা থেকে শুরু করে ২০২৮ সালে লস এঞ্জেলেস ওলিম্পিকসে ক্রিকেট অন্তর্ভুক্ত করা পর্যন্ত, এই যাত্রার অংশ হতে পেরে আমি আনন্দিত।
আমার কাছে একটা বিষয় স্পষ্ট যে দু’দেশের সম্পর্কে কেউ একে অপরের পরিপূরক নয়। আমেরিকা ও ভারত যখন একসঙ্গে কাজ করে, তখন বৃহত্তর কল্যাণের লক্ষ্যে এমন কোনও দরজা নেই যা আমরা খুলতে পারি না।
ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে কিশোর বয়সে কোনওদিন ভাবিনি যে একদিন এমন একটি দায়িত্ব পালন করব, যা দুই দেশের ভবিষ্যৎকে এত গভীরভাবে প্রভাবিত করবে। চ্যালেঞ্জ আসবে—জলবায়ু সঙ্কট, প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার, বিশ্বব্যাপী নিরাপত্তা। কিন্তু আমি জানি, ভারত এবং আমেরিকা একসঙ্গে থাকলে এই চ্যালেঞ্জগুলো আরও সহজ হয়ে যাবে।
স্বয়ং মহাত্মা গান্ধী বলে গিয়েছেন, ‘আমরা বর্তমানে কী করি, তার উপরই ভবিষ্যৎ নির্ভর করে।’ তাই আসুন, এই বন্ধনকে আমরা আরও শক্তিশালী করি এবং একসঙ্গে এমন একটি ভবিষ্যৎ গড়ে তুলি, যা শান্তি, সমৃদ্ধি এবং মানবতার জন্য একটি উদাহরণ হয়ে থাকবে।
ভারত, তোমার উষ্ণতা, জ্ঞান এবং ভালোবাসার জন্য ধন্যবাদ। এই দেশে রাষ্ট্রদূত হিসেবে কাজ করা আমার জীবনের সবচেয়ে বড় সম্মান। বিদায়ের এই মুহূর্তে আমি শুধু বলতে পারি, এই দেশের প্রতি আমার ভালোবাসা চিরন্তন।
অনেক অনেক ধন্যবাদ এবং আবার দেখা হবে!