কাজকর্মের ক্ষেত্রে ও ঘরে বাইরে বাধা থাকবে। কারও প্ররোচনায় যে কোনও সিদ্ধান্ত গ্রহণে সতর্ক হন। ... বিশদ
এভাবেই বারবার প্রমাণিত হয়েছে যে, জীবিত মানুষের থেকে মৃত মানুষের শক্তি অনেক বেশি। বহু মৃত ব্যক্তি অনেকেরই ঘুম কেড়ে নেয়। বর্তমান মোদি সরকারকে দেখলে সেটা আরও ভালো করে নজরে পড়ে। মোদি বা অমিত শাহের সব থেকে ভয় কাকে? মহাত্মা গান্ধী, নেহরু, আম্বেদকর, ইন্দিরা গান্ধী, রাজীব গান্ধীকে। প্রত্যেকেই মৃত, কিন্তু তাঁদের ছায়া দেখলে আতঙ্কে নিন্দামুখর হয়ে ওঠেন তিনি। বারবার সেই মৃত ব্যক্তিদের সমালোচনায় বিদ্ধ করেন। তাই দশ বছরের বেশি সময় ধরে দেশ শাসনের পরেও বিজেপির মুখে বারবার এই নামগুলিই ঘুরে ফিরে আসে। মৃত মানুষদের চাঁদমারি করে অনর্গল সমালোচনার কাদা ছেটান। আসলে তাঁদের কৃতিত্বগুলিকে নস্যাৎ করে নিজেকে বিশাল করে দেখানোর এটা একটা চেষ্টা মাত্র। ক্ষমতায় থাকার এতদিন পরেও তিনি নিজের কোনও গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় তুলে ধরতে অক্ষম। কেননা তাঁর ক্ষমতায় থাকার দশটি বছর ব্যর্থতার এক কলঙ্কিত অধ্যায়। সেই কলঙ্ক মুছতে তাঁর দরকার নেহরু, আম্বেদকরের মতো কিছু মৃত মানুষের নাম। এভাবেই চলছে চালুনির ছুঁচের বিচার।
পূর্বসূরিদের কীর্তি মুছে ফেলে নিজেকে ‘বিশ্বগুরু’ হিসাবে প্রতিষ্ঠা করতে নানা অসত্য তথ্যের প্রচার করে চলেছেন প্রধানমন্ত্রী। তবে যতই তিনি নিজেকে বিশাল আকারে তুলে ধরার চেষ্টা করুন না কেন, তাঁর বিদায়ের অপস্রিয়মাণ সময়টা যেন ধীরে ধীরে স্পষ্ট হচ্ছে। হয়তো তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসাবে পুরো টার্ম নাও থাকতে পারেন। কোনও এক সময়ে প্রধানমন্ত্রী পদে রদবদল হতে পারে। আরএসএস এ ব্যাপারে নীরবে আড়াই ঘরের চাল দিচ্ছে। সেই বার্তা দলের মধ্যে পরিষ্কার হতেই শুরু হয়েছে প্রধানমন্ত্রী পদ দখল নিয়ে টাগ অব ওয়ার। দুইদিকে দুই পুরুষ। গুজরাতি পুরুষ অমিত শাহ এবং উত্তরপ্রদেশের পুরুষ যোগী আদিত্যনাথ। একটু দূরে দাঁড়িয়ে নিঃশব্দে ছোঁ মারার চেষ্টায় আছেন নীতিন গাদকারি। তবে মূলত দুই দাবিদার হলেন অমিত এবং যোগী।
আপাতত এজেন্ডা ঘর গোছানো, রাজনৈতিক শক্তি সঞ্চয়। এই কাজে তাঁদের অস্ত্র হিন্দুত্ব। তাঁদের বডি ল্যাঙ্গুয়েজ বুঝিয়ে দিচ্ছে মোদির পথেই হিন্দুত্বের ঝান্ডা হাতে তাঁরা লক্ষ্যে পৌঁছতে চাইছেন। তাই যোগী যখন মন্দির মন্দির করে ছুটছেন, সব মসজিদের নীচে মন্দির খুঁজে বেড়াচ্ছেন, তখন অমিত শাহ আম্বেদকরের দিকে কাদা ছেটানোর কাজে বেশি সময় ব্যয় করছেন। বিজেপি এই সংবিধানকে যে মনপ্রাণ দিয়ে মানে না, সেটা গত দশ বছরে বারবার বোঝা গিয়েছে। মনুবাদী শাসন ব্যবস্থার প্রতি তাঁরা যে বেশি আস্থাশীল, সেটা অবশ্য গেরুয়াবাবুরা গোপন করেন না। মনুবাদই তাঁদের কাছে সংবিধান। যে মনুবাদের আইন কখনওই সভ্য সমাজে. কার্যকর হতে পারে না।
সুতরাং এই লড়াইয়ের মাঝে রয়েছে অনেক প্রশ্ন। শেষ পর্যন্ত নার্ভের লড়াইয়ে কে জিতবেন? মোদি বা মোহন ভাগবত কোন পক্ষে রয়েছেন? সর্বভারতীয় প্রেক্ষাপটে কার অবস্থান কোথায়?
এ ব্যাপারে কোনও সন্দেহই নেই যে, মোদি সবসময় অমিত শাহকেই পছন্দ করে এসেছেন। গুজরাত কী মজবুত জোড়ি হ্যায়, টুটেগা নেহি। সেই গোধরা যুগ থেকেই তাঁদের বন্ধন অটুটু। একে অন্যের দোসর। তাই মোদি সবসময় চান, তাঁর পরে দেশের প্রধানমন্ত্রী হোন অমিত শাহ। সেই প্রক্রিয়া মোদি শুরু করে দিয়েছেন। একটা ব্যাপার পরিষ্কার, আগামী দিনে সম্ভবত জোট রাজনীতির ‘বড় দাদা’ হয়েই বিজেপিকে থাকতে হবে।
সেক্ষেত্রে শরিক দলগুলি যাতে অমিত শাহকেই সমর্থন করেন, তার জন্যও খেলাও শুরু হয়েছে। বিভিন্ন ক্ষেত্র্রে জোটের শরিক দলগুলির সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্ক আরও বেশি শক্তিশালী করতে প্রয়াসী হয়ে উঠেছেন অমিত।
তুলনায় বেশ কিছুটা পিছিয়ে যোগী আদিত্যনাথ। সুযোগ পেতেই মোদি-শাহ জুটি যোগীকে জাতীয় রাজনীতির আঙিনা থেকে সরিয়ে দিয়েছেন। বস্তুত জাতীয় রাজনীতিতে এই মুহূর্তে যোগী আদিত্যনাথের আসন ততটা শক্তিশালী নয়। তাই তিনি জাতীয় স্তরে নিজের আসন শক্তিশালী করার জোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। রামমন্দির বিজেপিকে প্রচুর ডিভিডেন্ট দিয়েছে। সেই রামমন্দির নির্মাণ হয়ে গেলেও টেম্পল পলিটিক্সের রাস্তা ছেড়ে বেরিয়ে আসতে রাজি নন আদিত্যনাথ। গোরু এবং মন্দিরের গুরুত্ব তাঁর কাছে অনেক বেশি। সেটাকেই তিনি জাতীয় রাজনীতিতে দ্রুত প্রত্যাবর্তনের হাইওয়ে বলে মনে করছেন।
অমিত শাহ এবং যোগী তাই তাঁদের নিজেদের মতো করে খেলতে শুরু করেছেন। পর্দার আড়ালেও চলছে শক্তি সংগ্রহের নিরবচ্ছিন্ন চেষ্টা। অমিত শাহের দিকে আছে বিজেপি দলটি। যোগীর দিকে আছে আরএসএস। অমিত শাহ ইতিমধ্যেই ‘চাণক্য’ হিসাবে সুনাম কুড়িয়েছেন। আদিত্যনাথ আবার ‘ঠোক দো’, বুলডোজার পলিটিক্সের মাধ্যমে ‘ঝুঁকেগা নেহি’ ভাবমূর্তি তৈরি করেছেন। তাই রাজনীতির মারপ্যাঁচ তিনিও ভালোই বোঝেন।
অমিত শাহ কয়েকদিন আগেই আম্বেদকরকে তেড়ে সমালোচনা করেছেন। কোন প্রসঙ্গে করলেন? সংবিধানের ৭৫তম বর্ষে রাজ্যসভায় দাঁড়িয়ে আম্বেদকরের নিন্দার অর্থ সংবিধানকেই অস্বীকার করা। অমিতের সুরেই বলা যেতে পারে, মোদিজি যেভাবে বারবার জওহরলালের নাম নিয়ে নিজের ব্যর্থতা ঢাকার আপ্রাণ চেষ্টা করেন, সেটা না করে নিজের রাজধর্মটুকু পালন করলেই হতো। তাহলে আর তাঁকে ক্ষমতায় টিকে থাকতে মন্দির মন্দির বা হিন্দুত্বের উস্কানি দিতে হতো না। রাজধর্ম পালনের ব্যর্থতাই মোদি এবং অমিত শাহকে অন্যের নিন্দা করায় উৎসাহ দিয়ে গিয়েছে। ব্যর্থ শাসককে নিজেদের ভাবমূর্তির মোমবাতি জ্বালাতে জওহরলাল, আম্বেদকরদের কাছ থেকে দেশলাই ধার করতে হয়।
আমাদের সংবিধানের প্রাণপুরুষ হলেন আম্বেদকর। সংবিধান প্রণেতা হিসাবে গান্ধীজিই চেয়েছিলেন আম্বেদকর হোন সংবিধানের খসড়া কমিটির চেয়ারম্যান। জওহরলাল কিন্তু প্রথমে রাজি ছিলেন না। নেহরু মনে করেছিলেন ভারতের সংবিধান রচনার ক্ষেত্রে যোগ্য ব্যক্তি হলেন ইংরেজ বিশেষজ্ঞ আইভর জেনিংস। গান্ধীজির চাপে জওহরলাল সংবিধান রচনার খসড়া কমিটির চেয়ারম্যান হিসাবে মেনে নেন আম্বেদকরকে। পরে অবশ্য জওহরলাল বুঝেছিলেন, গান্ধীজি লোক চিনতে ভুল করেননি। সংবিধান রচনা করতে বসে আম্বেদকরের মূল লক্ষ্য ছিল, বিবিধের মাঝে একটা অখণ্ড চেতনার প্রকাশ ঘটানো। অসাম্যের হাওয়া দূর করে একটা সাম্যের শাসন প্রতিষ্ঠা করা।
আমাদের সংবিধানের শক্তি হল বিবিধের মাঝে মহামিলনের ঐতিহ্যকে দৃঢ় রাখা। ঠিক এইখানটাতেই আম্বেদকরের ওপর আরএসএসের রাগ। আসলে আরএসএস কোনওদিনই চায়নি ইংরেজরা এদেশ থেকে চলে যাক। বরং চেয়েছিল ইংরেজদের সেবা করে তাদের করুণা আদায়ের মাধ্যমে একটা হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্র গড়ে তোলা।
সংবিধান রচনার খসড়া কমিটি গড়া হল ১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর। এর ঠিক চারদিন পর ৩০ নভেম্বর আরএসএসের মুখপত্র ‘মাউথপিস’-এর সম্পাদকীয়তে তেড়ে গাল পাড়া হল এই প্রচেষ্টাকে। তারা সংবিধানকে ‘মনুস্মৃতি’ অনুকরণে গড়ে তোলার দাবি জানাল। নিন্দা করা হল আম্বেদকরের। আজ অমিত শাহের কণ্ঠে সেই ধিক্কারেরই প্রতিধ্বনি শোনা যাচ্ছে। এরপর ১৯৪৯-এর ১২ ডিসেম্বর আরএসএসের পক্ষ থেকে নেহরু ও আম্বেদকরের কুশপুতুল পুড়িয়ে দুই নেতা ‘নিপাত যাক’ বলে স্লোগান দেওয়া হল। ভেঙে চুরমার করে দেওয়া হল শেখ আবদুল্লার গাড়ি। সেদিন সেই আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন স্বামী করপত্রিজি। তিনি ছিলেন একজন পণ্ডিত এবং কট্টর হিন্দুবাদী সাধু।বোঝা যাচ্ছে সেই ক্রোধ, সেই বিদ্বেষ এখনও মেটেনি। মেটার কথাও নয়। মহাত্মা গান্ধী, নেহরু এবং আম্বেদকরের উপর বিজেপির আজন্মের রাগ। তাদের বহু উদ্দেশ্যকে এই তিন নেতা সফল হতে দেননি। এই ত্রিফলা শক্তির কাছে বারবার আরএসএসের পরাজয় ঘটেছে। সেই রাজনৈতিক লড়াইয়ে হেরে গিয়ে সঙ্ঘসখা নাথুরাম গডসে হাতে তুলে নিয়েছিলেন আগ্নেয়াস্ত্র। ‘হে রাম’ বলে লুটিয়ে পড়েছিলেন গান্ধীজি। মনে রাখা দরকার, গান্ধীর সেই ‘রাম’ এবং মোদির ‘রামচন্দ্র’ এক ব্যক্তি নন।
অমিত-যোগীর লড়াইয়ে কে শেষ হাসি হাসবেন, তা সময় বলবে। মোদির পর হিন্দুত্বের পোস্টার বয় কে, সেটা এখনই বলা সম্ভব নয়। এই লড়াই অতটা সহজ নয়। মোদির সরে দাঁড়ানোর আগের মুহূর্ত পর্যন্ত জারি থাকবে লড়াই। এই লড়াইয়ে ভারত এক কদমও এগবে না, দেশের অর্থনীতিরও বিশেষ হেরফের হবে না। দেশ যেমন ক্রমে পিছিয়ে যাচ্ছে, সেভাবেই পিছবে। পিছতে পিছতে আমরা একদিন সম্ভবত পুরাণকালে পৌঁছে যাব। তাতে সত্যিই কি বিজেপির কিছু যায় আসে?