কাজকর্ম, বিদ্যাশিক্ষায় দিনটি শুভ। বৃত্তিগত প্রশিক্ষণে সাফল্যের সুবাদে নতুন কর্মপ্রাপ্তির সম্ভাবনা। দেহে আঘাত লাগতে পারে। ... বিশদ
সম্প্রতি মধ্যপ্রদেশের ইন্দোরের জেলাশাসকের একটি ঘোষণায় বেশ আলোড়ন পড়েছে। খবরে প্রকাশ, ইন্দোর শহরকে ভিখারিমুক্ত করা হবে। উদ্দেশ্য, শহর পরিষ্কার রাখা এবং ভাবমূর্তি নষ্ট হতে না দেওয়া। তারজন্য নেওয়া হয়েছে এক অভিনব সিদ্ধান্ত। কী সেই সিদ্ধান্ত? গরিব, নিরন্ন মানুষের উদর পূর্তির জন্য যিনি সাহায্য করবেন বা ভিক্ষে দেবেন তাঁর বিরুদ্ধে নেওয়া হবে পুলিসি ব্যবস্থা। ইন্দোরের জেলাশাসক আশিস সিং সাফ জানিয়েছেন, ২০২৫ সালের ১ জানুয়ারির পর কাউকে প্রকাশ্যে ভিক্ষা দিতে দেখা গেলে তার নামে করা হবে এফআইআর। তারপর হবে শাস্তির ব্যবস্থা। ইতিমধ্যেই সেই বার্তা সকলের কাছে পৌঁছেও দেওয়া হয়েছে।
শহরকে ভিখারিমুক্ত করার ‘পাইলট প্রজেক্ট’ চালু হচ্ছে ইন্দোরে। তারপর বিজেপি শাসিত বিভিন্ন রাজ্যের শহরগুলিতে হইহই করে চালু হয়ে যাবে। এর অর্থ, দীনজনে দয়া করা এখন আর মানবতা নয়, বরং ডাবল ইঞ্জিন সরকারের চোখে তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। তবে, রোগ নিরাময়ের বদলে কসমেটিক সার্জারি করে দগদগে ঘা আড়ালের চেষ্টা এই প্রথম নয়। বলা ভালো, এটাই নরেন্দ্র মোদি সরকারের স্ট্র্যাটেজি। এর আগেও হয়েছে। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যখন ভারত সফরে এসেছিলেন তখন তাঁর যাত্রাপথের দু’পাশের বস্তি, আবর্জনা আড়ালের এলাহি আয়োজন করা হয়েছিল।
ভারতবর্ষকে জগৎসভায় শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের স্বপ্ন ইন্দিরা গান্ধীর পর যদি কেউ দেখিয়ে থাকেন, তাঁর নাম মনমোহন সিং। কখনও অর্থমন্ত্রী, কখনও প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আর্থিক মন্দার হাত থেকে দেশকে রক্ষা করেছিলেন সদ্য প্রয়াত মনমোহনজি। তিনিই চালু করেছিলেন ১০০ দিনের কাজের প্রকল্প। খাদ্যসুরক্ষা বিলও তাঁরই আমলে। করোনার থাবায় যখন বিশ্বজুড়ে আর্থিক মন্দা তখন একপ্রকার উপযাচক হয়েই দেশবাসীকে রক্ষার জন্য তিনটি দাওয়াই তিনি বাতলে ছিলেন। তার প্রথমটাই ছিল, জীবন ও জীবিকা বাঁচাতে এবং খরচের ক্ষমতা বাড়াতে আম জনতার হাতে দিতে হবে যথেষ্ট অর্থ। কিন্তু মোদিজি হাঁটলেন সম্পূর্ণ উল্টোপথে। দেশে মনরেগার বরাদ্দ কমিয়ে দিলেন। আর পরাজয়ের জ্বালা মেটাতে বাংলায় ১০০ দিনের কাজই বন্ধ করে দিলেন।
অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, সেদিন মনমোহন সিংয়ের কথা মোদিজি শুনলে ক্ষুধার সূচকের নিরিখে শ্রীলঙ্কা, নেপাল, মায়ানমার, এমনকী বাংলাদেশের চেয়েও ভারতবর্ষকে পিছিয়ে যেতে হতো না। এহেন দেশে পাঁচ বছরে নষ্ট হয়েছে ৬ লক্ষ মেট্রিক টন রেশনের খাদ্যসামগ্রী। বাজারমূল্য ১৮২৩ কোটি টাকা। ফল কারা ভোগ করছেন? রেশন গ্রাহকরা। নরেন্দ্র মোদির সরকারের খাতায় যারা আর্থিকভাবে দুর্বল শ্রেণির মানুষ। সংখ্যাটা ৮০ কোটি। তাঁদের জন্য বরাদ্দ রেশন মাঝপথে নষ্ট হচ্ছে অথবা চুরি যাচ্ছে। ফলে যতটা খাদ্যসামগ্রী গরিব মানুষের পাওয়ার কথা, সেটা পাচ্ছে না।
এটা হঠাৎ করে ঘটে যাওয়া কোনও ঘটনা নয়। বছরের পর বছর একই ঘটনা ঘটেছে এবং ঘটছে। কিন্তু, তা বন্ধে কোনও পদক্ষেপ করা হয়নি। অব্যবস্থা হলে যাঁরা দায়িত্বে আছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হতো। কিন্তু সেটাও হচ্ছে না। তাতেই বোঝা যাচ্ছে, সরকার বিষয়টি বন্ধের ব্যাপারে আদৌ আগ্রহী নয়। কিন্তু চাইলে বন্ধ করা যায়। তার প্রমাণ আমাদের বাংলা।
সমীক্ষা রিপোর্ট বলছে, ২০২২-’২৩ অর্থবর্ষে গোটা দেশে রেশন সামগ্রীর ২৮ শতাংশই হয় চুরি অথবা নষ্ট হয়েছে। তার বাজারমূল্য ৭০ হাজার কোটি টাকা। এরমধ্যে ৬৫ ভাগই হয়েছে বিজেপি শাসিত পাঁচ রাজ্যে। সেখানে পশ্চিমবঙ্গে চুরি ও নষ্টের পরিমাণ মাত্র ৯ শতাংশ। অথচ ২০১১-’১২ সালে এর পরিমাণ ছিল ৬৯ শতাংশ। রাজ্য সরকার অনেক কড়া পদক্ষেপ নিয়েছে। বিভিন্ন স্তরে ফাঁকফোকর মেরামত করেছে। এমনকী, করোনার সময় রেশন বণ্টন নিয়ে অভিযোগ ওঠায় খোদ খাদ্যসবিচকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
গরিব ও সাধারণ মানুষের স্বার্থে নরেন্দ্র মোদির সরকারের কাজের দৃষ্টান্ত বিরল। কিন্তু এই সরকারের পদক্ষেপে আম জনতা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, এমন উদাহরণ ভূরি ভূরি রয়েছে। করোনার সময় বন্ধ করে দেওয়া অতি গুরুত্বপূর্ণ বহু ট্রেন এখনও চালু হয়নি। সেই দাবি জানালে খেতে হচ্ছে কেস। কিছু লাইনে লোকাল ট্রেনকে ‘স্পেশাল ট্রেন’ বলে চালানো হচ্ছে। যাচ্ছে লোকালের মতো, কিন্তু গুনতে হচ্ছে এক্সপ্রেসের ভাড়া। ট্রেনের টিকিটে প্রবীণদের ছাড়ের যে সুবিধা যুগ যুগ ধরে চলে আসছিল, সেটাও মোদিজি বন্ধ করে দিয়েছেন অনেক আগেই। স্বাস্থ্য ও বিমার মতো দু’টি জরুরি এবং গুরুত্বপূর্ণ পরিষেবার উপরেও চাপানো হয়েছে জিএসটির বোঝা। ফলে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে খরচ।
সবচেয়ে বড় কথা, চাকরির আবেদন জানাতে গেলেও বেকারদের দিতে হচ্ছে জিএসটি। বছরে দু’কোটি বেকারের চাকরির প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এসেছিলেন মোদি। দশ লক্ষ চাকরি দিতেই হিমশিম খাচ্ছেন। কর্মসংস্থানের প্রতিশ্রুতি রাখতে না পারলেও চাকরি প্রার্থীদের আবেদনপত্রের উপরেও চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে ১৮ শতাংশ জিএসটি। তাতে খরচ এতটাই বেড়ে গিয়েছে যে চাকরির আবেদন করার আগে দুঃস্থ মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের পাঁচবার ভাবতে হচ্ছে। বেকার যুবক-যুবতীদের পকেট কাটতেও কেন্দ্রীয় সরকারের হাত কাঁপছে না। এতে কী প্রমাণ হয়? সাধারণ মানুষকে সুবিধা দেওয়া নয়, তাদের বঞ্চিত করাই কেন্দ্রীয় সরকারের উদ্দেশ্য।
এসব দেখে এখন অনেকেই বলতে শুরু করেছেন, ১০০ দিনের কাজ বন্ধ করে দেওয়াটা আসলে গরিব মারার কল। যেকোনও অজুহাতে টাকা আটকে দিয়ে গরিব মানুষকে বিপন্ন করাই বিজেপির লক্ষ্য। তা না হলে এতদিনে আদালতের পরামর্শ মেনে চাল থেকে কাঁকর বাছার কাজটা সেরে ফেলত। বিশেষ করে লোকসভা নির্বাচনের ফল প্রকাশের পর এব্যাপারে বিজেপি সদর্থক পদক্ষেপ করত। নির্বাচনে পরাজয়ের কারণ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে অনেক বিজেপি প্রার্থীই প্রকাশ্যে বলেছিলেন, ১০০ দিনের কাজ বন্ধ করে দেওয়াটা মানুষ ভালো চোখে নেয়নি। ভোট চাইতে গিয়ে ক্ষোভের ও প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়েছে। বিষয়টি ঊধ্বর্তন নেতৃত্বের দেখা দরকার।
১০০ দিনের কাজ নিয়ে ক্ষোভ তো আছেই। আবাস যোজনার টাকা বন্ধ করে দেওয়াতেও মানুষ প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ। বাংলায় এমপির সংখ্যা একধাক্কায় ৩৩ শতাংশ কমেছে। কিন্তু, তাতেও হেলদোল নেই। কারণ মোদি-অমিত শাহ জুটি বুঝে গিয়েছে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে হারানোর ক্ষমতা বিজেপির নেই। তাঁদের হিসেবে বাংলা আপাতত ‘খরচের খাতায়’। তাই ছাব্বিশের নির্বাচনের আগে ডেলি প্যাসেঞ্জারি করে, চাষির বাড়িতে মধ্যাহ্নভোজের ফটোসেশন সেরে যেটুকু পাওয়া যায়, সেটাই বিজেপির লাভ।
এ রাজ্যে প্রথম হওয়ার দৌড়ে নেই বিজেপি। আবার সিপিএমের যা হাল তাতে প্রধান বিরোধীর জায়গাটাও বিজেপির আপাতত পাকা। অতএব বিজেপির যেমন নতুন কিছু পাওয়ার আশা নেই, তেমনই নেই হারানোর ভয়। তাই অনেকে মনে করছেন, সুপ্রিম কোর্ট ঘাড়ধাক্কা না দিলে গরিব নিধনযজ্ঞে বিজেপির ঘৃতাহুতি চলতেই থাকবে।
মনমোহন সিংয়ের পর দেশের হাল ধরেছেন নরেন্দ্র মোদি। কিন্তু ফারাক বিস্তর। মনমোহন সিং বলতেন কম, কাজ করতেন বেশি। বিজেপির চোখে ছিলেন ‘মৌন প্রধানমন্ত্রী’। কিন্তু নরেন্দ্র মোদি ‘সবাক প্রধানমন্ত্রী’। কথা বেশি, কাজ কম। মনমোহনজি আগে অর্থনীতিবিদ, তারপর প্রধানমন্ত্রী। তাই গরিবের অন্নের সংস্থানই ছিল তাঁর লক্ষ্য। চালু করেছিলেন ১০০ দিনের কাজ। আর মোদিজি আগে রাজনীতিবিদ, তারপর প্রধানমন্ত্রী। রাজনৈতিক স্বার্থই তাঁর কাছে শেষকথা। তাই অনায়াসেই বন্ধ করে দিতে পারেন ১০০দিনের কাজও।
দু’জনই দেশের প্রধানমন্ত্রী। একজন গরিবের মুখে অন্ন জোগানোর দিশা দেখান, অন্যজন তা বন্ধের অজুহাত খোঁজেন। তাই মোদিজি তিনবার নয়, তিরিশবার প্রধানমন্ত্রী হলেও মনমোহনকে ছুঁতে পারবেন না কোনওদিনই।