অর্থপ্রাপ্তির ক্ষেত্রটি বেশ অনুকূল। ব্যবসা, পেশা প্রভৃতি সব কর্মেই কমবেশি উন্নতি ও প্রসারের যোগ। ধর্ম ... বিশদ
আতঙ্কে তসলিমা নাসরিন। মৌলবাদের হিংস্র রূপ কেমন হতে পারে, সেই অভিজ্ঞতা তাঁর রয়েছে। বাংলাদেশ থেকে ‘বিতাড়িত’ তিনি। কিন্তু তারপরও জন্মভূমির জন্য ভয় হয় তাঁর। শুধুই কি তসলিমা? যে কোনও শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষই কি বাংলাদেশের অধুনা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন নন? একটা গোটা রাষ্ট্র যদি ধর্মের নামে নিজেদের চরিত্র বদলে ফেলে, তার থেকে বেশি আতঙ্কের অন্য কিছু হতে পারে না। কোনও দেশে, কোনও সমাজেই নয়। বিভাজনের রাজনীতি মানুষকে শুধু মানুষের থেকে বিচ্ছিন্ন করে। যে ঘরে যুগ যুগ ধরে ন’জনের বাস, হঠাৎ সেখানেই নিজেকে অবাঞ্ছিত বলে মনে করে কোনও না কোনও সুজন। ধর্মের নামে বিভাজনের রাজনীতির বিস্তার এমনই। মাত্র ১৭ কোটি জনসংখ্যার দেশে বিভাজনের ঝড় যে দ্রুত বিপর্যয় আনবে, তাতে সংশয় নেই। ভারতের মতো ১৪০ কোটির দেশ হলে, তাতে খানিক সময় লাগে। এ অনেকটা তাপ পরিবহণের থিওরির মতো। লোহার রড যদি ছোট হয়, এক মাথা থেকে অন্য মাথা পর্যন্ত তাপের পরিবহণ খুব তাড়াতাড়ি হয়ে থাকে। কিন্তু যদি সেই রডই ৫০০ মিটার লম্বা হয়, সামান্য তাপ তার এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত পৌঁছনোর আগেই ফুরিয়ে যায়। ভারতই তার জলজ্যান্ত উদাহরণ। চেষ্টা-চরিত্র এদেশেও কম কিছু হচ্ছে না! ইসলামি জঙ্গি সংগঠনগুলির হানাদারি বা কাশ্মীরের মতো প্রদেশে লাগাতার ভারত বিরোধী প্রচার তো ছিলই। কিন্তু মোদি জমানায় মাথাচাড়া দেওয়া হিন্দুত্ববাদী জিগির পুরো সমীকরণটাকেই উল্টো পথে কষতে শুরু করেছে। কারণ একটাই—ভোটব্যাঙ্ক। কোনও ফর্মুলা ক্লিক না করলে পরীক্ষিত অবস্থান নিতে হয়। সেটা মোদি সরকারের থেকে বেশি ভালো কেউ জানে না। আর সেই অঙ্ক হল হিন্দুত্ববাদের। তাই আশঙ্কায় থাকতে হবে আমাদেরও। বাংলাদেশে মৌলবাদ যেভাবে সমাজ এবং সরকারের দখল নিয়েছে, ভারতেও সেটা হতে পারে। এক দেশ এক ভোট, অভিন্ন দেওয়ানি বিধি, ধর্মস্থান নিয়ে মামলা-মোকদ্দমা... নতুন ভারত ইতিহাসও লিখতে চাইছে নতুনভাবে। কিন্তু ওই যে লোহার রডটা বড্ড লম্বা। তাই কিছুতেই সর্বত্র তাপটা পৌঁছতে পারছে না। সেরকমটা না হলে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের শতবর্ষে পৌঁছে হিন্দুরাষ্ট্রের স্বপ্নও হয়তো সফল হয়ে যেত।
তাই সময় এসেছে সতর্ক হওয়ার। মৌলবাদ কিংবা ধর্মীয় বিভাজন, নাম যাই হোক না কেন, তার মারের ওজন ভয়াবহ। হাসিনা সরকারের পতন সত্যিই হয়তো চেয়েছিল বাংলাদেশ। শিকেয় তুলে রাখা নির্বাচন, কিংবা বঙ্গবন্ধুর নাম ব্যবহার করে সর্বত্র দুর্নীতি। উন্নয়নের যাবতীয় ছবি মানুষের মন থেকে মুছে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। সেটা কিন্তু এক-দু’দিনে হয়নি। বছরের পর বছর এই ধারাতেই বয়েছে বাংলাদেশের রাজনীতি। আর সেই সুযোগটাই পুরোদমে নিয়েছে সমাজের কট্টরপন্থী অংশ। এখন দেখলে মনে হয়, পুরো দেশটাকেই যেন মগজধোলাই মেশিনের ভিতরে ভরে ‘সাইজ’ করা হয়ে গিয়েছে। যে নতুন প্রজন্ম জাতপাতের ঊর্ধ্বে উঠে বিশ্বভ্রাতৃত্বের কথা বলে, তাদের মুখেই এখন মৌলবাদের স্টিকার মারা। যে বঙ্গবন্ধু তাদের স্বাধীনতার কারিগর, বাংলাদেশ থেকে মুছে যেতে বসেছেন তিনিই। যতক্ষণ এই কাজটি কমপ্লিট হচ্ছে, বাংলাদেশের এই প্রজন্মের যেন স্বস্তি নেই! যে ভারত নিত্য গণহত্যা, কট্টরপন্থা, প্রতিদিন খুন হতে থাকা মানবিকতা থেকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানকে মুক্তি দিয়েছিল, তারাই এখন শত্রু! কারণ কী? ইন্ডিয়া বড্ড বেশি নাক গলায় তাদের দেশে? সাম্প্রতিক একটি সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, বাংলাদেশের ৫৯ শতাংশ মানুষ নাকি পাকিস্তানকে পছন্দ করেন। সত্যিই... ইন্দিরা গান্ধীর খেয়েদেয়ে কাজ ছিল না। বাংলাদেশকে স্বাধীন করতে গিয়েছিলেন। চেয়েছিলেন নিজের পায়ে দাঁড়
করাতে। তারাই এখন ভারতের ‘অঙ্গহানি’ করতে উঠেপড়ে লেগেছে। কখনও টার্গেট করছে শিলিগুড়ি করিডর, কখনও উত্তর-পূর্ব ভারত, আবার কখনও নিশানায় সরাসরি কলকাতা। মুক্তি পাচ্ছে ফাঁসির সাজা পাওয়া দাগি জঙ্গিরা। ধুঁকতে থাকা জঙ্গি সংগঠনগুলো আবার উঠে দাঁড়াচ্ছে। আর সেইসঙ্গে জঙ্গি অনুপ্রবেশ বাড়ছে ভারতে।
স্বাধীনতার আগে, অর্থাৎ অবিভক্ত বাংলার হিসেব ধরলে তখন ওই বাংলাদেশ অঞ্চলে হিন্দু জনসংখ্যা ছিল ২৮ শতাংশ। এখন সেটাই নেমে গিয়েছে ৮ শতাংশে। আর আজ এই সংখ্যাটা প্রতিদিন কমছে। অনুপ্রবেশ ঘটছে ভারতে। কেউ কেউ আবার নানাবিধ উপায়ে পালিয়ে যাচ্ছে পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলিতে। ইসলামিক রাষ্ট্র হলেও সেখানে কাজ করতে অসুবিধা হয় না। নিয়মের বেড়াজাল থাকে, তবে তা ধর্মের নামে প্রাণঘাতী নয়। একটা বিষয়ই শুধু দেখার, কোনও অবস্থাতেই যেন পাকিস্তানে যেতে না হয়। ওই একটি দেশ, যেখানে সংখ্যালঘু অধিকার বাংলাদেশের থেকেও অনেক বেশি অবহেলিত। গোটা দেশে মাত্র দুই শতাংশ হিন্দু। কিন্তু তাদের প্রতিদিন লড়তে হয় বেঁচে থাকার জন্য। অস্তিত্ব বাঁচিয়ে রাখার জন্য। কট্টরপন্থা এবং মৌলবাদের ঝাঁঝ এমনই। একটি মাত্র নোয়াখালির দাঙ্গা অধুনা বাংলাদেশের হিন্দু জনসংখ্যা ২০ শতাংশ ছেঁটে দিয়েছে। কলেজ বিল্ডিংয়ে লুকিয়ে থাকা ১২ বছরের মেয়েটি দেখেছে, কীভাবে ইসলামের নামে পথেঘাটে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে অমানুষরা। খুন হচ্ছে অসহায় বৃদ্ধ, রাস্তায় পড়ে কাতরাচ্ছে ধর্ষিতা নারী। কৈশরের গণ্ডিতেও প্রবেশ না করা মেয়েটির ওইসব দেখার কথা নয়। তাও সে দেখেছে। সাত মাসের ছোট্ট বোনটি কেঁদে উঠলে বাবাকে সে বলতে শুনেছে, ওকে মেরে ফেলব। তাহলে আমাদের এতগুলো প্রাণ বাঁচবে। কয়েকটা দিন, একটা ঘটনাক্রম এক ঝটকায় ওই নাবালিকাকে বুড়িয়ে দিয়েছিল। মনে তার প্রশ্ন ছিল একটাই—এই কি ধর্ম? তাহলে এমন ধর্মের প্রয়োজন নেই। ৭৫ বছর পর... ২০২১ সালে আবার ফিরেছিল সেই স্মৃতি। কুমিল্লার নানুয়া দিঘির পাড় পুজো প্যান্ডেলে রেখে যাওয়া কোরাণ শরিফ উস্কে দিয়েছিল সংঘর্ষের আগুন। মন্দির-প্রতিমা ভাঙচুর, হিন্দুদের বাড়িতে হামলা, আগুন... কারণ ছিল একটাই—ধর্মীয় বিভাজন। এরপরও কি আমাদের চোখ খুলবে না? এরপরও স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী জনসভায় দাঁড়িয়ে মঙ্গলসূত্র বিকিয়ে যাওয়ার ভয় দেখান। সংখ্যালঘুদের হাতে সব সম্পত্তি চলে যাবে বলে হুঁশিয়ার করেন। কীসের লক্ষ্যে? ভোট ছাড়া অন্য কিছু তো নয়! হিন্দুত্ববাদী নেতা হওয়ার জন্য কি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে প্রতিপক্ষ হিসেবে খাড়া করতে হয়? হয়তো তাই। নরেন্দ্র মোদি অন্তত সেরকমই মনে করেন। আর তাই সরসঙ্ঘ প্রধান মোহন ভাগবতকে পর্যন্ত বলতে হয়, যেখানে সেখানে মসজিদ দেখলেই মন্দির ইস্যু তোলাটা সাম্প্রদায়িক শত্রুতার প্রকাশ। ভাগবতের নিশানা যে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন বিজেপি এবং যোগী আদিত্যনাথ, সে ব্যাপারে সংশয় নেই। কেন এই ড্যামেজ কন্ট্রোল? মোদি-যোগী যা বুঝতে পারছেন না, সেটাই কি উপলব্ধি হচ্ছে সঙ্ঘের? তিনি কি আশঙ্কা করছেন যে, উগ্র বিভাজনের রাজনীতি দলের পায়ের তলা থেকে মাটি আলগা করে দিচ্ছে? নাকি বাংলাদেশ তাঁকে ভাবিয়েছে?
বাংলাদেশ আজ জ্বলন্ত উদাহরণ হয়ে আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে। আমাদের বহু বাঙালির ভিত ওই দেশে। নাড়ির টান ছেঁড়েনি এখনও। তাই বাংলাদেশে বিপর্যয় হলে তা আমাদের মন ছুঁয়ে যায়। প্রতিনিয়ত। তারপরও আমরা শিখি না। ধর্মের নামে বিভাজনের আগুনে হাওয়া দিতে থাকি। যে আধার হওয়া উচিত ছিল আমাদের শক্তি, সেটাই হয়ে দাঁড়ায় দুর্বলতা। সেই সুযোগই নেয় রাজনীতির কারবারিরা। তাই এই দেশে বাবরি সৌধ ধ্বংস হয়। সবরমতী-গোধরা হয়ে ওঠে ভোটের অস্ত্র। রামমন্দিরের নামে রাজনীতি করে ক্ষমতার অলিন্দে প্রবেশ ঘটে। জ্ঞানবাপী, সম্ভল, আজমির... ধর্ম পালনের অধিকার বারবার ধাক্কা খায়। সেই ফর্মুলাতেই জ্বলে ওঠে ইভিএমের আলো। তারপরও আমরা শিখি না। বাংলাদেশকে দেখেও না।
উস্তাদ জাকির হুসেন তবলাতেই শিব ঠাকুরের ডমরুর বোল তুলতেন। বলতেন, ওই ডমরু থেকেই তো তালবাদ্যের আবিষ্কার। আর সেই আবিষ্কার কে করেছিলেন? গণেশ ঠাকুর। তাই জাকির হুসেনের তবলায় শোনা যেত মহাদেবের ডমরুর সঙ্গে শঙ্খধ্বনির এক মোহময়ী ফিউশন। উস্তাদ বিসমিল্লা খাঁ সাহেব মঞ্চে বসে বলতেন, ‘মৌলবী সাহেব কোরাণ পড়েন। পণ্ডিতজি গীতা। যাজক যিশু বন্দনা করেন। প্রত্যেকে ওই এক উপরওয়ালার ইবাদত করছেন। ধরন আলাদা। কিন্তু সঙ্গীত? দুনিয়ার কেউ দেখাতে পারবে, সা রে গা মা পা ধা নি সা’র বাইরে আর একটাও সুর আছে? তাই তো এখানে কোনও জাতপাত নেই। ধর্ম নেই। সব ধর্মই এখানে এসে শেষ হয়। আর সঙ্গীতের থেকে বেশি পবিত্র প্রার্থনার উপায় কীই বা আছে?’ ভারত আর বাংলাদেশকেও তো সঙ্গীতই বেঁধে রেখেছে। বেঁধে রেখেছেন রবি ঠাকুর। তাঁরই লেখনি বেয়ে নেমে আসা সুর ও স্বর জাতীয় সঙ্গীত হয়ে ভেসে চলেছে এই দুই দেশের আকাশে। কাজী নজরুল ইসলামকে নিয়ে যে চর্চা বাংলাদেশে হয়েছে, তা এপার বাংলাতেও যে হয়নি। সেই বাংলাদেশই আজ ধুলোয় মিশিয়ে দিচ্ছে সংস্কারকে। সংস্কৃতিকে। ভেঙে পড়ছে একের পর এক সৌধ। আর তার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা ইতিহাস, আত্মীয়তা, সুর। ধর্মের রাজনীতিতে অন্ধ হয়ে বাংলাদেশ আজ মারতে শুরু করেছে। কিন্তু এ তো সূচনা মাত্র! এই মোহের বশে যে মারে, তাকে তো মরতেও হয়। আজ না হোক কাল। এটাই যে জগতের ব্যালান্স। যে বুঝবে, সে বাঁচবে। আর যে বুঝেও বুঝবে না? সতর্ক হবে না? বাংলাদেশ কিন্তু খুব দূর নয়!