অর্থকর্মের ক্ষেত্রে প্রগতি বজায় থাকবে। মরশুমি দ্রব্যের ব্যবসায় লাভ বাড়বে। শরীর-স্বাস্থ্য এক প্রকার থাকবে। ... বিশদ
বাংলাদেশে তাণ্ডবলীলা চালানোর পিছনে যে মৌলবাদীরা রয়েছেন, তাতে কোনও সংশয় নেই। তবে অনেকেই বলছেন, এর পিছনে আছে ইউনুস সরকারের মদত। কেন এই অভিযোগ? হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের প্রথম কারণ ছিল কোটা প্রথার বিলোপ। আন্দোলনকারীদের সেই দাবি মেনে নিয়েছিলেন হাসিনা। তাতেও আন্দোলন থামেনি। বলা হয়েছিল, ‘স্বৈরাচারী’ হাসিনা পদত্যাগ করলেই বাংলাদেশের মানুষের যাবতীয় দুঃখ, দুর্দশা ঘুচবে। বাংলা তখনই হবে ‘সোনার বাংলা’।
হাসিনা দেশ ছাড়লেন। তৈরি হল তদারকি সরকার। সেই সরকারের সমন্বয়ক হলেন বাংলাদেশের তথাকথিত ‘তরুণতুর্কি’ ছাত্রনেতারা। আর সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হলেন মহম্মদ ইউনুস। নোবেলজয়ী এবং তাঁর সরকারকে ঘিরে আন্দোলনকারীদের আবেগ তখন আকাশ ছুঁয়েছে। ইউনুস সাহেবের গুণকীর্তনে মশগুল বাংলাদেশ। তাঁর পুরস্কার প্রাপ্তির লম্বা লিস্ট, আর ভালো করে গোঁফ না বেরনো সমন্বয়কদের ‘দীপ্ত পদচারণা’র লাইভ টেলিকাস্টের খণ্ডচিত্রে উপচে পড়ল সোশ্যাল মিডিয়ার পেজ। বাংলাদেশ তখন সোনার বাংলার স্বপ্নে বিভোর।
তারপর দিন যত যাচ্ছে, বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ তত ভালো করে বুঝতে পারছে, টকের জ্বালায় পালিয়ে গিয়ে তারা বাসাটা বেঁধেছে তেঁতুলতলায়। তদারকি সরকার গঠনের পর দিন যাচ্ছে, মাস যাচ্ছে, কিন্তু বাংলাদেশের হাল ফিরছে না। উন্নতি তো দূরের কথা, অবনতিই হচ্ছে দিন দিন। বাড়ছে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম। যে চাকরির গাজর ঝুলিয়ে হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে ছাত্র-যুবদের খ্যাপানো হয়েছিল, তাতেই জল ঢেলে দিয়েছেন ইউনুস সাহেব। তাঁর কথায়, ‘চাকরি হল দাসত্ব। মানুষ হচ্ছে উদ্যোক্তা।’
মোহভঙ্গ হচ্ছে বাংলাদেশের ছাত্র-যুবর। শুরু হয়েছে তদারকি সরকারের সমালোচনা। পরিস্থিতি বদলাচ্ছে বুঝতে পেরে হাসিনাপন্থীরা তদারকি সরকারের বিরুদ্ধে রাস্তায় নামলেন। অনেকেই বলতে লাগলেন, এর চেয়ে হাসিনাই ভালো ছিলেন। হাসিনাও কখনও ভিডিও, কখনও অডিও বার্তা দিয়ে আওয়ামি লিগের সদস্যদের চাঙ্গা করতে লাগলেন। তাতে সেদেশের হিন্দুরাও পেলেন অক্সিজেন। অত্যাচারের প্রতিবাদে পথে নামলেন হিন্দুরাও। দিকে দিকে শুরু হল প্রতিবাদ। সেই সব মিছিল আড়ে ও বহরে বাড়তে লাগল। পথেঘাটে শুরু হল দুই সরকারের তুল্যমূল্য বিচার। সেসব থেকে নজর ঘোরাতেই আঁটা হল বিভাজনের ফন্দি। শুরু হল হিন্দুদের উপর মৌলবাদীদের লাগামছাড়া অত্যাচার।
ইউনুস সাহেব খুব ভালো করেই জানেন, সংখ্যালঘু হিন্দুদের উপর অত্যাচারের ‘লাইসেন্স’টা দিলে এক ঢিলে দু’টি পাখি মরবে। কেউ সরকারের দিকে আঙুল তোলার সাহস পাবে না। আবার মৌলবাদীরাও মেতে থাকবে লুটপাট, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগের লীলায়। আর যতদিন এই উত্তেজনা জিইয়ে রাখা যাবে ততদিন হাসিনাও দেশে ফেরার কথা ভাবতে পারবেন না। তাই গৃহযুদ্ধ পরিস্থিতির জন্য বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশের মুখ পুড়লেও ইউনুসের কুর্সি নিয়ে টানাটানি আপাতত বন্ধ। সেই সুযোগে তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা সমস্ত অভিযোগ ঘাড় থেকে নামিয়ে ফেলার কাজটাও তিনি নিশ্চিন্তে সেরে ফেলতে পারবেন।
ভারতবর্ষের উপর বাংলাদেশের নির্ভরতা নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই। ভারত ‘টিট ফর ট্যাট’ নীতি নিলে লড়াই তো দূরের কথা, বাংলাদেশ উঠে দাঁড়ানোর সুযোগটুকুও পাবে না। খাদ্য ও বিদ্যুতের সাপ্লাই লাইন বন্ধ করে দিলে সেদেশে যে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হবে, তা সামাল দেওয়ার ক্ষমতা নোবেলজয়ীর নেই। তা সত্ত্বেও ভারত এখনই সেই রাস্তায় যাচ্ছে না। আলোচনার মাধ্যমে সমাধান চাইছে। ভারতবর্ষের এই সহিষ্ণুতাকে বাংলাদেশের মৌলবাদীরা ‘দুর্বলতা’ বলে ভুল করছে। তাই তাঁদের কেউ বাংলা, বিহার, ওড়িশা দখলের হুঙ্কার ছাড়ছেন, কেউ দিচ্ছেন আগরতলা অভিযানের ডাক।
বাংলাদেশে নির্বাচন কবে হবে, তার ঠিক নেই। তবে, রাজনৈতিক জমি তৈরির কাজটা শুরু করে দিয়েছে বিএনপি। তারা রীতিমতো সাংবাদিক সম্মেলন করে যুদ্ধের হুমকি দিয়েছে। বাংলাদেশ সামরিক শক্তিতে কতটা পিছিয়ে আছে সেটা বোঝা যাচ্ছে, ভারতের মোকাবিলা করার জন্য নাগরিকদের বন্দুক চালানোর প্রশিক্ষণ দেওয়ার ঘোষণায়। বিএনপি নেতৃত্ব নাকি অ্যাকশনের জন্য প্রস্তত! তাই তারা কথা বলে সময় নষ্ট করতে চাইছে না। তবে সৌভাগ্যের বিষয় হল, বাংলাদেশের মৌলবাদীদের ও বিএনপি নেতৃত্বের হুঙ্কারকে এদেশের কেউই তেমন সিরিয়াসলি নিচ্ছেন না। বেশিরভাগ মানুষ হাসি মস্করা করেই উড়িয়ে দিচ্ছে। অবশ্য মৌলবাদীদের হুঙ্কারের যোগ্য জবাব দিচ্ছেন এ রাজ্যের মুসলিম ধর্মীয় গুরু ও রাজনৈতিক নেতারাই।
ফুরফুরা শরিফের পীরজাদা ত্বহা সিদ্দিকি বলেছেন, ‘বাংলাদেশ, পাকিস্তান বা অন্য কোনও দেশ ভারত দখল তো দূরে থাক, ভারতের একমুঠো মাটিও যদি নিতে আসে তাহলে হাত কেটে দেব।’ ভরতপুরের তৃণমূল কংগ্রেসের বিধায়ক হুমায়ুন কবীর তো বাংলাদেশের মৌলবাদীদের হুঙ্কারকে ‘পাগলের প্রলাপ’ বলে উড়িয়ে দিয়েছেন। তাঁর কথায়, বাংলাদেশের মোকাবিলা করার জন্য ভারতবর্ষ বা বাংলার প্রয়োজন হবে না, মুর্শিদাবাদ জেলা একাই কাফি। এভাবেই রাজ্যের সমস্ত মুসলিম নেতা বুঝিয়ে দিয়েছেন, তাঁদের কাছে দেশের স্বার্থ ও সার্বভৌমত্ব সবার আগে। আর তাতেই বাংলাদেশি মৌলবাদীদের ভারতে অশান্তি পাকানোর চক্রান্ত মাঠে মারা যাচ্ছে।
যে কোনও আন্দোলন বা বড় ঘটনার মূলত দু’রকমের প্রভাব থাকে। এক, আর্থ-সামাজিক। দুই, রাজনৈতিক। সাধারণভাবে সেই প্রভাব ভৌগোলিক সীমানার মধ্যেই আবদ্ধ থাকে। কিন্তু বাংলাদেশের অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতির প্রভাব ভারতবর্ষেও পড়ছে। বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা ও অসমে। তবে, সবচেয়ে বেশি বাংলায়।
বছর খানেক পরেই এরাজ্যের বিধানসভা নির্বাচন। সন্দেশখালি, আর জি কর ইস্যু আগেই বিরোধীদের হাতছাড়া হয়েছে। তাই বাংলাদেশের ঘটনা বঙ্গ বিজেপির কাছে পড়ে পাওয়া আঠারো আনার সমান। বাংলাদেশে মৌলবাদীরা হিন্দুদের উপর অত্যাচার শুরু করতেই বঙ্গ বিজেপি মেরুকরণের রাজনীতি করতে নেমে পড়েছে। গরম গরম ভাষণ দিয়ে বিভাজনের রাস্তা প্রশস্ত করতে চাইছে। কিন্তু পারছে না। কারণ এটা রবীন্দ্রনাথ-নজরুলের মাটি। নজরুল ইসলাম লিখেছিলেন, ‘মোরা একই বৃন্তে দু’টি কুসুম হিন্দু- মুসলমান। মুসলিম তার নয়ন-মণি, হিন্দু তাহার প্রাণ’। তাই বিভেদ নয়, ঐক্যই আমাদের মূলমন্ত্র। আর রবীন্দ্রনাথ আমাদের সতর্ক করে বলেছিলেন, ‘ধর্মের বেশে মোহ যারে এসে ধরে/ অন্ধ সে জন মারে আর শুধু মরে।’ তাই আমরা সংঘাত পরিহার করে থাকি পাশাপাশি।
তাঁদের শিখিয়ে যাওয়া মানবতার গান আজও গেয়ে চলেছে বাংলা। তাই তো পশ্চিম মেদিনীপুরের পাথরা গ্রামের মন্দির সংরক্ষণের জন্য দিনপাত করে চলেছেন ইয়াসিন পাঠান। মুসলিম হয়েও প্রশাসনের দরজায় দরজায় ঘুরে ভগ্নপ্রায় মন্দিরগুলিকে রক্ষার ব্যবস্থা করেছেন। তাঁরই প্রচেষ্টায় এই গ্রামের প্রাচীন মন্দিরগুলির দায়িত্ব নিয়েছে ভারত সরকারের ভূ-তত্ত্ব বিভাগ।
এই বাংলার মাটিতে আজও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছেন আসানসোলের ইমাম ইমদাদুল্লাহ রশিদ। ২০১৮ সালের দাঙ্গায় তিনি ১৬ বছরের ছেলে সিবতুল্লাহকে হারিয়ে ছিলেন। আসানসোলের তখন অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি। প্রিয় সন্তানকে হারিয়েও ইমদাদুল্লাহ সাহেব সেদিন শান্তিই চেয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘কোনও প্রতিহিংসা নয়। তাহলে আমি আসানসোল ছেড়ে চলে যাব।’ তাঁর কথা নতমস্তকে মেনে নিয়েছিল আসানসোল। ফিরেছিল শান্তি। তিনি আরও বলেছিলেন, ‘ইসলাম মানে শান্তি। আমরা শান্তিতে থাকলে কোনও অশুভ শক্তি কিছু করতে পারবে না।’
বাংলাদেশের বুকে দাঁড়িয়ে যে সমস্ত মৌলবাদী যুদ্ধের হুঁশিয়ারি দিয়ে অশান্তির আগুন জ্বালাতে চাইছেন তাঁদের একটা কথা বলতে চাই, আপনারা চেষ্টা চালিয়ে যান। কিন্তু হাজারো উস্কানি দিয়েও সফল হবেন না। কারণ আমাদের সঙ্গে আছেন ইয়াসিন পাঠান, ইমদাদুল্লাহরা। আপনাদের সমস্ত ঘৃণ্য চক্রান্ত ভেস্তে দেওয়ার জন্য তাঁরাই যথেষ্ট।