অর্থকর্মের ক্ষেত্রে প্রগতি বজায় থাকবে। মরশুমি দ্রব্যের ব্যবসায় লাভ বাড়বে। শরীর-স্বাস্থ্য এক প্রকার থাকবে। ... বিশদ
যে সে ব্যক্তি নন অধ্যাপক বেহেরা! আইআইটি কানপুরের ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে পুনম এবং প্রভু গোয়েল চেয়ার প্রফেসর হিসেবে কাজ করেছেন। আইআইটি ওয়েবসাইটের তথ্য বলছে, অধ্যাপক বেহেরা রোবট বিশেষজ্ঞ। এমনকী স্মার্ট প্রযুক্তিতে যে আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার হয়, সে বিষয়েও তাঁর বিশেষ জ্ঞান রয়েছে। পড়াশোনা করেছেন আইআইটি দিল্লি থেকে। পরে পোস্ট ডক্টরাল ডিগ্রি সম্পূর্ণ করেন জার্মানির ন্যাশনাল সেন্টার ফর ইনফরমেশন টেকনোলজিতে। যে ভিডিওটি ঘিরে তাঁকে নিয়ে বিতর্ক, সেটি একটি ইউটিউব চ্যানেলে প্রকাশ করেছিলেন লক্ষ্মীধর। তবে সেটি প্রকাশ্যে আসে বা তা নিয়ে বিতর্ক দানা বাঁধে তিনি আইআইটি-র অধিকর্তা হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করার পর।
পাঁচ মিনিটের ভিডিও ক্লিপ। তবু তার মধ্যেই সেদিনের ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ দিয়েছেন আইআইটির প্রফেসর, কী করে স্রেফ ‘হরে রাম হরে কৃষ্ণ’-র মতো পবিত্র মন্ত্র তাঁকে ভূত তাড়াতে সাহায্য করেছিল। কীভাবে বন্ধুর চলচ্ছক্তিহীন বাবা হঠাৎই হাঁটতে শুরু করেছিলেন। সবই জানিয়েছিলেন লক্ষ্মীধর ওই ভিডিওতে। এমনকী ওই ‘সত্যকাহিনি’-র এক জায়গায় তাঁকে এও বলতে শোনা যায় যে, ‘বন্ধুর বাবা, যিনি একজন ছোটখাটো চেহারার মানুষ, তাঁর মাথা হঠাৎই ঘরের ছাদ স্পর্শ করে!’ লক্ষ্মীধর বলেছিলেন, এ সবই ছিল ওই অশুভ আত্মার কাজ। যাকে টানা ৪৫ মিনিট মন্ত্রোচ্চারণ করে তবেই তাড়াতে পেরেছিলেন তিনি। এ ব্যাপারে তাঁর নিয়মিত গীতাপাঠের অভ্যাসও যে কাজে দিয়েছিল, সে কথাও ভিডিওতে বলতে ভোলেননি। তবে ভিডিওটি নিয়ে বিতর্ক শুরু হতেই সেটি ইউটিউব থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল। এ ব্যাপারে লক্ষ্মীধর বলেছিলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি ভূত আছে।’ এহেন অধিকর্তার হাতে পড়লে আইআইটি মান্ডির পঠনপাঠনের অবস্থা যা হওয়ার তাই-ই হয়েছে!
আইআইটি মান্ডি সিদ্ধান্ত নিয়েছে, ‘পুনর্জন্ম’, ‘মৃত্যুর কাছাকাছি সময়ে নিজের শরীরের বাইরে থাকার অভিজ্ঞতা’ এবং ‘সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম শরীরের ধারণা’ প্রভৃতি বিষয়ে ৬ মাসের একটি আবশ্যিক কোর্স সকল পড়ুয়াকে পড়তে হবে। ‘প্রাচীন ভারতীয় জ্ঞান ব্যবস্থা’র নামে জাতীয় শিক্ষানীতি-২০২০ তে নতুন যেসব বিষয় যুক্ত হয়েছে এটি তারই অন্তর্ভুক্ত। ২০২২ থেকে এইসব বিষয় পড়ানোর প্রবল প্রচেষ্টা চলছে সর্বত্র। সরকার থেকে প্রভূত অর্থ দেওয়া হচ্ছে এই ইন্ডিয়ান নলেজ সিস্টেমস কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা আর তার গবেষণায়। ২০২৩ থেকে এসব পড়ানোর ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ামক সংস্থা (ইউজিসি) থেকে সুনির্দিষ্ট রূপরেখাও করে দেওয়া হয়েছে। ক্যাম্পাসের ভিতরের খবর, বিষয়টি ডিরেক্টর লক্ষ্মীধর বেহেরার পছন্দ করা। গত বছর বিষয় ছিল ‘মাংস খাওয়া আর ভূমিধসের সম্পর্ক’। লক্ষ্মীধর বেহেরা বলেছিলেন, ‘মানুষ মাংস খায় বলেই হিমাচলের মেঘ বিস্ফোরণ, ভয়াবহ ধসের ঘটনা ঘটছে।’ আমরা জানি ঘটনার সঙ্গে সম্পর্কহীন বিষয়কে যখন সম্পর্কযুক্ত দেখানোর চেষ্টা হয়, তখন সেটা অবশ্যই কুসংস্কার। তাই বিষয়টি শিক্ষার্থী মহলে প্রবল সমালোচিত হয়। ফলে এবার বিষয় বদল!
‘বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়’-এর কথাই ধরুন। ‘ভূতবিদ্যা’ বিষয়ে এবছর ছ’মাসের একটি সার্টিফিকেট কোর্স শুরু করেছে এই প্রখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়। কাদের জন্য জানেন? আয়ুর্বেদ ও অ্যালোপ্যাথ ডাক্তারদের জন্য। এই অলৌকিক বিষয়ে পড়ে ভাবী কালের ডাক্তাররা নাকি মনোচিকিৎসায় তার প্রয়োগ ঘটাবেন। ডাক্তারি পড়ানোর সঙ্গে যুক্ত ১৬টি বিভাগের প্রধানরা একমত হয়ে নাকি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আসলে সাত হাজার বছর আগেকার ভারতীয় উড়োজাহাজ, সুদর্শন চক্র যে আদতে দূরনিয়ন্ত্রিত ক্ষেপণাস্ত্র, সঞ্জয় কর্তৃক কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের সরাসরি সম্প্রচার, গণেশের মাথায় প্লাস্টিক সার্জারি, সুপ্রাচীন ভারতে টেস্টটিউব বেবি— এইসব এবং আরও অনেক হাস্যকর উদ্ভট অপবিজ্ঞানের ঢক্কানিনাদে হারিয়ে যাচ্ছে প্রাচীন ভারতে বিজ্ঞানচর্চার দীর্ঘ ঐতিহ্যের গৌরবময় গাথা। একসময় কুসংস্কারের মধ্যে সব সময় ব্যক্তিস্বার্থ জড়িয়ে থাকত না। এখন স্বার্থ থেকেই কুসংস্কারের উদ্ভব। অপবিজ্ঞান ও কুযুক্তির সমাহারে তাকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলা হয় এবং মানুষ ঠকানোর কাজে লাগানো হয়।
ভাবুন একবার, গোবর এবং গোমূত্র থেকে কি টেকসই এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য তৈরি করে কৃষক সমাজের অর্থনৈতিক উন্নয়নের গবেষণায় মগ্ন আইআইটি (বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়)-এর গবেষকরা। তাঁরা মনে করছেন, গবেষণা সফল হলে নাকি বদলে দেওয়া যাবে গ্রামীণ ভারতের অর্থনৈতিক চালচিত্র। সাম্প্রতিক গবেষণা, ‘সায়েন্টিফিক ক্যারাকটারাইজেশন মেথডস ফর বেটার ইউটিলাইজেশন অফ ক্যাটল ডাং অ্যান্ড ইউরিন: এ কনসাইস রিভিউ’-য়ে তেমনই দাবি করা হয়েছে। ভারত সরকারের বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তি মন্ত্রক এই প্রকল্পে বিপুল আর্থিক সহায়তা দিয়েছে। বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, গোরুর গোবর এবং গোমূত্রের ‘প্রোফাইলিং’-এর মাধ্যমে প্রাচীন তথা প্রচলিত গ্রামীণ ধ্যানধারণাকেও বৈজ্ঞানিক মানদণ্ডে অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব। যা আগামী দিনে গোবর এবং গোমূত্র থেকে তৈরি দাঁতের মাজন, কেশতৈল, শ্যাম্পু, কন্ডিশনার প্রভৃতির অর্থনৈতিক প্রগতির পথ প্রশস্ত করতে পারে।
দার্শনিক দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের ‘সায়েন্স অ্যান্ড ফিলোসফি ইন অ্যানসিয়েন্ট ইন্ডিয়া’ একটি আকর গ্রন্থ। ইউরোপীয় ইতিহাসবিদদের মতে প্রাচীন গ্রিসের থালেস (খ্রিস্ট পূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দী) ছিলেন পৃথিবীতে বিজ্ঞানের পথপ্রদর্শক। সেই মত যুক্তির সাহায্যে খণ্ডন করে দেবীপ্রসাদ দেখিয়েছেন, সেই গৌরব প্রাপ্য ভারতীয় চিন্তক উদ্দালক-আরুণির। ছান্দোগ্য উপনিষদের সাহায্য নিয়ে দেবীপ্রসাদ প্রমাণ করেন, কণাদেরও আগে পরমাণুর প্রাথমিক ধারণাও উদ্দালক-আরুণিই দিয়েছিলেন। সৃষ্টির মূলে দেবতা, আত্মা ইত্যাদির ভূমিকা নস্যাৎ করে উদ্দালক ঘোষণা করেন মহাবিশ্বের সব কিছুই তাপ (তেজস), জল (অপ্) এবং অন্ন থেকে উদ্ভূত। তিনি এও বলেন, মানসের (মন) উৎস অন্ন। আজ থেকে আড়াই হাজার বছর আগের এক দার্শনিকের এই বস্তুবাদী বিশ্লেষণই উদ্দালককে বিশ্বের প্রথম বিজ্ঞানী হিসাবে স্বীকৃতি দেয়। পরবর্তী যুগে ভাববাদী দর্শনের উত্থানে উদ্দালক-আরুণির অবদান হারিয়ে যায় বিস্মৃতির অন্তরালে।
মোদি জমানায় ভারতকে সেই ভাববাদী নিগড়ের অন্ধকারময় অতীতে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা চলছে। আর সেই কারণেই ২০২৪ সালে ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেস বন্ধ করে দেওয়া। ১৯৮৯ সাল থেকে বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণ ও বৈজ্ঞানিক মনন গড়ার কাজ করত যে প্রতিষ্ঠান, সেই ‘বিজ্ঞান প্রসার’-ও বন্ধ হয়েছে ২০২৩-এ। এবার তুলে দেওয়া হল মৌলিক বিজ্ঞান গবেষকদের বার্ষিক পারস্পরিক মতবিনিময়ের জায়গা ‘ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেস’। ১৯১৪ সালে কলকাতায় তৈরি হওয়া ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেস অ্যাসোসিয়েশন ছিল প্রতি বছর জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে এই কংগ্রেসের আয়োজক। ৩০,০০০ এর বেশি বিজ্ঞানী এর সদস্য। প্রথম এই কংগ্রেস হয় ১৯১৪ সালের ১৫-১৭ জানুয়ারি, কলকাতার এশিয়াটিক সোসাইটির প্রাঙ্গণে। সভাপতি ছিলেন আশুতোষ মুখোপাধ্যায়। ২০১৫ সাল থেকে এই মঞ্চ ব্যবহার করে ক্রমাগত অবৈজ্ঞানিক প্রচার চালিয়ে আসছিল দেশের সরকার আর তার পেটোয়া বিজ্ঞানীরা। তাই যশস্বী বিজ্ঞানীরা এখান থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছিলেন। প্রতিবাদও করছিলেন। ফলে অ্যাসোসিয়েশন এই অপবৈজ্ঞানিকতা ছড়ানো বন্ধ করতে কংগ্রেসে বক্তারা কী বলবেন তা আগে থেকে জানানোর নিয়ম হয়। এতে প্রমাদ গোনে অপবিজ্ঞানের প্রচারকরা। তাই প্রথমে চেষ্টা হয় ‘ইন্ডিয়ান সায়েন্স কংগ্রেস অ্যাসোসিয়েশন’-কে দখল করার। তাতে সফল না হওয়ায় কেন্দ্রীয় অর্থ সাহায্য বন্ধ করে এই শতাব্দী প্রাচীন সংগঠন ও তার ঐতিহ্যকে গলা টিপে স্তব্ধ করে দেওয়া হয়েছে। দেশের সরকার মৌলিক জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চা যে চায় না এটা তার এক উজ্জ্বল উদাহরণ। আরও একটা কারণ ‘বিজ্ঞানভারতী’ নামে দেশের শাসকদের মদতপুষ্ট বিজ্ঞান সংগঠনকে জনমানসে জায়গা করে দেওয়া। তাদের অন্যতম কাজ পাশ্চাত্য যুক্তিবাদী চিন্তা চেতনাকে নস্যাৎ ও প্রাচ্যের পরীক্ষা ও প্রমাণহীন বিশ্বাসভিত্তিক অপবিজ্ঞানকে মদত। তাদের নীতি হল ‘সায়েন্স উইথ স্পিরিচুয়ালিটি’। আধ্যাত্মবাদী বিজ্ঞান দর্শনগতভাবে বৈজ্ঞানিক চেতনার পরিপন্থী। ‘সায়েন্স উইথ স্বদেশি স্পিরিট’ তাদের মটো। অথচ, সেই বিজ্ঞানভারতীর নেতৃত্বেই প্রতি বছর দেশের সরকারি দপ্তরগুলির সরাসরি অংশগ্রহণে ‘ইন্ডিয়া ইন্টারন্যাশনাল সায়েন্স ফেস্টিভাল’ অনুষ্ঠিত হচ্ছে। সরকার চাইছে দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের পরম্পরা ও ঐতিহ্যবাহী বিজ্ঞান কংগ্রেস নয়, বিজ্ঞান ভারতীর ফেস্টিভালই প্রতিষ্ঠিত হোক। যেখানে ঐতিহ্যের নামে ভ্রান্ত ইতিহাস, অপবিজ্ঞান— এই সব চর্চার উপর জোর দেওয়া হবে। প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে কেন্দ্রের শাসকদলের নেতাদের কথা থেকেই তা পরিষ্কার। আধুনিক জ্ঞানবিজ্ঞানের পরিপন্থী বিষয়গুলিকে তাঁরা ইন্ডিয়ান নলেজ সিস্টেম বলে প্রচার করছেন। এসবই হিন্দু ধর্মভিত্তিক জাত্যভিমান গড়ে তুলে সংবিধানে ঘোষিত ধর্মনিরপেক্ষ দেশটিকে হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত করার চেষ্টার এক একটি ধাপ। কে এদের বোঝাবে, ধর্মবিশ্বাস মানুষের তত দিনই মঙ্গলসাধন করে, যত দিন না তা অন্ধবিশ্বাসে পরিণত হয়। অন্ধভক্তি আজ সেই বোধটুকুও গ্রাস করে ফেলেছে।
কৃষিপ্রধান ভারতে গোরুর প্রয়োজনীয়তা ছিল অপরিসীম। গোরুকে তাই দেবতার মতো পুজোও করা হতো। আজ গোরুর প্রয়োজনীয়তা কমেছে। অথচ, গুরুত্ব বেড়ে গিয়েছে। তাকেই দেবতা মানা হয়। তাই আজকের দিনে গোরুর রচনা লেখা বোধ হয় ছাত্রদের কাছে কঠিন কাজ। যে গতিতে এবং যে পরিমাণে আমাদের দেশে কুসংস্কার বাড়ছে এবং দেশ ক্রমশ অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে পড়ছে, মনে হয় খুব শীঘ্রই আমরা সবুজ বিপ্লব ও শ্বেত বিপ্লবের পরে কৃষ্ণ বিপ্লবেরও সাক্ষী থাকব!