অর্থকর্মের ক্ষেত্রে প্রগতি বজায় থাকবে। মরশুমি দ্রব্যের ব্যবসায় লাভ বাড়বে। শরীর-স্বাস্থ্য এক প্রকার থাকবে। ... বিশদ
যাঁরা ৩৩ শতাংশ নারী সংরক্ষণের ঢাক পিটিয়েও প্রার্থী তালিকায় কয়েক যোজন দূরে আটকে যান, তাঁরাও সংসদে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বলিয়ে কইয়ে নতুন একঝাঁক ঝকঝকে মহিলা এমপি’র সক্রিয়তা দেখে একান্তে হাততালি দেন। সেখানেও পথ দেখায় বাংলাই। আজও। আপনি সমালোচনা করতেই পারেন, কিন্তু এই সরকারের উদ্যোগেই স্বাস্থ্যসাথী কার্ডটাও হয় ঘরের মহিলা সদস্যের নামে। নারীর সশক্তিকরণ ও মর্যাদা বাড়াতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই উদ্যোগ বাংলার প্রায় সাড়ে ৪ কোটি মহিলা বিলক্ষণ জানে। জানে সওয়া দু’কোটি লক্ষ্মীর ভাণ্ডার প্রাপক। আর জানে বলেই নির্বাচনী আসরে হিসেব কষতে বসে বিভ্রান্তিতে ভোগে বিরোধী রাজনীতিক থেকে তথাকথিত শিক্ষিত শ্রেণি। ভোট এলেই জনসমর্থনের পারদের ওঠানামা মাপতে ভুল হয়ে যায় নিন্দুকদের। আধুনিক ব্যারোমিটারকে হারিয়ে দেয় এক আটপৌরে নেত্রীর আশ্চর্য গ্রহণযোগ্যতার রসায়ন।
ধর্ষককে কড়া শাস্তি দিতে মৃত্যুদণ্ডের আইনও পাশ হয়েছে প্রথম বাংলার বিধানসভাতেই। আর জি কর আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে বিধানসভায় অপরাজিতা বিল পাশ হওয়ার পর বিলম্ব না করেই তা পাঠিয়ে দেওয়া হয় দিল্লিতে। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকারের টালবাহানায় তা আজও ঝুলে। কেন ধর্ষকের জন্য কঠোরতম আইন চালু করতে এত গড়িমসি বিজেপি’র, কোনও উত্তর নেই এখন। টানা তিন বছর একশো দিনের কাজের টাকা আটকে রাখা, আবাসের বরাদ্দ না ছাড়ার মতোই এও বাংলার সঙ্গে সীমাহীন বঞ্চনার আর এক রূপ। বাংলার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র। আরও দুঃখজনক এই কারণে যে যাঁরা বঞ্চনায় মদত দিচ্ছেন তাঁরাই আবার এ রাজ্যে ক্ষমতা দখলের স্বপ্ন দেখছেন। বাংলার মানুষ ছাব্বিশের ভোটে এদের ক্ষমা করবে? প্রায় আড়াই লক্ষ কোটি টাকার ন্যায্য পাওনা আটকে রাখার জবাব কি মিলবে না ভোটযন্ত্রে? কড়ায় গন্ডায় হিসেব বুঝে নেবে না রাজ্যের মানুষ?
কেন্দ্রের শাসক দল যখন বাংলাদেশ ইস্যুতে হাত গুটিয়ে কার্যত দর্শক, তখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকার মাস্টার স্ট্রোক দিয়েছে। বৈদেশিক নীতি নিয়ে সচরাচর আমরা কেউই কথা বলি না। নিঃশর্তভাবে দিল্লির সরকারের পাশে দাঁড়াই। এটাই অলিখিত রীতি রেওয়াজ। বাংলার সরকারও তাই করেছে। কিন্তু যখন দেশের বিজেপি সরকার কী করব কী করব সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে, ’৭১ সালের ইন্দিরা গান্ধীর মতো প্রোঅ্যাক্টিভ ভূমিকা নেওয়ার কোনও ইঙ্গিত চোখে পড়ছে না, তখন দু’একটা কথা বলতেই হয়। বিভাজন সর্বস্ব বঙ্গ বিজেপি সমস্যা সমাধানে জোর না দিয়ে এই সুযোগে পায়ের তলার চোরাবালি সামলে মাটিটাকে একটু শক্ত করার সুযোগ খুঁজছে এপার বাংলায়। এপার বাংলায় হিন্দু ভোট সংগঠিত করাকেই পাখির চোখ করেছে তারা। কারণ কট্টর হিন্দুত্বই বিজেপি’র একমাত্র জিয়নকাঠি। বাকি আর সব ফাঁকা। কিন্তু সেখানেও পালের হাওয়া কেড়ে নিয়ে উপদ্রুত বাংলাদেশে রাষ্ট্রসঙ্ঘের শান্তিবাহিনী পাঠানোর প্রস্তাব নিঃসন্দেহে অভূতপূর্ব। পক্ষে বিপক্ষে নানা মুনি নানা মত দিলেও বাংলার সরকার ও জননেত্রীর এই অবস্থান বর্তমান পরিস্থিতিতে পাক্কা ‘স্টেটসম্যান’ সুলভ। তিনি শুধু নিছকই রাজনীতির ময়দানে প্রস্তাবটা দেননি। কথাটা বলেছেন রাজ্য বিধানসভায় দাঁড়িয়ে। তাই ভোট রাজনীতির হিসেবনিকেশ বাদ দিয়ে দিল্লির কর্তাদের বিষয়টি দেখা উচিত অত্যন্ত সচেতনভাবে। যদি সদিচ্ছা থাকে!
তাই বলি, যতই সমালোচনা করুন, তাঁর গান, ছবি, কবিতা নিয়ে কটাক্ষ বর্ষণ চালিয়ে যান, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে পদে পদে রাজনীতিটা শিখতে হবে এই বঙ্গের বিরোধীদের। বিরোধী নেত্রী হিসেবে শুরু করে কী সরকারে কী দলীয় রাজনীতিতে একটার পর একটা ইস্যুকে নিষ্ক্রিয় করার দৌড়ে গত চার দশকেরও বেশি সময় তিনি অপ্রতিরোধ্য, অপ্রতিদ্বন্দ্বী। টানা তিন মাস আর জি কর নিয়ে আন্দোলনের সময় বিজেপি হারিয়ে গিয়েছিল। বলা হচ্ছিল, ওটা নাকি গেরুয়া সিলেবাসের বাইরে। আর প্রতিবেশী বাংলাদেশ যখন ক্রমেই অশান্ত হচ্ছে এবং হিন্দুত্ব গত একশো বছরের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জের মুখে তখন এ রাজ্যের বামপন্থীরা শূন্য থেকেও আরও গহিন অন্ধকারে তলিয়ে যাওয়ার আতঙ্কে ভুগছে। সম্ভবত গত শতকের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জের মুখে হিন্দুত্ব। প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, বিগত এক দশক দিল্লিতে তথাকথিত হিন্দু সরকার রাজ করলেও পড়শি রাষ্ট্রের এমন সাম্প্রদায়িক ষড়যন্ত্রের কথা আঁচও করতে পারেনি কেন? দীর্ঘ ৫৩ বছর পর আবার বাংলাদেশ ধীরে ধীরে মৌলবাদী পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণে চলে যাচ্ছে। এটা আমাদের গাফিলতি না ব্যর্থতা, বলতে পারব না। ওই যে বলেছি, বিদেশ নীতি নিয়ে বেশি কাটাছেঁড়া চলে না। কূটনৈতিক সৌজন্যে বাধে। কিন্তু এই কঠিন সময়ে আরএসএস প্রধান যখন বলেন, দেশে হিন্দুদের সংখ্যা বাড়াতে একটি নয়, দু’টিও নয়, দম্পতি পিছু তিনটি সন্তান জরুরি তখন সন্দেহ জাগে। আসল উদ্দেশ্য সমস্যার সমাধান নাকি হিন্দু-মুসলিম বিভাজনের উনুনে তা দিয়ে নির্বাচনী রাজনীতিতে কিস্তিমাত করা। বাংলাদেশে হিন্দুদের উপর নিপীড়ন ও অত্যাচার নিয়ে যতটা না চিন্তা তার চেয়েও বড় টার্গেট সেই বিভাজনকে ব্যবহার করে বাংলায় ঘোলা জলে মাছ ধরা। পূর্ব ভারতে একের পর এক রাজ্য গেরুয়া শাসনে এলেও বাংলায় জননেত্রীর কাছে মোদি-অমিত শাহ বারে বারে পরাজিত হয়েছেন। একুশে, চব্বিশে...ছাব্বিশের দেওয়াল লিখনও স্পষ্ট পড়া যাচ্ছে। বাংলাদেশের হিন্দু নিপীড়নকে প্রধান মুদ্দা বানালেও আগামী সওয়া এক বছর পরের বিধানসভা ভোটে তা থেকে ফায়দা তোলার চক্রান্ত সফল হবে না। কারণ এ রাজ্যের সংখ্যালঘুরা তাঁদের প্রকৃত বন্ধুকে যেমন চেনে তেমনি একটা বিরাট শিক্ষিত প্রগতিশীল অংশের হিন্দু জানে, হানাহানির মাধ্যমে কোনও সভ্য সমাজ গড়ে তোলা সম্ভব নয়। সামাজিক কাঠামোকেই তা আরও দুর্বল করে। উন্নয়নকে পিছনে ঠেলে। সেই যন্ত্রণা আমাদের পূর্ব পুরুষরা দশকের পর দশক ভুগেছে। এখনও দেশভাগের দগদগে স্মৃতি বয়ে বেড়াচ্ছেন অনেকে। বাড়ি ঘর ছেড়ে আসার স্মৃতি পুরোটা মুছে যায়নি। তাই হিন্দু মুসলমান বিভাজনের বিষ বয়ে চলার ভুল আবার বাঙালি করবে বলে মনে হয় না। বিজেপি’রও বাংলাদেশের জুজু দেখিয়ে এপার বাংলায় সংগঠন বিস্তারের স্বপ্ন কিংবা দুঃস্বপ্ন যাই বলুন আগামীতে আরও একবার মুখ থুবড়ে পড়বে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জনমুখী, গরিবের পাশে দাঁড়িয়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ২৪×৭ রাজনীতির সামনে।
পরিশেষে একটা কথাই বলি, আবার আমরা বছরের শেষ অঙ্কে উপনীত হয়েছি। বাতাসে হিমেল স্পর্শ জানান দিচ্ছে ডিসেম্বর সমাগত। কয়েকদিন পরই নতুন বছর। ২০২৫। শুধু একটাই আবেদন সবার কাছে অযথা বিনা কারণে বাংলার বদনাম করবেন না। ওতে শুধু আপনারই ক্ষতি নয়, পরবর্তী প্রজন্মেরও লোকসান। বাংলায় অনেক কিছু হচ্ছে। যা ভালো হচ্ছে সেটাও বলুন। শুধু নেগেটিভ প্রচারে কোনও সমাজ লাভবান হতে পারে না। আর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বারবার জিতে যান কারণ তিনি নিজের শক্তির চেয়েও বাংলার মানুষের সম্মিলিত শক্তিকে বেশি গুরুত্ব দেন। আমরা সবাই সেটা করলে আখেরে লাভ হবে বাংলারই। উচ্চস্বরে বলতে পারব, এগিয়ে বাংলা।