অর্থকর্মের ক্ষেত্রে প্রগতি বজায় থাকবে। মরশুমি দ্রব্যের ব্যবসায় লাভ বাড়বে। শরীর-স্বাস্থ্য এক প্রকার থাকবে। ... বিশদ
বাড়িতে যে সোনা আছে, সেটা ব্যাঙ্কে বন্ধক রেখে সেই অনুযায়ী লোন নিলে সুদের হারটাও কম দিতে হয়। টাকাটাও হাতে আসে। মূল্যবৃদ্ধির এই বাজারে এর মতো বিশল্যকরণী আর কিছু নেই। একটা মধ্যবিত্ত পরিবারে বাজার খরচ, ছেলেমেয়ের পড়াশোনা, বিয়ে বা জন্মদিন বাড়ির মতো লৌকিকতা, যাতায়াত ভাড়া, রোজকার টিফিন খরচার মতো ব্যয়ের বহর লেগেই থাকে। সেই সবকিছুর খরচ প্রতিদিন, নানা ছুতোয় বাড়ে। থমকে থাকে শুধু উপার্জন। গত এক বছরে খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে, সব লৌকিকতাই শিকেয় তুলে রাখতে হয়েছে আম জনতাকে। পেটে খেলে তো পিঠে সইবে! সোনা বাড়িতে রেখে লাভ কী, যদি পেটের ভাতই না জোটে! তাই বন্ধক রেখে টাকা নেওয়া ছাড়া গতি নেই মধ্যবিত্তের। সরকার অবশ্য মূল্যবৃদ্ধির সমীকরণ মানতে রাজি নয়। অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামনের নেতৃত্বে নরেন্দ্র মোদির বাকি মন্ত্রী ও সচিবরা লাগাতার মূল্যবৃদ্ধির বিরুদ্ধে ঢাল-তরোয়াল নিয়ে প্যাঁচ কষে চলেছেন। গোঁ ধরে রয়েছে শুধু রিজার্ভ ব্যাঙ্ক। খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি না কমলে তারা রেপো রেট কমাবে না। ছাড়বে না মোদি সরকারও। রেপো কমালে কেন্দ্রের লাভ কী? মোদি সরকার মনে করছে, ব্যাঙ্কগুলিকে আরবিআই যে সুদে ঋণ দেয়, তার অঙ্ক কমলে বিভিন্ন ব্যাঙ্কও ঋণের সুদ কাটছাঁট করবে। তাতে লোন নেবে উৎপাদন ক্ষেত্রগুলি। তারা বেশি বেশি পণ্য তৈরি করবে। অনেক কর্মসংস্থান হবে। সত্যিই কি তাই? মানুষের হাতে টাকা না থাকলে তারা কিন্তু ভোগ্যপণ্য কিনবে না। ফলে বাজারে ডিমান্ড তৈরিও হবে না। ডিমান্ড না থাকলে উৎপাদন ক্ষেত্র ভোগ্যপণ্য বানিয়ে বেচবে কোথায়? আর মানুষের হাতে টাকা না থাকলে ডিমান্ড তৈরিও হবে না। আর রেপো কমালেই গৃহঋণ বা গাড়ি কেনার জন্য ঋণ নেওয়ার ঢল নামবে বলে কেন্দ্র আশায় বুক বেঁধে বসে আছে, হবে না সেটাও। অন্ন সংস্থান করতে না পারলে সাধারণ মানুষ বাড়ি-গাড়ির পিছনে ছোটে না। আর গুটিকয় যে শ্রেণির মানুষজন হেলায় বাড়ি-গাড়ি কেনেন, তাঁদের লোনের জন্য সুদের ঘাটতির উপর অপেক্ষা করতে হয় না। যাঁদের উপর ভর করে অর্থনীতি রোল করে, সেই মধ্যবিত্তের হাতে টাকা নেই। সেটা সোনার বন্ধকী ঋণের ব্যাপ্তির দিকে তাকালেই বোঝা যায়। এই মুহূর্তে, অর্থাৎ চলতি বছর অক্টোবর পর্যন্ত দেশের ঘাড়ে গোল্ড লোনের বোঝা রয়েছে ১ লক্ষ ৫৪ হাজার ২৮২ কোটি টাকার। অর্থাৎ, সোনা বন্ধক রেখে এই অঙ্কের টাকা ঋণ নেওয়া হয়েছে। চলতি বছর মার্চ মাসে অঙ্কটা ছিল ১ লক্ষ ২ হাজার ৫৬২ কোটি টাকা। অথচ, সোনার চল কিন্তু বেশি দক্ষিণ ভারত এবং বাংলায়। তাহলে ধরে নিতেই হবে, এই দু’টি অঞ্চল থেকেই গোল্ড লোন অধিক মাত্রায় নেওয়া হয়েছে! তার মানে কি অন্য রাজ্যগুলির অবস্থা খুব ভালো? তা কিন্তু নয়। মূল্যবৃদ্ধির বাজারের সঙ্গে পাল্লা দিতে সেখানে কেউ জমি বন্ধক রেখেছেন, কেউ আবার মহাজনের থেকে চড়া সুদে লোন নিয়েছেন। এটাও এক ধরনের পার্সোনাল লোন বটে। তবে সেই সংখ্যাটা গোল্ড লোনের অঙ্ককে ছাপিয়ে যেতে পারেনি। সরকারি হিসেবই বলছে, পার্সোনাল লোনের বৃদ্ধির হার এই সময়সীমার মধ্যে মাত্র ৩.৩ শতাংশ। উপরন্তু অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলি থেকে ব্যক্তিগত ঋণ নেওয়ার প্রবণতায় রীতিমতো ধস নামছে। মানুষ যতটুকু পার্সোনাল লোন নিচ্ছে, তার বেশিটাই ব্যাঙ্ক থেকে। অর্থাৎ, নিরাপত্তা খুঁজছে আম জনতা। গত কয়েক বছরে নগদের সঙ্গে সঙ্গে এই একটি বিষয়ের অভাবও রীতিমতো অনুভব করছে দেশবাসী। কেন্দ্রের সাম্প্রতিক হিসেব হল, ৮৫ কোটি ভারতবাসীর মাথায় কোনও না কোনও ঋণের বোঝা রয়েছে কিংবা তাঁরা ঋণ শোধ করতে পারছেন না। এখানেই শেষ নয়, চলতি বছর অক্টোবর মাস পর্যন্ত গৃহঋণ বেড়েছে মাত্র ৫.৬ শতাংশ। অন্য বছর কিন্তু গড়ে হোম লোনে বৃদ্ধির হার ঘোরাফেরা করে ১২ শতাংশের আশপাশে। এর কারণ হতে পারে দু’টি। প্রথমত, ইএমআই কীভাবে দেব, সেই উত্তর খুঁজে পাচ্ছে না মধ্যবিত্ত। আর দ্বিতীয়ত, আয়করের নতুন রেজিমে হোমলোনে ছাড়ের মতো কোনও উপায় মোদি সরকার রাখেনি। ফলে কর বাঁচানোর ফন্দি সব মাঠে মারা গিয়েছে। সেই অঙ্কেই গৃহঋণের পথে অনেকে হাঁটতে চাইছেন না।
সোজা কথায়, বিনিয়োগ কমছে। সোনা বা গয়না কেনায় অনীহা লক্ষ করে গত ২০১৫ সালে গোল্ড বন্ড চালু করেছিল কেন্দ্রীয় সরকার। এর সবটাই নিয়ন্ত্রণ করে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক। তারা বছরের যে সময় বন্ড ছাড়ে, তখন সোনার বাজারদরের উপর নির্ভর করে চূড়ান্ত হয় বন্ডের দাম। প্রশ্ন হল, গোল্ড বন্ডের চাহিদা বাড়ছে কেন? কারণ, লগ্নিকারীরা দেখছেন, প্রতি বছর এই একটি ক্ষেত্রে বিপুল মুনাফা করার সুযোগ রয়েছে। সোনার দামের লম্ফঝম্পের কোনও সীমা পরিসীমা নেই। এক বছরে যদি ৫ হাজার টাকা সোনার দাম বাড়ে, তাহলে এখানে টাকা খাটানোই ভালো। নিরাপদ এলআইসি বা কম সুদের ফিক্সড ডিপোজিটে নয়। ধস নামুক না সঞ্চয়ে! ওটা পাবলিকের প্রবলেম। সরকারের নয়। আর তাই শেয়ার বাজারে টাকা খাটলে এই সরকার উল্লসিত হয়। আম জনতাও সঞ্চয়ের বদলে লগ্নিতে বাধ্য হয়। কারও ভাগ্যে শিকে ছেঁড়ে, কারও না। তাঁরা ডুবে যান দেনায়। লগ্নি হয়তো বাড়ে, সঙ্গে উদ্বেগও। শেয়ার বাজার হোক বা সোনার দাম... রাজনীতির উপরও কিন্তু তারা বড্ড বেশি নির্ভরশীল। ইতিমধ্যেই কিন্তু বিশ্বের দুই প্রান্তে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা চলছে। তার প্রভাব পড়ছে অর্থনীতিতেও। যুদ্ধের আঁচ যত বাড়বে, বেসামাল হবে সবাই। সেই তালিকা থেকে বাদ যাবে না ভারতও। কারণ, এখন আর গ্রামীণ অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার জন্য বিপুল বরাদ্দের ১০০ দিনের কাজ নেই। পরিকাঠামোয় বিপুল টাকা ঢেলে সাধারণ মানুষের হাতে কাজের মাধ্যমে টাকার জোগান বাড়ানোর প্রয়াস নেই। পরিকাঠামো, চাঙ্গা বাজার দেখিয়ে উৎপাদন ক্ষেত্রকে বুস্ট আপ করার পরিস্থিতি নেই। আর্থিক মন্দাকে রুখে দেওয়ার দূরদর্শী ভাবনাও নেই। সবচেয়ে বড় কথা, সরকার ও দেশের অর্থনীতিকে আগলে রাখার মতো একজন মনমোহন সিং ক্ষমতার অলিন্দে নেই।