চিকিৎসাশাস্ত্রের অধ্যয়নে বিশেষ উন্নতি ও সাফল্যের যোগ। কর্মস্থল পরিবর্তন ও উপার্জন বৃদ্ধির সম্ভাবনা। মনে অস্থিরতা। ... বিশদ
শুধু ভোটের জন্য জনগণকে বোকা বানাতে।
আমরা কত উদার, সেই বার্তা ছড়িয়ে দেওয়ার তাগিদে। গেরুয়া আকাশে আসল নেতা ঘুরেফিরে সেই ‘ওনলি সাভারকরই’! কে না জানে সঙ্ঘ
চলে তার নিজস্ব সংবিধান মেনে। বিভাজন, সাম্প্রদায়িকতা এবং হিন্দুত্বই যার শুরু ও শেষ কথা। বাকি এক পোয়া ভড়ংবাজি!
কিন্তু সংবিধানের মন্দিরে, ধাক্কাধাক্কি-রক্তপাত? এও মানা যায়! একটা বিতর্ক, একরাশ উতোর চাপান। ইতিহাস খুঁড়ে তোপ, পাল্টা তোপ। দু’পক্ষেরই প্রকৃত সংবিধানবন্ধু সাজার ক্লান্তিকর প্রতিযোগিতা। সংসদের বহু কোটি টাকা মূল্যের সময় খরচ। শেষে প্রত্যাশামতোই যোগফল শূন্য। বিতর্কের কেন্দ্রে যিনি সেই আম্বেদকর সাহেবের নাম বার বার উচ্চারণ করাকে ‘ফ্যাশন’ বলে বক্রোক্তি দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের! আগুনে ঘি দেওয়ার মতোই সঙ্গে সঙ্গে তাঁর ইস্তফা দাবি সম্মিলিত বিরোধীদের। চুলচেরা লড়াইয়ে কম যায় না প্রতিপক্ষও। রাহুল গান্ধীর সাদা টি শার্ট পর্যন্ত নিমেষে বদলে গেল আম্বেদকর ঘেঁষা নীলের উজ্জ্বল আতিশয্যে। আগে থেকেই সব যেন মাপ করে বানানো। এবার ক্লাইম্যাক্স। হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত নতুন সংসদ ভবন চত্বরে ঠেলাঠেলি, রক্তপাত, মায় থানা পুলিস পর্যন্ত। দু’পক্ষের নেতারাই ছুটছেন পার্লামেন্ট থানায়। পুরনো নেতারাই শুধু ব্রাত্য নন, ব্রাত্য সৌজন্য, শিষ্টাচার এবং পারস্পরিক বিশ্বাস। কেসটা স্পিকারের হাতেও কি আছে? অপরাধ শাখার তদন্ত কি রাহুল গান্ধীকে নতুন করে সমস্যায় ফেলবে? এসবই ভবিষ্যৎ বলবে!
মধ্যিখানে নিট ফল একটাই, সংবিধান ও তাঁর প্রণেতা এবারও সম্মান পেলেন না। আম্বেদকরজির বিদেহী আত্মা মকর দ্বার পেরিয়ে চার দেওয়ালের ঘেরাটোপে কতটা বিলাপ করছেন, তা বলতে পারব না। তবে একথা নিশ্চিত, এবারও বসন্ত গেল প্রকৃত মূল্যায়ন হল না ওই পবিত্র কিতাবের! দুঃখ উপশমও কি হল আমাদের? মূল্যবৃদ্ধি, বেকারত্ব এবং নিত্যদিনের জীবন যন্ত্রণায় ক্লিষ্ট সাধারণ মানুষের? যাঁদের বেঁচে থাকা শুধু বিস্ফারিত চোখে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের ফুলে ফেঁপে নেপোয় মারে দই প্রত্যক্ষ করার জন্য!
৭৫ বছর ধরে দেশ চালনার পবিত্র পথ প্রদর্শক ভারতীয় সংবিধান। কিন্তু এক দেশ এক ভোট নিয়ে মাতামাতি প্রকৃত সমস্যা থেকে সাধারণের নজর ঘোরাতেই। মধ্যিখানে সংসদের মূল্যবান সময় শুধু নষ্ট হল। যার প্রতি মিনিটের মূল্য আড়াই লক্ষ টাকা। অর্থাৎ ঘণ্টায় দেড় কোটি টাকা। ইতিহাসই সাক্ষী, জীবিত অবস্থাতেই পদে পদে অপমানিত হয়েছেন দলিত নেতা, পিছড়ে বর্গের প্রবাদপ্রতিম ব্যক্তিত্ব বি আর আম্বেদকর। তাঁর নাম ও কাজের সঙ্গে সংবিধান প্রায় সমার্থক। অথচ প্রাপ্য গুরুত্ব ও সম্মানটুকুও জোটেনি জীবদ্দশায়। সেই অভিমানেই কি তিনি মাঝপথে ইস্তফা দিয়েছিলেন নেহরু মন্ত্রিসভা থেকে, তা আজও রহস্য! পদে পদে অবহেলিত হলেও তাঁর প্রণীত সংবিধানকে বুকে করেই দেশ চলেছে টানা ৭৫ বছর। যুদ্ধ, জরুরি অবস্থা, আর্থিক সঙ্কট, মূল্যবৃদ্ধি, মহামারী, নতুন অর্থনীতির যাত্রা কিংবা থমকে যাওয়া, যুযুধান বিতর্ক যেমন হয়েছে, তেমনি নেমে এসেছে আক্রমণও। শতাধিক সংশোধন আনা হয়েছে। কিন্তু আজও তাকে অস্বীকার করার সাহস কেউ দেখাতে পারেনি। ঝাঁ চকচকে সংসদে ফাঁকা কিতাবই হোক কিংবা রাষ্ট্রের বিবেকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে পথনির্দেশ, বারে বারে আলো ছড়িয়েছে আম্বেদকরের ‘ম্যাগনাম ওপাস’।
এই পর্যন্ত সব ঠিকই ছিল। কিন্তু গত বৃহস্পতিবার যেন সব বাঁধ ভাঙল। আগের দিন অমিত শাহের ইস্তফার দাবিতে উত্তাল হয়েছিল পার্লামেন্ট। আর পরদিন সংসদ শুধু উত্তপ্তই হল না, রক্তাক্তও হল। প্রতাপ ষড়ঙ্গী কিংবা মুকেশ রাজপুতের সঙ্গেই জখম হল সংসদীয় রাজনীতির আবেগ, ঐতিহ্য এবং পরম্পরা। জখমদের একজনের বয়স ৬৯। অন্যজন ৫৬। দু’জনেই প্রবীণ। আহত হয়ে ভর্তি হলেন হাসপাতালে। ঠেলাঠেলি ও মারার অভিযোগ উঠল স্বয়ং লোকসভার বিরোধী দলনেতা রাহুল গান্ধীর বিরুদ্ধে। নাগাল্যান্ডের মহিলা এমপি বিরোধী দলনেতার বিরুদ্ধে তার চেয়েও ভয়ঙ্কর অভিযোগ ও ইঙ্গিত করলেন। এমনকী সোনিয়াপুত্রের বিরুদ্ধে প্রাণে মারা চেষ্টর ধারা যুক্ত করার চেষ্টাও চলল দিনভর। যদিও শেষ পর্যন্ত পার্লামেন্ট পুলিস স্টেশন সেই ১০৯ নম্বর ধারা বাতিল করে স্বস্তি দেয় রাহুল গান্ধীকে। কংগ্রেসের পাল্টা অভিযোগ, অমিত শাহের আম্বেদকর বিরোধী মন্তব্য থেকে দৃষ্টি ঘোরাতে পরিকল্পিত হাঙ্গামা পাকিয়েছে বিজেপিই। অমিত শাহকে বাঁচাতেই নাকি এই ধাক্কাধাক্কি নাটকের অবতারণা। এসবই অভিযোগ, পাল্টা অভিযোগ।
এর সত্যাসত্য কোনওদিন জানা যায় না। বোফর্স থেকে রাফাল, একই ট্র্যাডিশন সমানে চলে।
চলতে থাকে।
আলোচনার কথা ছিল সংবিধানের ৭৫ বছর পূর্তি এবং এক দেশ এক নির্বাচন বিল নিয়ে। সংসদের দুই কক্ষেই কোমর বেঁধে নেমেছিল সরকার পক্ষ। সপ্তাহভর। নেহরু, ইন্দিরা জমানা থেকে রাজীব গান্ধীর সময়, বারে বারে গান্ধী পরিবারের হাতে ভারতীয় সংবিধানের আক্রান্ত হওয়া নিয়ে তোপ দেগেও শেষরক্ষা কি হল গেরুয়া পার্টির। কংগ্রেসের ৫৫ বছরের শাসনকালে সংবিধান সংশোধন হয়েছে ৭৭ বার। দোসর এক দেশ এক নির্বাচন বিল। কিন্তু কোনও ক্ষেত্রেই সরকারপক্ষ স্বস্তি পায়নি। উল্টে সপ্তাহ শেষের কিসসা দেশের সংসদীয় ইতিহাসে আর এক কলঙ্কজনক অধ্যায়ের সূচনা করল। সংসদ চত্বরে শাসক ও প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেসের সদস্যদের লজ্জাজনক ধাক্কাধাক্কি। শাসকদলের দুই এমপি’র জখম হয়ে হাসপাতালে ভর্তি যেমন নাটকীয়, তেমনই পরপর দু’পক্ষের পার্লামেন্ট থানায় গিয়ে একে অপরের বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের মোটেও গৌরবের নয়। স্পিকার পদের গুরুত্ব মহান। সংসদ চত্বরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ও বিচারের কাণ্ডারী তিনিই। তাঁকে অন্ধকারে রেখে পুলিসের শরণাপন্ন হওয়া কি সুস্থ লক্ষণ, বিচারটা কি তিনি করতে পারতেন না? সংসদ কি তাহলে বিতর্কের বদলে শারীরিক কসরৎ ও শক্তি প্রদর্শনের জায়গা হল। দুই এমপি’র হাসপাতালে ভর্তি হওয়া এবং পরবর্তী অপ্রীতিকর ঘটনা প্রমাণ করে প্রতিষ্ঠিত এলিট এমপিরা পর্যন্ত নিজেদের মধ্যে বিরোধ মেটাতে ব্যর্থ। এবং ব্যর্থ হলেন বলেই মামলা পুলিস, থানা পর্যন্ত গড়াল। অভিযোগ ও পাল্টা অভিযোগের এই বহর সংসদীয় ইতিহাসে কি খুব উজ্জ্বল নিদর্শন হয়ে থাকল ভবিষ্যৎ ইতিহাসের জন্য? দেশের স্বাধীনতার মতোই সংবিধানের শতবর্ষও আসন্ন। সেদিন আমরা অনেকেই
হয়তো থাকব না। কিন্তু মারামারি রক্তপাতের এই ইতিহাস নিয়ে সেদিন কিন্তু আজকের শাসক ও বিরোধী, দু’পক্ষকেই কাঠগড়ায় তোলার লোকের অভাব হবে না!
এদেশে ১৯৪৭ সালের স্বাধীনতা লাভের পর দু’দশক লোকসভা ও বিধানসভার ভোট একসঙ্গে হয়েছিল। ১৯৬৭ সালের পর থেকেই আলাদা আলাদা ভোট হয়, যা গত ৫৭ বছর ধরে চলে আসছে। আচমকা সেই ধারা বদলে বিজেপি এক দেশ এক নির্বাচনের নেশায় মত্ত কেন? দেশের ভালোর জন্য? স্রেফ খরচ ও সময়ের সাশ্রয়ের জন্য? নাকি বহুত্ববাদ ও যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকে ধ্বংস করে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে একটি দল ও তার নেতার হাতে কেন্দ্রীভূত করতে? ভারতের বিশেষত্বই হল তার বহুত্ববাদ ও বিকেন্দ্রীকরণ মন্ত্র। সেই বিবিধ মত ও পথের অচিন পাখিকে একটি দল যদি কেন্দ্রীকরণের খাঁচায় বন্দি করতে চায়, তা ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর উপরই আঘাত। আঘাত সংবিধান ও স্বয়ং আম্বেদকরজির আদর্শের উপর। তাই গুরুত্বপূর্ণ বিলটি পেশের সময় সরকারপক্ষ দুই তৃতীয়াংশ গরিষ্ঠতা পায়নি। সরকার পক্ষের অন্তত কুড়িজন সদস্যই ভোট দেয়নি। গণতন্ত্রের স্বার্থে প্রতিটি দলের উচিত এক দেশ এক নির্বাচনের জুমলাকে রুখে দেওয়া। একমাত্র তাহলেই সংবিধানের বহুত্ববাদ রক্ষিত হবে। অন্যথায় দেশে বিরোধী আঞ্চলিক দলগুলি সংসদীয় ব্যবস্থায় চিরতরে গুরুত্ব হারাবে। গেরুয়া সংস্কৃতিই দেশের মূল চালিকাশক্তি হলে সংবিধানের সর্বনাশ!