পড়ে গিয়ে বা পথ দুর্ঘটনায় আঘাতপ্রাপ্তির যোগ থাকায় সতর্ক হন। কর্মে উন্নতি ও সাফল্যের যোগ। ... বিশদ
এইসব তাবৎ চাহিদা মেটানোর জন্য যা কাঁচামাল দরকার, সেই খনিজ পদার্থগুলি কোথা থেকে আসে? পশ্চিম এশিয়া এবং আফ্রিকা থেকে। এবার ভাবা যাক যে, পৃথিবীর কোন কোন দেশে সারা বছর ধরে যুদ্ধ, গৃহযুদ্ধ এবং দুর্ভিক্ষ অথবা সন্ত্রাস লেগেই থাকে? উত্তর হল, ঠিক ওই পশ্চিম এশিয়া এবং আফ্রিকার দেশগুলিতে।
এই যে আমরা দেখতে পাই সিরিয়া থেকে লেবানন। ইয়েমেন থেকে সুদান। কঙ্গো অথবা নাইজিরিয়ায় বছরের পর বছর ধরে চলছে অস্থিরতা, এর প্রকৃত কারণ কি সুস্থ ও স্বাভাবিক কোনও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কায়েম করার লড়াই? একেবারেই নয়। আসল অথবা নকল যুদ্ধের আড়ালে একটি অন্য যুদ্ধ রয়েছে। সেটি হল আন্তর্জাতিক কর্পোরেট বহুজাতিকগুলির খনি দখলের প্রতিযোগিতা। যে কারণে এত গোপন যুদ্ধ, তাকে বলা হয় ক্রিটিকাল মিনারেলস। কী কী আছে এই তালিকায়? লিথিয়াম, ব্যাটারি নির্মাণের জন্য। প্ল্যাটিনাম, ফুয়েল সেলের জন্য। তামা ও বক্সাইট। এবং অ্যালুমিনিয়াম।
সোলার এনার্জি এবং ইলেকট্রিক ভেহিকলের জন্য কী কী দরকার? লিথিয়াম, নিকেল, কোবাল্ট, গ্রাফাইট, তামা, অ্যালুমিনিয়াম। ইলেকট্রিক ভেহিকল অর্থাৎ যে গাড়ি বিদ্যুতে চলে, সেই গাড়ির প্রযুক্তি কাঠামোয় সাধারণ গাড়ির তুলনায় ৬ গুন খনিজ পদার্থজাত কাঁচামাল প্রয়োজন হয়। তাই এইসব খনিজের চাহিদা আকাশছোঁয়া হচ্ছে।
বিশ্বের ৬০ শতাংশ কোবাল্ট সাপ্লাই কে করেছে ২০১৯ সালে? কঙ্গো। চাহিদা কমে না। অথচ কঙ্গোর খাদ্যসঙ্কটও মেটে না। বিদ্রোহও কমে না। সিয়োরা লিওন এবং ভেনিজুয়েলায় অস্থিরতা কমে না। কারণ কী? কারণ এখানেই পাওয়া যায় চারটি দুর্মূল্য ধাতু। যাদের আজকাল নাম দেওয়া হয়েছে কনফ্লিক্ট মিনারেলস। কনফ্লিক্ট মিনারেলস তাদেরই বলা হয়, যাদের উৎপাদন হয় সেইসব দেশে, যেখানে সারাক্ষণ যুদ্ধ গৃহযুদ্ধ রাজনৈতিক অস্থিরতা বিদ্রোহ গণঅভ্যুত্থান লেগেই থাকে। সেইসব দেশের ওই অস্থিরতার সুযোগ নিয়ে যে খনিজগুলি আন্তর্জাতিক কর্পোরেট নিয়ম করে সংগ্রহ করে, তাদের বলা হয় কনফ্লিক্ট মিনারেলস।
ট্যান্টালাম, টংস্টেন, টিন এবং সোনা। বিশ্বে সবথেকে বেশি কনফ্লিক্ট মিনারেলস এই চারটি। মোবাইল ফোনে প্রয়োজন হয় ট্যান্টালাম। গাড়ি তৈরিতে টিন। টংস্টেন ইলেকট্রিক বাল্ব এবং সোলারে। কঙ্গো আন্তর্জাতিক আদালতে কাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেছে অস্থিরতার সুযোগে খনিজ আত্মসাৎ করার? বিশ্বের সবথেকে মূল্যবান যে মোবাইল ব্র্যান্ড, সেই বিখ্যাত কোম্পানির বিরুদ্ধে।
এই যে সোলার এনার্জি, ইলেকট্রিক ভেহিকল, মোবাইল নির্মাণের জন্য যা যা খনিজ দরকার হয় অথবা সামগ্রিকভাবে ক্রিটিকাল মিনারেলস সংগ্রহ ও সাপ্লাইয়ের সবথেকে বড় আন্তর্জাতিক সংস্থা কোন কোন দেশের। প্রথম তিন দেশ হল, কানাডা, আমেরিকা এবং চীন। চীনের সঙ্গে ভারত সর্বদাই কোথায় পিছিয়ে পড়ছে? আগাম পরিকল্পনায়। গত সপ্তাহে জাপান থেকে একটি সংবাদ এসেছে। হন্ডা, নিশান, মিৎসুবিসি এই তিন গাড়ি কোম্পানি সংযুক্ত হয়ে যাচ্ছে। অর্থাৎ সব ব্র্যান্ড একটিই কোম্পানির আওতায় হবে। কারণ কী? কারণ চীন গাড়ি সাপ্লাইয়ে জাপানকে হারিয়ে দিচ্ছে। বিশেষ করে চীন আচমকা দুটি বিষয়ে আগ্রাসী হয়ে ঝাঁপিয়েছে। ইলেকট্রিক ভেহিকল এবং আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স। জাপান এই দুই ক্ষেত্রেই পিছিয়ে পড়ছে। সোলার এনার্জির জন্য যে খনিজ দরকার সেটায় সৌদি আরবের কোম্পানিগুলি এগিয়ে। চীন দ্রুত তাদের সঙ্গে চুক্তি করে ফেলেছে।
পশ্চিম এশিয়া ও আফ্রিকার যেখানে যেখানে যুদ্ধ, বিদ্রোহ, গৃহযুদ্ধ এবং অভ্যুত্থান চলে, অনাহার চলে, দুর্ভিক্ষ হয়, তার প্রত্যেকটির মাটির নীচে দুর্মূল্য ধাতু আছে। সেটা আত্মসাৎ করাই আন্তর্জাতিক কর্পোরেটের লক্ষ্য। ওদের সহকারী তাদের দেশ। আর তাই আন্তর্জাতিক স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী এই অস্থিরতা ও যুদ্ধ জিইয়ে রাখে। কিছুতেই শান্তি আনতে দেয় না। নয়তো যে দেশগুলিতে খাদ্য ও জীবিকাসঙ্কট প্রবল, সেখানে আধুনিক অস্ত্রের অবাধ সাপ্লাই বিদ্রোহী ও সন্ত্রাসবাদীদের হাতে আসে কীভাবে? কারা জোগায়?
আসল যুদ্ধ, নকল যুদ্ধ, আসল শান্তি, নকল শান্তি, সবকিছুর পিছনে আসলে রয়েছে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য স্বার্থ। চীন, কানাডা, আমেরিকা, সৌদি আরব, ব্রিটেন, অস্ট্রেলিয়া ঝাঁপিয়ে পড়েছে সেই কারণে লি-আয়ন এবং তাবৎ ক্রিটিকাল মিনারেলসের দখল নিতে। কারণ আগামী বিশ্বের সবথেকে চাহিদা এসবই। লি-আয়নের চাহিদা ৩৩ শতাংশ বেড়ে যাবে ২০৩০ সালে। ম্যাকিনসের সমীক্ষায় একথা বলা হয়েছে। তাই এই প্রতিযোগিতা। কারণ কার্বনহীন গ্রিন ক্লাইমেট আগামী দিনের অর্থনীতির চালিকাশক্তি হবে। অর্থাৎ দূষণহীন অর্থনীতি। আর সেই কারণেই ইলেকট্রিক ভেহিকল এবং সোলার এনার্জির ডিমান্ড বাড়ছে। তাই বাড়ছে খনিজ চাহিদা।
এই যে এতক্ষণ যা যা আলোচনা করা হল, এর কারণ কী? কারণ হল একটি প্রশ্ন। এই যেখানে বিশ্ব বাণিজ্যের গতিপথ, সেখানে ভারত ২০২৪ সালে ঠিক কী কী করেছে? কিছুই না। ভারতের কোনও সংস্থা এসব বাণিজ্যে সামান্য পা রাখতেই পারেনি। ভারত সরকারের যারা নীতি নির্ধারক, তারা সবথেকে যা ভালোবাসে, তা হল, গালভরা বাণী দেওয়া। ভাষণ দেওয়া। বক্তৃতা দেওয়া। বিশ্ববাণিজ্যের ভবিষ্যৎ অভিমুখ, আধুনিক প্রযুক্তির পূর্বাভাস, সেটা আগাম আঁচ করে দ্রুত অন্য দেশগুলিকে পিছনে ফেলে কোনও একটি সেক্টরে এক নম্বর হওয়ার দৌড়ে শামিল হওয়ার চেষ্টা এবং ক্রমেই প্রধান উৎপাদক, সাপ্লাইকারী কিংবা ব্র্যান্ডভ্যালু নির্মাণ করা, এসব থেকে ভারত সরকার বহু দূরে।
ভারত সরকার যে এসব পারবে না এবং ভারত যে এভাবেই আন্তর্জাতিক এই দুর্দান্ত অর্থনৈতিক দাবাখেলায় ফর্মুলা ওয়ানের মতো রুদ্ধশ্বাস বাণিজ্যরেসের দর্শক হয়েই থেকে যাবে সেটা নিয়ে সন্দেহ নেই। কারণ, যে দেশে ২০২৪ সালেও কোন মসজিদের নীচে ৮০০ বছর আগে মন্দির ছিল, কে কোন মাংস খাবে, দেশের রাষ্ট্রভাষা কী হওয়া উচিত, স্কুলে স্কুলে হানা দিয়ে দেখা হবে শিশুদের মধ্যে রোহিঙ্গা মিশে নেই তো, বাবাসাহেব আম্বেদকরের বন্দনা করাকে ফ্যাশন আখ্যা দেওয়া, লবণ যুক্ত হলে পপকর্নে জিএসটি বেশি ইত্যাদি আশ্চর্য এবং অপরিণতমনস্ক রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক কালচার চাপিয়ে দেওয়া হয়, সেই দেশ নতুন পৃথিবীর সঙ্গে লড়বে কীভাবে?
পাকিস্তান, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ প্রতিবেশী ভূমিখণ্ডে এখন ক্রমবর্ধমান ভাঙনের শব্দ। ইওরোপ থেকে আসছে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় অস্থিরতার বার্তা। সুপ্রাচীন পশ্চিম এশিয়া ধ্বংসপ্রায়। আমাদের দরকার আরও বেশি করে ঐক্য ও বুদ্ধির সংমিশ্রণে আরও শক্তিশালী হওয়া। অথচ ঠিক এই দুটিরই অভাব। ঐক্য ও বুদ্ধি। এরকম একটি নিশ্ছিদ্র সাংবিধানিক কাঠামো এবং গণতন্ত্রের ঐতিহ্য পৃথিবীর কোনও দেশের নেই।
আমাদের সূক্ষ্মভাবে ভাবা উচিত, ঠিক যে দেশগুলি পৃথিবীর ইতিহাসে সবথেকে প্রাচীন, শিক্ষিত এবং সভ্য ছিল, সেই দেশগুলিকেই টার্গেট করা হয়েছে চিরঅস্থির করে দেওয়ার জন্য। মিশর, সিরিয়া, লিবিয়া, ইরান, ইরাক, আফগানিস্তান, প্যালেস্টাইন, গ্রিস...। এইসব রাষ্ট্র সঙ্কটে।
আন্তর্জাতিক চক্রান্তের পরবর্তী টার্গেট সিন্ধু সভ্যতার এই মহাপ্রাচীন ভারত নামক ভূমিখণ্ড যে হবে না এটা কে বলল? ভারতকে অস্থির করার গোপন পরিকল্পনা যে চলছে না সেটারই বা নিশ্চয়তা কী? সেটা প্রতিরোধ করার জন্য জাতি-ধর্ম-ভাষা নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধ হয়ে ভারতকে আবার শ্রেষ্ঠ শিক্ষা ও বাণিজ্য কেন্দ্র হিসাবে গড়ে তোলার জন্য কী করা উচিত? ভারতের বিপুল জনসংখ্যা। বিরাট অংশ ইংলিশ স্পিকিং। গণতন্ত্র বজায় আছে। মহিলা ওয়ার্ক ফোর্স সবথেকে বেশি। আধুনিক প্রযুক্তিতে শিক্ষিত যুবসংখ্যা বিশ্বের সবথেকে বেশি। এতসব ইতিবাচক ফ্যাক্টর আর কোথাও নেই।
২০২৫ সালে বাকি সব অপরিণতমনস্ক এবং অপ্রয়োজনীয় ইস্যু পরিত্যাগ করে রাষ্ট্র পরিচালকরা এটা কি ভাববেন? এই কিন্তু শেষ সুযোগ। এরপর আধুনিক পৃথিবী অনেক এগিয়ে যাবে!