কাজকর্মের ক্ষেত্রে ও ঘরে বাইরে বাধা থাকবে। কারও প্ররোচনায় যে কোনও সিদ্ধান্ত গ্রহণে সতর্ক হন। ... বিশদ
বি আর আম্বেদকরকে সামনে রেখে ভোটের রাজনীতি আগেও হয়েছে। কিন্তু সংসদ ভবনে এভাবে তাঁকে বিরোধী আক্রমণের ঘুঁটি বানানো হয়নি। অমিত শাহ সেটাই করেছেন। সংবিধানের ৭৫ বছর উপলক্ষ্যে আলোচনা। তারই জবাবি ভাষণ দেওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বদলে ব্যাটন হাতে তুলে নিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু বিজেপি সরকার আম্বেদকরের কটা মূর্তি বসিয়েছে, তার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে দলিত সমাজকেই প্রশ্নচিহ্নের মুখে ফেলে দিয়েছেন শাহ। পরে এর জন্য সাফাইও দিয়েছেন। তাতে অবশ্য চিঁড়ে ভেজেনি। এখানে প্রশ্ন উঠেছে দু’টি। প্রথমত, আম্বেদকরকে নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্য করে আসলে শাহ কি আদানি ইস্যু এবং এক দেশ এক নির্বাচন তরজাকে ঠান্ডা ঘরে পাঠিয়ে দিলেন? সেটাই কি উদ্দেশ্য ছিল? আলপটকা মন্তব্য করার লোক তো তিনি নন। লক্ষ করার মতো বিষয় হল, আম্বেদকর নিয়ে তোলপাড় শুরু হতেই এমন দু’টি জ্বলন্ত ইস্যু পিছনের সারিতে চলে গিয়েছে। আর দ্বিতীয়ত, নরেন্দ্র মোদি কেন জবাবি ভাষণের জন্য অমিত শাহকে ‘নির্বাচিত’ করলেন? সংবিধান নিয়ে ভাষণ দেওয়ার এত ভালো মঞ্চ তো মোদিজি পেতেন না! তাহলে তিনি কি উত্তরসূরির জায়গা বানাচ্ছেন? এই উত্তরসূরিকে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ কিংবা নিরঞ্জনী, জুনা, নির্বাণীর মতো শঙ্করাচার্য প্রবর্তিত দশনমী আখড়ার পরিচালক-সন্ন্যাসীরা মানবেন তো? মনে হতেই পারে, একটি রাজনৈতিক দলের অভ্যন্তরীণ এবং শীর্ষ নেতৃত্বের সিদ্ধান্তে ধর্মীয় সংগঠনগুলির মানামানিতে কী আসে যায়? আলবাৎ আসে যায়। কারণ, দলটার নাম বিজেপি। আর ধর্ম বাদ রেখে এই দলে কিছুই হয় না। ভোটও না, উন্নয়নও নয়। সেক্ষেত্রে ২০২৫ তো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বছর! কারণ, এ বছর সঙ্ঘের শতবর্ষ। এ বছর নরেন্দ্র মোদি ৭৫ বছর পূর্ণ করবেন। এবং এ বছরই বসছে প্রয়াগের পূর্ণকুম্ভের আসর। এই মেলাকে উপলক্ষ করেই তো ১২ বছর আগে বসেছিল ধর্মমহাসম্মেলন। ঠিক হয়েছিল, লোকসভা নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী পদের যোগ্য মুখ হতে পারেন একজনই—নরেন্দ্র মোদি। আবার পূর্ণকুম্ভ। আবার এলাহাবাদ। এবং আরও একবার ধর্মমহাসম্মেলন। তাহলে কি ব্র্যান্ড মোদির ক্ষেত্রেও ৭৫ বছরের সিলিং কার্যকর হতে চলেছে? উঠে আসবে নতুন নাম? সঙ্ঘের ইঙ্গিতে কার ভাগ্যে শিকে ছিঁড়তে চলেছে? সত্যিই কি অমিত শাহ? কোনওভাবে নামটা যোগী আদিত্যনাথ নয় তো?
২০১৩ সালে পূর্ণকুম্ভের সময় যোগী উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন না। নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতার শিখরে থাকাকালীন তাঁর উত্থান। গত কয়েক বছরে ধর্ম এবং প্রশাসন, দুই ক্ষেত্রেই পায়ের তলার জমি শক্ত করেছেন যোগী। আগ্রাসী হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি, বুলডোজার নীতি, জাত-ধর্মের ভোটকে নিপুণ হাতে সামাল দেওয়া... সবই করেছেন যোগী। উপরন্তু তাঁর অ্যাডভান্টেজ হল, তিনি গোরক্ষনাথ মঠের মোহন্ত। অর্থাৎ, যোগী যত না জিরাফে আছেন, তার থেকে অনেক বেশি যাতায়াত তাঁর ধর্মে। এই সমীকরণ তাঁকে সঙ্ঘ এবং অন্যান্য হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের কাছে অনেক বেশি এগিয়ে রেখেছে। অমিত শাহকে স্বয়ং মোদি প্রজেক্ট করতে পারেন। কিন্তু দিল্লির দরবার জানে, শাহ যতটা ভালো সংগঠন ও প্রশাসক, রাজনীতির মুখ হিসেবে ততটাই কম গ্রহণযোগ্য। নরেন্দ্র মোদিকে সামনে রেখেই তাঁর যাবতীয় আগ্রাসন। তার উপর শাহের বিরুদ্ধে মামলা-মোকদ্দমাও আছে। গোধরার পরও নরেন্দ্র মোদির আসন টলে না যাওয়ার কারণ, তিনি ছিলেন সঙ্ঘের ব্লু আইড বয়। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ি তাঁকে রাজধর্ম মনে করিয়ে দিয়েছেন। তারপরও মোদিজি বহাল তবিয়তে গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী থেকেছেন। দেশের প্রধানমন্ত্রীও হয়েছেন। অমিত শাহের রেকর্ড সে কথা বলে না। নরেন্দ্র মোদি যেখানে আলো ছড়িয়েছেন, সেখানেই শুধু ছটা দেখা গিয়েছে শাহের। উল্টে শীর্ষ নেতৃত্বের একটা বড় অংশের সমর্থন ছাড়াই কিন্তু যোগী নিজের একটা জায়গা বানিয়ে নিয়েছেন। কোভিড নিয়ন্ত্রণ নিয়ে তাঁর বিরুদ্ধে সমালোচনার ঝড় উঠেছে, বুলডোজার নীতিও শীর্ষ আদালতের তোপের মুখে পড়েছে। তা সত্ত্বেও পায়ের তলার জমি হারাননি যোগী। মোদির বিকল্প হয়ে ওঠার লক্ষ্যে এখন ছুটে চলেছেন তিনি। ভাগ্যে তাঁর শিকে ছিঁড়বে... যদি পূর্ণকুম্ভের ধর্মমহাসম্মেলনে যোগী আদিত্যনাথ নামটি পরবর্তী প্রধানমন্ত্রীর মুখ হিসেবে প্রস্তাবিত হয়। বিরোধিতা? সে তো ১২ বছর আগে লালকৃষ্ণ আদবানি, সুষমা স্বরাজরাও করেছিলেন। তাতে কি নরেন্দ্র মোদি এতটুকুও টেনশনে পড়েছেন। না, পড়েননি। কারণ, তাঁর পাশে ছিল সঙ্ঘ। হিন্দুত্ব। যোগী জানেন, একবার কুম্ভের মঞ্চ থেকে তাঁর নাম পাশ হয়ে যাওয়া মানে আর পিছন ফিরে দেখতে হবে না। ভোটের কথা তিনি ভাবছেন না। ২০২৯ পর্যন্ত সেক্ষেত্রে আর সঙ্ঘ অপেক্ষা করবে, এমন সম্ভাবনা কম। আঞ্চলিক দলগুলি এখন পুরোদমে শক্তিশালী হয়ে উঠছে। জনপ্রিয়তা কমছে মোদিজির। শুধু জনমানসে নয়, সঙ্ঘের অন্দরেও। তার উপর আগামী বছর বাংলায় বিধানসভা নির্বাচন। এবারও যদি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ক্যারিশ্মা বজায় থাকে, বিজেপিকে জাতীয় রাজনীতিতেও লাট খেতে হবে। নতুন মুখ এনে তাই সঙ্ঘ একটা চান্স নিতেই পারে। সেটা যোগী বা শাহ হতে পারেন। কিংবা তৃতীয় কেউ। এখানেও অবশ্য একটা প্রশ্ন আছে... মানুষ সেই চান্স নিতে দেবে তো?
রামদয়ালের সঙ্গে দেখা হয়েছিল নাসিক কুম্ভে। গোদাবরীতে ডুব দিয়ে ওঠার পর একপাশে হেলায় ফেলে রাখা পুঁটলি থেকেই গামছাটা বের করে মুছে নিয়েছিলেন। একটা ১০০ টাকার নোট, আর কয়েকটা ১০ টাকা পড়ে গিয়েছিল তখনই। তুলে দিতেই একগাল হাসি। হাত জোড় করে বলেছিলেন, ‘এই কটা টাকাই সম্বল বাবু। হারিয়ে গেলে আর ট্রেনের ভরসায় না... ঠাকুরের ভরসায় ফিরতে হতো।’ কোথায় উঠেছেন? সেখানে রেখে আসেননি কেন? রামদয়াল বলেছিলেন, ‘কোথাও উঠিনি তো বাবু! এই পথ, এই তপোবন থাকতে কোথাও থাকতে যাব কেন? রামজি টেনে এনেছেন। এসেছি। তিনিই রেখেছেন। তিনিই কোথাও না কোথাও খাবারের ব্যবস্থা করে দিচ্ছেন। যে পথ দেখাবেন, সেই পথেই ফিরে যাব।’ রামদয়ালের বিশ্বাস ছিল, তাঁর ‘সম্পত্তি’ কেউ নেবে না। তাই হেলায় পথের ধারে ফেলে রাখতে পেরেছিলেন তিনি। অর্জুনের বিশ্বাস ছিল, কুম্ভের জল নিয়ে গিয়ে চির-অসুস্থ মেয়েটার মুখে একটু দিতে পারলে সব রোগ পালিয়ে যাবে। একটা আধলা না থাকা সত্ত্বেও ফুলকুমারীর বিশ্বাস, কৃষ্ণ নিয়ে এসেছেন। তিনিই বাড়ি ফেরাবেন। শিক্ষা নয়, ধন নয়, ধর্ম নয়, জাত নয়... এই ভারত তো বিশ্বাসের উপরই দাঁড়িয়ে আছে। তাই আজ তারা এখনও ভোট দেয়। গণতন্ত্রকে বিশ্বাস করে। তাদের বিশ্বাস, এই মানুষটা প্রধানমন্ত্রী হলে আমাদের দুঃখ ঘুচবে। ঠিক যেভাবে নরেন্দ্র মোদির উপর বিশ্বাস ছিল ভারতের। কতদিন থাকবে এই বিশ্বাস? মোদির উপর, যোগীর উপর, শাহের উপর... গণতন্ত্রের উপর!
হৃদকম্পন কি একটুও বাড়ছে না নরেন্দ্র মোদির?