বিষয় সম্পত্তি ভাগাভাগি নিয়ে শরিকি বিবাদ চরম আকার ধারণ করতে পারে। কর্মে উন্নতি হবে। অপব্যয়ের ... বিশদ
এটা সত্যি, মনমোহন সিং কোনও অর্থেই জননেতা ছিলেন না। কোনওদিন ভোটে লড়েননি। তাঁর আকর্ষণে কোনও সভায় লক্ষ লক্ষ মানুষের ভিড় হয়েছে, একথা তাঁর কোনও অন্ধ ভক্তও দাবি করবেন না। আগাগোড়া অসম থেকে নির্বাচিত রাজ্যসভার সদস্য। ত্রয়োদশ প্রধানমন্ত্রী পদে শপথ নিলেও সবচেয়ে সফল ও জনপ্রিয়তম রাষ্ট্রনেতার আসনে বসাতে আপত্তি তুলবেন তাঁর একান্ত নিকটজনেরাই। ৫৬ ইঞ্চি দূর অস্ত, ‘অ্যাকসিডেন্টাল’, ‘পাপেট পিএম’ আখ্যা দিয়েই বিরোধীরা ঠোঁট বাঁকান আজও। তবু প্রায় সাড়ে তিন দশক ক্ষমতার উচ্চকক্ষে অনাবিল বিচরণের পরও তাঁর সততা ও নিষ্ঠার তুলনা মেলা ভার। তাঁর আমলের টুজি, কয়লা ব্লক বণ্টন কেলেঙ্কারি নিয়ে ঝড় উঠেছে, সংসদ অচল হয়েছে। সরকার টালমাটাল হয়েছে। কিন্তু তাঁর সফেদ কুর্তায় কালি লেপতে পারেনি একফোঁটাও। তিনি সেই বিরল মানুষ, যাঁর শিক্ষার ছাপ ও ক্ষমতার দ্যুতি উচ্চকিত চিৎকারে প্রকাশ পায় না, স্পষ্ট হয় ব্যবহারে, মাথা নিচু করে মৃদু ও ধীর বাচনভঙ্গিতে। বিরোধীদের ক্রুর শব্দবাণ ধেয়ে এলেও মনের ভিতরের পাকিয়ে ওঠা যন্ত্রণা কান্নায় নয়, পথ খুঁজে নেয় বিকল্প কাজে। কর্মসংস্থান থেকে জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তা আইন। একশো দিনের কাজ থেকে তথ্য জানার অধিকার, বিতর্কিত পরমাণু চুক্তি তাঁরই দান, যা সিপিএমের মেকি মুখোশ পর্যন্ত বেআব্রু করে দিয়েছিল। আদ্যন্ত ধর্মপ্রাণ পাঞ্জাবি শিখ, কিন্তু বাজার চলতি ‘হো জায়েগি বল্লে বল্লে’র ছন্দে গা ভাসিয়ে অলীক প্রতিশ্রুতি দেননি কখনও। বছরে দু’কোটি চাকরি, ১৫ লক্ষ টাকা দেওয়ার মতো বাজার গরম করা কথার বদলে মন দিয়েছেন অর্থনীতির প্রকৃত মানোন্নয়নে। লাইসেন্সরাজ খতম করে। ১৯৯১ এবং ২০০৮ সালের জোড়া আর্থিক বিপর্যয় থেকে দেশকে রক্ষা করার নজরকাড়া সাফল্য কোনও নির্বাচনী সভায় কিংবা সংসদের অলিন্দে হাত পা ছুড়ে গলা চড়িয়ে তাঁকে জাহির করতে দেখেনি দেশবাসী। আমিই প্রথম, আগের সব মিথ্যা, এই মানসিক বিকার আচ্ছন্ন করেনি কখনও। ব্যর্থ হয়েছেন, কিন্তু কোনওদিন কাউকে মুছে দেওয়ার সচকিত হুঙ্কার, মানুষে মানুষে দূরত্ব তৈরির বিষ ছড়িয়ে দেওয়ার কূটকৌশল কিংবা মুষ্টিবদ্ধ তর্জনী আকাশে তুলে প্রতিপক্ষকে তোপ দাগার কথা শোনা যায়নি তাঁর মুখে। দু’-দুটো টার্ম প্রধানমন্ত্রী, বিশ্বখ্যাত অর্থনীতিবিদ, যোজনা কমিশন, রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর এবং অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব—এই বিপুল অভিজ্ঞতার মিশেল এবং সম্ভ্রম জাগানো কেরিয়ার সত্ত্বেও শেষদিন পর্যন্ত সৌজন্য, শিষ্টাচার, ভদ্রতা এবং কৃষক পরিবারের মাটির কাছাকাছি থাকার ব্রত আষ্টেপৃষ্ঠে আঁকড়েই বেঁচেছেন। তাঁর দশ বছরের শাসনে সংবিধান কোনও আতঙ্ক ছাড়াই নিরাপদ থেকেছে, বদলের নেশায় নেমে আসেনি আক্রমণ! রক্তে প্রতিহিংসার লেশ ছিল না বলেই তিনি আজীবন ‘দুর্বল’, সোনিয়ার হাতের ‘পুতুল’, গান্ধী পরিবারের ‘বেতনভুক ক্রীড়নক’ বিশেষণে ভূষিত হয়েছেন। ১০ বছর প্রধানমন্ত্রী, ৩৩ বছর সংসদের উচ্চকক্ষের সদস্য। কিন্তু ভোটে লড়েননি একবারও। মায় দলের বসন্তে যখন যত্রতত্র রকমারি ফুলের আনাগোনা তখনও। তাঁর আনা গুরুত্বপূর্ণ অর্ডিন্যান্স দলেরই ‘মুখ কিংবা মুখোশ’ যাই বলুন সেই রাহুল গান্ধী ‘খুলে আম’ সাংবাদিক সম্মেলনে ছিঁড়ে ফেলেছেন। ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৩। সেদিন তিনি ছিলেন আমেরিকায়। রাতে হোয়াইট হাউসে ওবামার সঙ্গে বৈঠক। এতটা অসম্মান এবং যন্ত্রণাও মুখ বুঝে সহ্য করেছেন নিঃশব্দে, বিদ্রোহের পথে পা মাড়াননি। মনের দুঃখ বুঝতে দেননি নিজের ছায়াকেও। অথচ সেই অর্ডিন্যান্স আইনে রূপান্তরিত হলে সোনিয়া পুত্রকে এমপি পদ হারাতে হতো না গত লোকসভায়। ওই ঘটনার আট মাসের মধ্যেই ইউপিএ সরকারের পতন হয়। একরাশ দুঃখ বুকে নিয়ে সেদিন তিনি আশা করেছিলেন, গণমাধ্যম নির্দয় হলেও ইতিহাস একদিন নিশ্চয় তাঁর প্রতি সদয় হবে। গত ২৬ ডিসেম্বর রাতে সেই ‘ঋজু’ অথচ বয়সের ভারে ‘দুর্বল’ মানুষটির প্রয়াণের পর দেশজুড়ে জেগে ওঠা শোকের সুনামি জানান দিল ইতিহাস আজ তাঁর প্রতি কতটা সদয়! একই বছরে শিল্পপতি রতন টাটা ও মনমোহন সিংয়ের চলে যাওয়া নিঃসন্দেহে অপূরণীয় ক্ষতি। ভারতমাতার সঙ্গে আমরাও দুই অমূল্য কোহিনুরকে হারালাম একই বছরে। যা আগামী একশো বছরেও পূরণ হওয়ার নয়।
বছরের শেষ রবিবার। নতুন বছর শুরু হতে বাকি ৪৮ ঘণ্টা। বছরটা শুরু হয়েছিল রামমন্দিরের উদ্বোধন এবং সেই ধর্মীয় আবর্তে দেশবাসীকে আচ্ছন্ন করে মনমোহনের সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুর ব্যক্তিত্ব নরেন্দ্র মোদির তৃতীয়বার ক্ষমতায় আসার ঝড় তোলার চেষ্টায়। মনমোহন জমানাকে পিছনে ফেলে মোদিজি তৃতীয়বার ক্ষমতায় এসেছেন ঠিকই, কিন্তু প্রত্যাশিত ঝড় কিন্তু ওঠেনি। অযোধ্যার বহু প্রতীক্ষিত মন্দির বাঙালি তথা ভারতবাসীর আবেগকে ঢেকে দিতে পারেনি। এক্সিট পোল পণ্ডিতরা কী দেশে, কী এই বঙ্গে তাদের নির্বাচনী হিসেব মেলাতে ব্যর্থ। অধিকাংশ এক্সিট পোলই বিজেপির পক্ষে সাড়ে তিনশো থেকে চারশো আসন জয়ের ইঙ্গিত দিয়েছিল। চারশো নয় দৌড় থেমেছে ২৪০-এ। আর বাংলায় ৪২টি আসনের মধ্যে ৩০টি আসন গেরুয়া দলকে দিয়ে রাজনৈতিক ডামাডোল সৃষ্টির চেষ্টাও কম হয়নি। কিন্তু বাস্তবে ফল বেরতে দেখা গেল বিজেপির আসন সংখ্যা বাড়া তো দূর অস্ত কমেছে, বঙ্গে তা ১৮ থেকে কমে ১২ হয়েছে। আর সিপিএম তথা বামপন্থীরা যথারীতি শূন্যই রয়েছে। উত্তরপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, বাংলায় এবং দক্ষিণ ভারতের বিরাট অংশে বিজেপির রথ মুখ থুবড়ে পড়ার দরুনই, ৪০০ পারের স্বপ্ন দূর অস্ত, একক গরিষ্ঠতা হারিয়ে বিজেপি সরকার চব্বিশের মাঝামাঝি থেকে মনমোহন আমলের মতোই জোটের সরকারে পরিণত। ২০০৪ থেকে ২০১৪, প্রথমে বাম এবং পরে মূলত মুলায়মের দলের সমর্থন নিয়েই মনমোহনের পথচলা। আর আজ মোদি সরকারেরও দু’টি অবলম্বন তেলুগু দেশমের চন্দ্রবাবু নাইডু এবং বিহারের নীতীশ কুমার। এও এক অদ্ভুত সমাপতন! মোদিজিকে আজ প্রতিনিয়ত শরিক রাজনীতির পাঠ নিতে হচ্ছে মনমোহনের থেকেই। একদশক পর। ভাগ্যের এমনই পরিহাস, তিনিও সংখ্যালঘু দলেরই প্রধানমন্ত্রী! আসন্ন নতুন বছরে ইন্ডিয়া জোটের নেতৃত্বে যদি মনমোহনের মতো কাউকে খুঁজে পাওয়া যায় তারই অন্বেষণ চলছে দেশজুড়ে।
বাংলাতেও চব্বিশ সাল জুড়ে রাজনৈতিক ঢেউ বড় কম ওঠেনি। কিন্তু সেই ঢেউ মিলিয়ে গিয়েছে কোনও দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ছাড়াই। কেন? কারণ এ রাজ্যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের শক্তিশালী নেতৃত্ব আছে। তাই বহু চেষ্টা করেও দাঁত ফোটাতে ব্যর্থ মোদিজি। বছরের শুরুতে লোকসভা নির্বাচনকে সামনে রেখে গেরুয়া শিবিরের দাপাদাপি যদি একটি দিক হয়, অন্যদিকে রয়েছে জেলায় জেলায় বিভাজন ও মেরুকরণের চেষ্টা। মোদি ও অমিত শাহ, এই দু’জন সরকারি হাওয়াই জাহাজে কলকাতা বিমানবন্দরে না নামলে বঙ্গ বিজেপি মৃতপ্রায় হয়েই পড়ে থাকে। তাঁদের বার বার আসা যাওয়াতেও আখেরে প্রাণ জাগে না, স্বল্প সময়ের জন্য ঘুম ভাঙে শুধু। অপদার্থ বঙ্গ বিজেপি নেতৃত্ব এজন্য ষোলোআনা দায়ী। আর বামপন্থীরা? ডাক্তারদের পিছন পিছন ঘুরেও এতটুকু জনসমর্থন বাড়াতে ব্যর্থ। নিয়োগ দুর্নীতি। বালি, গোরু, রেশনের চাল পাচার, মন্ত্রীসান্ত্রিদের গ্রেপ্তার এত কিছুর পরও এ রাজ্যের বিরোধীরা কি সামান্যও জেগেছে! বিজেপি, সিপিএম, কংগ্রেস, আরএসপি, সিপিআই ... এসইউসি কেউ গাঝাড়া দিতে পেরেছে? বামেদের যাবতীয় বিপ্লব আজ ফেসবুক আর ইউটিউবেই বন্দি! অথচ বছরটা শুরু হয়েছিল টি-২০ স্টাইলে। অযোধ্যার মন্দিরই বুঝি দেশের সঙ্গে বাংলার রাজনৈতিক মানচিত্রও বদলে দেবে, ভাবটা ছিল এমন। ২২ জানুয়ারি পাড়ায় রামভক্তদের দাপাদাপি দেখে এই বাংলাকে চিনতে সত্যিই কষ্ট হচ্ছিল। আর আজ বছর ঘোরার এই মাহেন্দ্রক্ষণে অযোধ্যার মন্দিরকে হাজার যোজন পিছনে ফেলে দিতে প্রস্তুত দেড়শো কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত দীঘার জগন্নাথ মন্দির। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতে শীঘ্রই যার উদ্বোধন আসন্ন। আগামী অক্ষয় তৃতীয়া থেকে বাংলার আধ্যাত্মিক মানচিত্রে এই নয়া সংযোজন নিশ্চিতভাবে ছাব্বিশের বিধানসভা ভোটের আবহসঙ্গীত রচনা করবে। এবং ধর্মপ্রাণ বাঙালি বলবে হিন্দুধর্ম কারও পৈতৃক সম্পত্তি নয় যে ভোট এলেই বাক্স ঝেড়ে তা দরজায় দোলাতে হবে ফায়দা লোটার জন্য।
কিন্তু আগামী ১৫ মাসের মধ্যে বাংলার বিধানসভা মহারণের চেয়েও সম্মিলিত বিরোধী জোট আগামী বছর জাতীয় স্তরে বিজেপিকে কতটা চ্যালেঞ্জ ছুড়তে পারে তার উপরই নির্ভর করছে ভারতের গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ। যদি বিজেপিকে রুখে দিতে হয় তাহলে মমতা, কেজরিওয়াল, স্ট্যালিন, লালু, অখিলেশ, শারদ পাওয়ার, উদ্ধবদের আরও ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। সংসদে এক হয়ে এক দেশ এক নির্বাচন বিল আটকে দিতে হবে। নাহলে খতম হয়ে যাবে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর ভিত্তিটাই। ভারতের সংবিধান ও আম্বেদকরের সম্মান বাঁচাতে পারে একমাত্র আঞ্চলিক দলগুলিই। এবং মনমোহনের মতো গান্ধী পরিবারের বাইরে থেকে উঠে আসা একজন সৎ শান্ত সর্বজনগ্রাহ্য নেতা, যিনি সমগ্র বিরোধী কুলকে ঐক্যের মন্ত্রে বাঁধতে পারবেন। তার জন্য নীরবে সব জ্বালা সহ্য করতে পারবেন। দেশের এই সঙ্কটের মুহূর্তে মনমোহনের মতো একজন শান্ত নির্লোভ সৎ নেতার বড় প্রয়োজন গরিব মানুষের স্বার্থে এবং সংবিধানকে অক্ষত রাখতে। মনমোহনের সেই বিকল্প যদি বাংলা থেকে উঠে আসে! সেই স্বপ্নের নেতানেত্রীর খোঁজেই আসন্ন ২০২৫-এর রাজনৈতিক দৌড়ের অপেক্ষা। আচমকা ২০০৪ সালের দমকা ঝোড়ো বাতাসের মতো তিনি এলেই বিজেপি’র কারিকুরি শেষ হয়ে যাবে বাজপেয়ি জমানার মতো। দিল্লিতে আবার মাথা তুলবে ইন্ডিয়া জোটের কোয়ালিশন সরকার।