মানসিক উত্তেজনার বশে ঘরে বাইরে বিবাদে জড়িয়ে অপদস্থ হতে পারেন। হস্তশিল্পীদের পক্ষে দিনটি শুভ। মনে ... বিশদ
গত ৭ জানুয়ারি খবরের কাগজের ভিতরের পাতায় একটা শিরোনাম হয়তো অনেকের নজর এড়িয়ে গিয়ে থাকবে—‘উপাচার্য নিয়োগ সংক্রান্ত গাইডলাইন সংশোধন করেছে ইউজিসি’। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের সিলেকশন প্রসেস বা নির্বাচন প্রক্রিয়াই ছিল খবরটার বিষয়বস্তু। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) খসড়া গাইডলাইন ইস্যু করার পর সে-সম্পর্কে মতামত আহ্বান করেছে।
উধাও উদারতা
বর্তমানে এক বা একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার অনুমোদনকারী বেশিরভাগ আইনে রাজ্যের রাজ্যপালকেই আচার্য করা হয়। অন্যদিকে কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কিছু আইনে রাষ্ট্রপতি হলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ভিজিটর’। সবসময়ই রাজ্যপাল নিয়োগ করা হতো এমন একজন বিশিষ্ট নেতাকে যিনি সক্রিয় রাজনীতি থেকে বহুকাল আগেই অবসর নিয়েছেন অথবা তিনি একজন বিশিষ্ট সম্মাননীয় নাগরিক। রাজ্যপালের কাছে এটাই প্রত্যাশিত যে তিনি পুরোপুরি সংবিধান মেনে কাজ করবেন। বর্তমান রেগুলেশনে একটি সার্চ-কাম-সিলেকশন কমিটির কথা বলা রয়েছে। ওই কমিটিতে রাজ্যপাল, রাজ্য সরকার, বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেটের একজন করে মনোনীত সদস্য থাকবেন। অতীতে সার্চ-কাম-সিলেকশন কমিটি ছিল উদার ও গণতান্ত্রিক। তখন চূড়ান্ত নির্বাচনের অধিকারী আচার্য বা রাজ্যপাল হলেও তিনি কাজটি করতেন সাধারণত রাজ্য সরকারের ‘সহায়তা এবং পরামর্শ’ অনুসারে। দুর্ভাগ্যবশত, গত এক দশকে সেই রীতি কবরে পাঠানো হয়েছে এবং রাজ্যপালরা উপাচার্য নিয়োগ করেছেন তাঁদের মর্জি মতোই।
সময় বদলে আরও খারাপের দিকে গিয়েছে। বর্তমান ব্যবস্থায়, রাজ্যপালরা হলেন আরএসএস অথবা বিজেপির আদর্শের প্রতি অনুগত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, আনুগত্য প্রদর্শনের নিমিত্ত তাঁরা পুরস্কৃত হচ্ছেন অথবা তাঁরা হলেন আস্থাভাজন অবসরপ্রাপ্ত সিভিল সার্ভেন্ট। বিরোধী শাসিত রাজ্যগুলিতে রাজ্যপালকে কেন্দ্রীয় সরকারের ‘ভাইসরয়’ হিসেবে কাজ করার এবং সেই রাজ্য সরকারকে ‘শৃঙ্খলিত’ করার ফরমান দেওয়া হয়। বাস্তবে, রাজ্যগুলিতে চালু রয়েছে একটি ‘দ্বৈতশাসন’ ব্যবস্থা। একদিকে নির্বাচিত সরকার এবং অন্যদিকে নির্বাচন ব্যবস্থার বাইরে বসানো একজন রাজ্যপাল। ভারতের সংবিধানের ‘সহায়তা ও পরামর্শ’ বলে যে ধারাটি রয়েছে এই জমানায় সেটা বাতিল হয়ে গিয়েছে।
দ্বৈতশাসনের প্রস্তুতি
বিধানসভায় পড়ার জন্য রাজ্য সরকার যে ভাষণ তৈরি করে দেয় কোনও কোনও রাজ্যপাল তার অংশবিশেষ, এমনকী পুরোটাই পড়তে অস্বীকার করেন। আরও দেখা যায় যে, কোনও রাজ্যপাল প্রকাশ্যেই রাজ্য সরকারের, বিশেষ করে মুখ্যমন্ত্রীর সমালোচনা করছেন। মুখ্যমন্ত্রীকে এড়িয়ে, রাজ্যের মুখ্যসচিব অথবা পুলিস প্রধানকে ডেকে পাঠিয়ে হুকুম জারি করছেন কোনও কোনও রাজ্যপাল! জেলা প্রশাসনের কাজকর্ম ‘পর্যালোচনা’ করার জন্য জেলার কর্মকর্তাদের সঙ্গে ‘আলোচনা’ করতে রাজ্য সফর করতেও দেখা যাচ্ছে কোনও কোনও রাজ্যপালকে। সাংবিধানিক ব্যবস্থা লঙ্ঘন করে, বিশেষ করে বিরোধী শাসিত রাজ্যগুলিতে কিছু রাজ্যপাল দ্বৈতশাসন প্রতিষ্ঠিত করছেন। [বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলির ক্ষেত্রে ব্যাপারটা আরও ভয়ঙ্কর। ওই রাজ্য সরকারগুলি পুরোপুরিই ‘কেন্দ্রীয় সরকারের অধস্তন’ হিসেবে কাজ করে। সেখানে সাধারণত একজন মন্ত্রী অথবা একজন সিনিয়র অফিসার প্রধানমন্ত্রীর ‘চক্ষু ও কর্ণ’-এর ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্ত, মর্জি, বার্তা প্রভৃতি মুখ্যমন্ত্রীর কাছে পৌঁছে দেন তাঁরাই।]
ইউজিসি আইনের ২২ ধারায় বলা হয়েছে যে, ‘ডিগ্রি’ বলতে ইউজিসি কর্তৃক নির্ধারিত যেকোনও ডিগ্রিকে বোঝায় এবং সেটা দিতে পারে কেবলমাত্র আইনসিদ্ধভাবে প্রতিষ্ঠিত কোনও বিশ্ববিদ্যালয়। নতুন খসড়া নিয়মাবলিতে উপাচার্যের জন্য সার্চ-কাম-সিলেকশন এবং নিয়োগ পদ্ধতি নির্ধারণ করা হয়েছে। কাজটা তিন সদস্যের একটা কমিটির মাধ্যমে হবে। ওই কমিটিতে আছেন আচার্য, ইউজিসি এবং সিন্ডিকেট/ সিনেট/ পরিচালন পর্ষদের মতো বিশ্ববিদ্যালয়ের শীর্ষসংস্থার তরফে মনোনীত একজন করে সদস্য। কমিটি তিন থেকে পাঁচজন ব্যক্তির নামের একটি প্যানেল তৈরি করবে এবং আচার্য তাঁদের মধ্যে একজনকে উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ করবেন। যদি কোনও বিশ্ববিদ্যালয় এই বিধান লঙ্ঘন করে, তবে তাকে কোনোরকম ডিগ্রি প্রোগ্রাম চালাতে দেওয়া হবে না অথবা ইউজিসি স্কিমে তার অংশগ্রহণ নিষিদ্ধ হয়ে যাবে। ইউজিসি আইনের অধীনে বিশ্ববিদ্যালয়ের যে তালিকা রয়েছে এমন বিশ্ববিদ্যালয়কে তার থেকেও বাদ দেওয়া হবে। এছাড়া তার বিরুদ্ধে নেওয়া হবে অন্যান্য শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি কার্যত আর ‘বিশ্ববিদ্যালয়’ হিসেবেই গণ্য হবে না। মনে রাখবেন, উপাচার্য বাছাই এবং তাঁর নিয়োগের ক্ষেত্রে রাজ্য সরকারের আর কোনও ভূমিকাই নেই। ‘ভাইস চ্যান্সেলর’ বা উপাচার্য হয়ে উঠবেন ইউজিসির ‘ভাইসরয়’, যে সংস্থার চেয়ারপার্সন এবং সদস্যদের কেন্দ্রীয় সরকার ‘নিয়োগ’ এবং ‘অপসারণ’ দুটোই করতে পারে।
বিশ্ববিদ্যালয় জাতীয়করণ
একটি বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় আদর্শগত বিশুদ্ধতার জন্য যাচাই করা ‘ভাইসরয়’ থাকবেন দু’জন—রাজ্যপাল/ আচার্য এবং উপাচার্য। ড্রাফট রেগুলেশনস বা খসড়া বিধানগুলি প্রজ্ঞাপিত হলে রাজ্য সরকারের অধিকার কেড়ে নেবে। অথচ রাজ্যের বাসিন্দাদের প্রয়োজনেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলি রাজ্য সরকারই তৈরি করেছে। ওই বিশ্ববিদ্যালয়গুলির জন্য তহবিল গড়ে দেওয়া হয়েছে রাজ্যেরই নিজস্ব সম্পদ থেকে। খসড়া বিধানগুলি বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে কার্যত ‘ন্যাশনালাইজ’ বা ‘জাতীয়করণ’ করে ফেলবে। আর ওই সুযোগে দেশের সমস্ত উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেবেন ‘মসিহা’। বিজেপি যে ‘এক জাতি, এক সরকার’ নীতি নিয়েছে, সেই লক্ষ্যে পৌঁছতে ধাপে ধাপে কেন্দ্রীকরণের সঙ্গেই সংগতিপূর্ণ একটা উদাহরণ এটা। এটা ফেডারেলিজম বা যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা এবং রাজ্যগুলির অধিকারের উপর একটা স্পষ্ট আক্রমণ।
এই ড্রাফট রেগুলেশনস রাজ্যগুলির তরফে অবশ্যই প্রত্যাখ্যান করা চাই। ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলির জাতীয়করণের মতলবকে ‘পরাজিত’ করার জন্য রাজ্যগুলিকে লড়াই করতে হবে রাজনৈতিক এবং আইনিভাবে। অবশ্যই প্রতিবাদ করতে হবে শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের। সাবধান, পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বা জনপ্রশাসনের সকল ক্ষেত্রে দ্বৈতশাসন একবার প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলে, সেই সুড়ঙ্গ ধরে রাজতন্ত্র বা স্বৈরশাসন কায়েম হওয়া তখন সময়ের অপেক্ষা মাত্র।