শ্রীরামকৃষ্ণের মধুরভাবের সাধনা ও আস্বাদনের কাহিনী বোধ করি বিচিত্রভর। মধুরভাব সাধনের সময় শ্রীরামকৃষ্ণ নিরন্তর ছয়মাস মেয়েদের মতো বেশভূষা করেছিলেন। ব্রজগোপীর ভাবে তিনি এতই তন্ময় হয়ে থাকতেন, যে, তাঁর পুরুষসত্তার অনুভূতি তখনকার মতো লোপ পেয়েছিল। তাঁর চলন, বলন, হাসি, অঙ্গভঙ্গী সব নারীদের মতো হয়ে গিয়েছিল। ভৈরবী ব্রাহ্মণী তাঁকে বাগানে ফুল তুলতে দেখে এক-একদিন সাক্ষাৎ শ্রীমতী রাধারাণী মনে করে বসতেন। শ্রীরাধার কৃপা ভিন্ন শ্রীকৃষ্ণের দর্শন কঠিন জেনে শ্রীরামকৃষ্ণ শ্রীমতীর স্মরণ মনন ও ধ্যানে তন্ময় হয়ে তাঁর পাদপদ্মে হৃদয়ের আকুল প্রার্থনা নিবেদন করতে করতে একদিন দেখতে পেলেন শ্রীকৃষ্ণপ্রেমে সর্বস্বহারা, নাগকেশরপুষ্পের কেশরসকলের ন্যায় গৌরবর্ণা শ্রীরাধিকাকে। শ্রীরাধিকা তাঁকে দর্শন দিয়ে তাঁর শরীরে মিলিয়ে গেলেন। এরপর তিনি নিজেকে শ্রীমতী বলে জ্ঞান করতে থাকেন। ক্রমে শ্রীমতীর মতো তাঁর দেহেও মহাভাবের লক্ষণসমূহ দেখা দিল। প্রতীক্ষার উৎকণ্ঠায় তিনি উন্মত্তের ন্যায় আচরণ করতে থাকেন। আহার নিদ্রা বন্ধ হল। বিরহের উত্তাপ শরীরে তীব্র জ্বালার সৃষ্টি করল, শরীরে রোমকূপ দিয়ে সময়ে বিন্দু বিন্দু রক্ত ঝরতে লাগল। শ্রীরামকৃষ্ণ পরবর্তীকালে নিজের অবস্থা বর্ণনা করে বলেছিলেন, ‘ঈশ্বরের বিরহ-অগ্নি সামান্য নয়।...আমি এই অবস্থায় তিন দিন অজ্ঞান হয়েছিলাম।...হুঁশ হলে বামনী আমায় ধরে স্নান করাতে নিয়ে গেল। কিন্তু হাত দিয়ে গা ছোঁবার জো ছিল না। গা মোটা চাদর দিয়ে ঢাকা। বামনী সেই চাদরের উপরে হাত দিয়ে আমায় ধরে নিয়ে গিছল।...যখন সেই অবস্থা আসতো, শিরদাঁড়ার ভিতর দিয়ে ফাল চালিয়ে যেত! “প্রাণ যায়”, “প্রাণ যায়” এই করতাম।’ অবশেষে তাঁর দীর্ঘপ্রতীক্ষার অবসান ঘটে। ‘নীলবর্ণ ঘাসফুলের ন্যায় কান্তিবিশিষ্ট’ শ্রীকৃষ্ণ তাঁকে দেখা দিয়ে তাঁর শ্রীঅঙ্গে মিলিয়ে গেলেন। পুঁথিকার লিখেছেন, ‘আপনে আপনি প্রভু দেখেন এখন।/ তিনিই শ্রীকৃষ্ণ নিজে রাধিকারমণ।’ এবং তিনি কখনও বা নিজ পৃথক অস্তিত্ববোধ হারিয়ে নিজেকে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলে বোধ করছিলেন, আবার কখনও আব্রহ্মস্তম্ব পর্যন্ত সব কিছুকেই শ্রীকৃষ্ণবিগ্রহরূপে দর্শন করছিলেন।
অনুরূপভাবে শ্রীরামকৃষ্ণের মধুরভাব আস্বাদনের অনেক কাহিনী বিভিন্ন জীবনীকারের লেখনীতে ধরা পড়েছে। ‘শ্রীম’ অঙ্কিত একটি চিত্র। সুরেন্দ্রের বাগানে সংকীর্তন চলেছে। কীর্তনীয়াগণ মাথুর গাইছে। শ্রীমতীর বিরহ অবস্থা বর্ননা করে গাইছে। শ্রীরামকৃষ্ণ ভাবাবিষ্ট। হঠাৎ দাঁড়িয়ে অতি করুণস্বরে আখর দিচ্ছেন ‘সখি। হয় প্রাণবল্লভকে আমার কাছে নিয়ে আয়, নয় আমাকে সেখানে রেখে আয়।’ শ্রীরামকৃষ্ণের শ্রীরাধিকার ভাব হয়েছে। কথাগুলি বলতে বলতেই নির্বাক হলেন; দেহ স্পন্দহীন, অর্ধনিমীলিত নেত্র। সম্পূর্ণ বাহ্যজ্ঞানশূন্য। শ্রীরামকৃষ্ণ গভীর সমাধিস্থ। অনেকক্ষণ পরে প্রকৃতিস্থ হলেন। আবার সেই করুণস্বরে বলছেন, ‘সখি! তাঁর কাছে লয়ে গিয়ে তুই আমাকে কিনে নে। আমি তোদের দাসী হ’ব। তুই তো কৃষ্ণপ্রেম শিখিয়েছিলি—প্রাণবল্লভ!’
স্বামী প্রভানন্দের ‘বাংলার যুগলচাঁদ: শ্রীচৈতন্য ও শ্রীরামকৃষ্ণ’ থেকে