শ্রীচৈতন্য ও শ্রীরামকৃষ্ণের ব্যক্তিত্ব সমপর্যায়ের। উভয়ের ব্যক্তিত্বে সমজাতীয় ভাব, ভাষা, গভীর অন্তর্দৃষ্টি ও দুর্বার জীবনীশক্তি। উভয়েই ঈশ্বরাবতাররূপে সমাদৃত। উভয়েরই জীবন ও ‘মিশন’ অনেকাংশে সমজাতীয়। শ্রীচৈতন্য বলতেন, ‘প্রভু কহে দুগ্ধে ঘৃত আছে গুপ্তভাবে। সে পাবে আস্বাদ তার যে-জন মথিবে।।’ শ্রীরামকৃষ্ণ চৈতন্যসুধা আহরণ করে আস্বাদন করেছিলেন। তাছাড়াও অপর একটি বিষয় লক্ষ্য করবার মতো। ‘ভাবমুখ’ আশ্রয়কারী শ্রীরামকৃষ্ণ সম্বন্ধে লীলাপ্রসঙ্গকার লিখেছেন, ‘ঠাকুর ঐ বিশ্বব্যাপী “আমিকে” আশ্রয় করিয়া অনুক্ষণ থাকিতে পারিতেন বলিয়াই বিশ্বমনে যত ভাবতরঙ্গ উঠিতেছে, সকলই ধরিতে ও বুঝিতে সক্ষম হইতেন।’ এ-কারণে চৈতন্যলীলার সবকিছু ভাবতরঙ্গ শ্রীরামকৃষ্ণের অনুভূতির পর্দায় উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল। সার্বিকভাবে বিচার করলে দেখা যাবে, রামকৃষ্ণদর্পণে প্রতিবিম্বিত শ্রীচৈতন্যের ভাবমূর্তি অপূর্ব সুন্দর এবং সর্বাধিক নির্ভরযোগ্য। বলা বাহুল্য, এই চতুর্থ পদ্ধতিতে প্রাপ্ত শ্রীচৈতন্যের জীবনালেখ্যের সাহিত্যরস সম্পূর্ণ ভিন্ন স্বাদের। একটা দৃষ্টান্ত তুলে ধরা যাক। ‘হরিনাম মূর্তি’ শ্রীচৈতন্য জীবকে প্রেম শিক্ষা দিয়েছিলেন, জনসমাজে হরিনামের প্লাবন বইয়ে দিয়েছিলেন। ‘চির-উন্মদ প্রেম-পাথার’ শ্রীরামকৃষ্ণ যুক্তিবাদী বিজ্ঞান-সচেতন আধুনিক মানুষকে নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে প্রেমধর্ম শেখালেন। সমকালীন গৌড়ীয় বৈষ্ণবগণের ধারণা হয়েছিল যে শ্রদ্ধায় অশ্রদ্ধায় যে-কোন ভাবেই হোক নাম করলেই হয়। কিন্তু শ্রীরামকৃষ্ণ বললেন, তাও কি হয়? তোতাপাখীকে নাম শেখালে সে নামগান করতে থাকে, কিন্তু তাতে তার অগ্রগতি হয় কি? শ্রীরামকৃষ্ণ শেখালেন, ‘নামের খুব মাহাত্ম্য আছে বটে। তবে অনুরাগ না থাকলে কি হয়? ঈশ্বরের জন্য প্রাণ ব্যাকুল হওয়া দরকার।’ চরিতামৃতকারগণ বলেছেন, ‘যত্নাগ্রহ বিনা ভক্তি না জন্মায় প্রেমে।’
আমাদের প্রস্তাবিত পদ্ধতি আলোচনা করার পূর্বেই স্মরণ করা যেতে পারে যে শ্রীরামকৃষ্ণের জীবনবৃত্তান্ত আলোচনাকারীদের মধ্যে কথামৃতকারই কতকটা যেন নিজের অজ্ঞাতসারেই শ্রীচৈতন্যের জীবনালোকে উপস্থাপিত করেছেন শ্রীরামকৃষ্ণকে। কথামৃতের নিবিষ্ট পাঠকমাত্রই লক্ষ্য করবেন যে কথামৃতকার শ্রীচৈতন্যের জীবন ও ভাবধারার সঙ্গে সুপরিচিত বাঙালী পাঠকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন শ্রীরামকৃষ্ণকে। আমরা বিপরীতপমুখে আধুনিক শ্রীরামকৃষ্ণের জীবনালোকে শ্রীচৈতন্যলীলা আস্বাদনের চেষ্টা করব। মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যের ভাবে অভিসিঞ্চিত বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করে এবং লালিত-পালিত হয়ে শ্রীরামকৃষ্ণ স্বভাবতই শ্রীচৈতন্যকে শ্রদ্ধা ও ভক্তি করতেন। কিন্তু তাঁর যুক্তিনিষ্ঠ মনে শ্রীচৈতন্য শুধু একজন মহাপুরুষরূপে প্রতিভাত হয়েছিলেন, তদতিরিক্ত কিছু নন। অবশ্য, অনুসন্ধিৎসু শ্রীরামকৃষ্ণের চেতনালোকে শ্রীচৈতন্যের ভাবমূর্তিখানি ক্রমে বিবর্তিত হতে থাকে। ক্রম-বিবর্তনের সে-কাহিনী বিচিত্র। প্রথম জীবনে শ্রীচৈতন্যের অবতারত্ব সম্বন্ধে স্বাধীনচেতা মননশীল শ্রীরামকৃষ্ণের ছিল সন্দেহ ও সংশয়। এবং সত্যবাক্ শ্রীরামকৃষ্ণ পরবর্তীকালে শিক্ষিত তরুণদের কাছে নিজের পূর্বেকার মনোভাব ব্যক্ত করে বলেছিলেন, ‘আমারও তখন তখন ঐ রকম মনে হত রে, ভাবতুম পুরাণ ভাগবত কোথাও কোন নামগন্ধ নেই—চৈতন্য আবার অবতার!’
স্বামী প্রভানন্দের ‘বাংলার যুগলচাঁদ: শ্রীচৈতন্য ও শ্রীরামকৃষ্ণ’ থেকে