গুরু কে শিষ্য কে?—এই নিয়ে আজকের সমাজে নানা মতভেদ আছে। অনেকে আবার গুরুর সন্ধানে যত্রতত্র ঘুরে বেড়ান, মনোমত গুরুকরণ করবেন এ আশায়। এ ধরণের শিষ্যলাভ একদিকে খুবই ভাল। কারণ এর ফলে শিষ্যের প্রতি গুরুর দায়িত্ব কমে যায়। স্বভাবতই এই শিষ্যরাই গুরুদেবকে পরিচালনা করে থাকেন। তিনি কবে কোথায় যাবেন, কখন কাকে দর্শন দেবেন, কোথায় কি ধরণের ভাষণ দেবেন— সে সব শিষ্যরাই নির্ধারণ করেন। অথচ এমন একদিন ছিল যখন শিষ্যত্ব লাভ করতে হলে গুরুর কাছে রীতিমত পরীক্ষা দিতে হতো। আমরা জানি—গুরুই আপন প্রাণ থেকে(শিষ্যের মধ্যে) প্রাণের সঞ্চার ক’রে থাকেন। কিন্তু সে সব আজ কিংবদন্তীতে পরিণত হতে চলেছে। বর্তমানে কে কাকে শিক্ষা দেবেন, কে কার শিক্ষা নেবেন! সকলেই গুরু হতে চান। ট্রামে-বাসে, পথে-ঘাটে, সর্বত্রই একে অপরকে সুযোগ পেলে তার নিজস্ব মতবাদের গুরুত্ব বোঝাতে চেষ্টা করেন এবং পরস্পরকে অধীনস্থ করতে চান। আজ জ্ঞানী-গুণী বয়োজ্যেষ্ঠদের সম্মান নেই, অনেকে পিতামাতারই বিচার করে। যারা প্রথম গুরুকেই মানলো না, তারা গুরুর মর্ম কি ভাবে বুঝবে? সদ্গুরুর আশ্রিত হয়ে কি ভাবে(গুরুত্ব দিয়ে) শিষ্যত্ব অর্জন করবে? দোষ কার? প্রাচীনরা বলেন— যুগের হাওয়া। আর নবীনরা প্রাচীনদেরই দায়ী করে। সংসারে বাবা-মা পরস্পর ঝগড়া করেন। স্বামী স্ত্রীকে নির্যাতন করেন। সন্তানেরা ছোট থেকেই দর্শকের ভূমিকায় নীরবে এসব দেখে ও বোঝে। আমরা এভাবে পিতামাতার প্রতি সন্তানের স্নেহ-ভালবাসা, ভক্তি-শ্রদ্ধার পাত্রটিকে ক্রমশ বিষিয়ে তুলছি। অকালেই তাদের পিতৃ-মাতৃ হত্যার কারণ হচ্ছি। নিজের সামর্থ্য সীমার তুঙ্গে উঠে ছেলে মানুষ করছি। সন্তানকে মনোমত গড়তে গিয়ে তার বশেই চলেছি! সে আকাশের চাঁদ চাইলে তাও দেবার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করি। তারপর একদিন আর্থিক সামর্থ্যের ভারসাম্য হারিয়ে তার ভবিষ্যতকে মাঝদরিয়ায় ভরাডুবি করি। স্বভাবতই সন্তান বেপরোয়া উচ্ছৃঙ্খল হয়ে ওঠে। আমরা পরিবেশের দোষারোপ করি, ভাগ্যের দোহাই দিই। কিন্তু আসল ত্রুটি কোথায়? ধর, তোমার বিয়ে হলো। বিয়ের সময় মেয়েটি তোমায় স্বামী বলে বরণ করলো এবং তোমার মা’ও তোমাকে তার হাতে সমর্পণ করলেন। তাহলে কে কার শিক্ষায় শিক্ষিত হবে? আবার বিয়ে করতে যাবার সময় তুমি মা’কে বলে গেলে—‘মা গো, আমি তোমার দাসী আনতে যাচ্ছি।’ ওদিকে শাশুড়ি ঠাকুরণও তোমার হাত দুটি ধরে মিনতি করে বলেছেন—‘বাবা, আজ থেকে আমার মেয়ের সুখ দুঃখের সব দায়িত্ব তোমার।’ তুমি এবার কিভাবে চলবে? গুরু কানে মন্ত্র দিয়ে বললেন—‘নিত্য জপ, ধ্যান, প্রাণায়াম করবি বুঝলি।’ সময় সুবিধা মতন একঘণ্টা তাঁর নামের জন্য রেখে বাকি তেইশ ঘণ্টা নিজের কর্মে লাগালে। ওই একঘণ্টা গুরুর কর্মে ঈশ্বরের দর্শন বা ভগবৎ উপলব্ধি হবে কি? যদি না হয় তার জন্য দায়ী কে?
আজ পুত্রের ধর্ম হলো পিতৃ অবমাননা করা, ছাত্রের ধর্ম শিক্ষক অবমাননা করা, স্বামী-স্ত্রীর ধর্ম একে অপরকে অবমাননা করা, শিষ্যের ধর্ম গুরুর বাক্য মেনে না চলা। পিতা-মাতা, স্বামী-স্ত্রী, ছাত্র-শিক্ষক, গুরু-শিষ্য—এঁরা কোন না কোন সংসারেই জন্মেছেন। সুতরাং সংসারই মূল, সংসারই আদি। কিন্তু সংসার কার? পিতা বলে আমার, স্ত্রী-পুত্র-কন্যা বলে আমার-আমার। অন্যের কথা বাদ দাও, তোমাকেই একটি ছোট্ট প্রশ্ন করি— তুমি সংসারের না সংসার তোমার? যদি বলো—সংসার আমার, তাহলে দেহত্যাগের পর সংসারটাকে সংগে নিয়ে যেতে পারবে তো?
শ্রীশ্রী আচার্য জ্ঞানেশ্বরদেব প্রণীত ‘জ্ঞানেশ্বরোপনিষদ্’ (৩য় খণ্ড) থেকে