বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
গল্পের পাতা
 

গুপ্ত রাজধানী: দারা শিকোহের গ্রন্থাগার
সমৃদ্ধ দত্ত

রামায়ণকে বুঝতে হলে, হিন্দু শাস্ত্রের অন্তর্নিহিত দর্শনকে আত্মস্থ করতে হলে, যোগ বশিষ্ট পাঠ করা দরকার। আর শুধু পাঠ করা নয়, প্রজাদের মধ্যেও ছড়িয়ে দেওয়া হবে। সম্রাট শাহজাহানের জ্যেষ্ঠ পুত্র দারা শিকোহকে একথা বলেছিলেন দরবারের অন্যতম হিন্দু পণ্ডিত চন্দ্রভান ব্রাহ্মণ। দারা শিকোহ উৎসাহিত হয়ে তাঁকেই বললেন, তাহলে কাজটা শুরু করা যাক। সরাসরি সংস্কৃত থেকে ফারসিতে অনুবাদ করা হবে যোগ বশিষ্ঠ। চন্দ্রভান জানিয়ে দেন তিনি অনুবাদকের ব্যবস্থা করছেন। তিনি নিজে সেই অনুবাদককে সাহায্য করবেন। অতএব অনুবাদক এসেছেন দারা শিকোহের কাছে। তাঁর হাতে দু’টি বই। দুটোই হিন্দু শাস্ত্র যোগ বশিষ্ঠ। একটি আলবেরুনির অনুবাদ করা। আর অন্যটি আকবরের সময়ে করা। দুটো থেকেই পাঠ করতে হবে অনুবাদককে। কেন? কারণ এই দু’টি অনুবাদের মধ্যে অনেক কিছুই যেন বাদ গিয়েছে। বিশেষ করে দারা শিকোহ জেনেছেন যে, প্রচুর সংস্কৃত শ্লোক রয়েছে, সেগুলির অনুবাদ করা হয়নি। হয়তো অর্থ বোঝা সম্ভব হয়নি তৎকালীন অনুবাদকের পক্ষে। তাই তিনি চান আবার হিন্দু শাস্ত্রগুলো এবং মহাকাব্য দুটো অনুবাদ করতে। তবে সবথেকে যেটা দারা শিকোহের পছন্দ এবং রহস্যময় মনে হয়, সেটা হল উপনিষদ। ওটার ফারসি অনুবাদ করাতেই হবে। 
কিন্তু হঠাৎ মুঘল যুবরাজের রামায়ণ কিংবা যোগ বশিষ্ঠ সংস্কৃত থেকে ফারসিতে অনুবাদ করার ইচ্ছা হল কেন জানেন?
অনুবাদককে দারা শিকোহ নিজেই প্রশ্নটি করলেন। 
অনুবাদক জানেন না। মাথা নাড়লেন। 
দারা বলেন, আপনাকে বলিনি? শুনুন তবে। আমার ঘুমের মধ্যে স্বপ্নে দেখলাম দু’জন মানুষকে। একজনের লম্বা সাদা দাড়ি। দীর্ঘ দেহ। অন্যজন সৌম্যসুন্দর। প্রথম জন ঋষি বশিষ্ঠ। দ্বিতীয়জনের সঙ্গে তিনিই পরিচয় করিয়ে দিলেন। তিনি হলেন, রামচন্দ্র। ঋষি বশিষ্ঠ একটা আশ্চর্য কথা জানালেন। বললেন, শোনো দারা, তুমি হলে দর্শনগতভাবে রামচন্দ্রের ভ্রাতা। কারণ কী জানো? তুমিও রামচন্দ্রের মতোই সত্যসন্ধানী। সত্যপূজারি। রামচন্দ্র এরপর ঋষি বশিষ্ঠের নির্দেশে আমাকে আলিঙ্গন করলেন। তারপর আমাকে বললেন, যোগ বশিষ্ঠ অনুবাদ করতে। 
যুবরাজ দারা শিকোহের প্রপিতামহ সম্রাট আকবর তাঁর সভাসদ আবুল ফজলের সাহায্যে একটা বিশেষ পরিকল্পনা নিয়েছিলেন। রামায়ণ, মহাভারত, যোগ বশিষ্ঠ অনুবাদ করা। আকবরের লক্ষ্য ছিল, ভারতে সুশাসন ও শান্তি কায়েম করার জন্য ধর্ম ও সংস্কৃতির আদানপ্রদান জরুরি। তাই তিনি মহাভারত, রামায়ণ কিংবা অন্য হিন্দু শাস্ত্র অনুবাদ করিয়েছিলেন। দারা শিকোহের এমনিতেই হিন্দু ধর্মের প্রতি আকর্ষণ ছিল। আর এজন্য তাঁর মেজো ভাই তাঁকে কাফের সম্বোধন করতেন। এই অনুবাদের কথাবার্তা চলছে ১৬৫৬ সালে। ওই মেজো ভা‌঩ইয়ের সঙ্গে দারা শিকোহের সিংহাসন নিয়ে শেষ বোঝাপড়া হবে আর কয়েক বছরের মধ্যেই। তবে সে অন্য কাহিনি। 
এখানেই শেষ নয়। দারা শিকোহ পরের বছর উপনিষদের অনুবাদের কাজে হাত দিলেন। সেই কাজ করার জন্য বারাণসী থেকে নিয়ে এসেছেন হিন্দু সন্ন্যাসী, শাস্ত্রকার ও পণ্ডিতদের। আর এসব চোখের সামনে দেখে তাঁর এক বোন নিয়ম করে সব খবর পাঠাচ্ছিলেন মেজো দাদার কাছে। সেই বোনের নাম রোশন আরা। যিনি ছিলেন সেই মেজো ভাই অর্থাৎ আওরঙ্গজেবের ভক্ত। আর বড় বোন জাহান আরার টান বেশি বড়দা দারা শিকোহের প্রতি। ১৬৫৭ সালের ২৮ জুন উপনিষদের অনুবাদ সমাপ্ত হল। কতটা আগ্রহী ও উত্তেজিত ছিলেন দারা শিকোহ এই অনুবাদগুলি নিয়ে? ওই গোটা সময়কালে তিনি চেষ্টা করেছেন একদিনের জন্যও দিল্লি ছেড়ে অন্য কোথাও না যেতে। সচরাচর তিনি পিতার অসুস্থতার কারণে সর্বদাই তাঁর সঙ্গী হতেন। এক্ষেত্রে একবার সম্রাট শাহজাহান দিল্লির বাইরে গেলেও দারা যাননি। কারণ এই অনুবাদ।
 উপনিষদ অথবা যোগ বশিষ্ঠ কিংবা মহাভারত, রামায়ণ এসব যে ফারসি ভাষায় অনুবাদ করা হবে, সেজন্য আসল সংস্কৃত বইগুলো দরকার তো? কোথায় পাওয়া যাবে? পাওয়া যাবে দারা শিকোহের গ্রন্থাগারে। সন্ন্যাসী, পণ্ডিত, অনুবাদক, আলোচক সকলেই থাকতেন দারা শিকোহের এই প্রাসাদে। যার নাম মঞ্জিল এ নিগমবোধ! সেই প্রাসাদের একাংশে ১৬৩৭ সালে দারা শিকোহ নির্মাণ করেছিলেন একটি অত্যন্ত সম্পদশালী গ্রন্থাগার। ভারতের পাশাপাশি পারস্য, সমরখন্দ থেকে নিয়ে আসা বিরল গ্রন্থ থাকত। সেই গ্রন্থাগারেই এসে অনুবাদকরা পড়তেন মূল গ্রন্থ এবং লিখতেন নতুন অনুবাদ। সম্রাট  শাহজাহান দু’বার এসেছিলেন এই গ্রন্থাগার সংলগ্ন দারা শিকোহের দরবারে দেখা করতে। 
দারা শিকোহের গ্রন্থাগার ছাড়াও সেখানে এখন হয়েছে পার্টিশন মিউজিয়ম। দেশভাগের স্মৃতি। দারা শিকোহের সেই গ্রন্থাগার ভবন দেখতে হলে আসতে হবে আম্বেদকর বিশ্ববিদ্যালয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণের মধ্যেই অবস্থান করছে সেই ঐতিহাসিক ভবন। 
শুধুই কি দারা শিকোহের গ্রন্থাগার? না। এই ভবন যেন পণ করেছিল যে, সে যতদিন নিজস্ব কাঠামো নিয়ে বেঁচে থাকবে, ততদিন নিত্যনতুন ইতিহাসের দিনলিপি লিপিবদ্ধ করে রাখবে নিজের গাত্রে। অতএব ১৭৩৯ সালে যখন পারস্য থেকে নাদির শাহ এসে দিল্লি আক্রমণ করে গণহত্যা এবং লুটপাটের এক চরম নৃশংসতার পৃষ্ঠা রেখে গিয়েছিলেন, তখন এই দারা শিকোহের প্রাসাদে থাকতেন অওধের প্রথম নবাব। সাদাত খান। যে সাদাত খানের কথা ছিল মুঘল সম্রাট মহম্মদ শাহ রঙ্গিলা ও সাম্রাজ্যকে রক্ষা করা। অথচ তিনিই যোগ দিয়েছিলেন নাদিরের পক্ষে। তিনিই প্ররোচনা দিয়েছিলে নাদিরকে আরও বেশি টাকা আদায় করতে। কিন্তু সেই নাদির শাহ যাওয়ার আগে সাদাত খানকে চরম অপমান করেন। আর পরদিন এই দারা শিকোহ প্রাসাদেই সাদাত খান আত্মহত্যা করেন। সিপাহি বিদ্রোহের সময় দিল্লিতে ঢুকে পড়া সিপাহিরা এই  প্রাসাদেই গড়ে ওঠা দিল্লি কলেজের ব্রিটিশ প্রিন্সিপাল জে টেলর সাহেবকে হত্যা করে।
পরবর্তীকালে এই ভবনে কে থাকতে এলেন? ব্রিটিশ রেসিডেন্ট ডেভিড অক্টারলোনি! কে তিনি? ওই যে আমাদের কলকাতার ময়দানে দাঁড়িয়ে থাকা শহিদ মিনার যাঁর নামে! অক্টারলোনি মনুমেন্ট! দিল্লির সঙ্গে অক্টারলোনির আর কী কী আকর্ষণীয় কাহিনি যুক্ত? সে অন্য গল্প! আপাতত আমরা দেখব দারা শিকোহের গ্রন্থাগার! ইতিহাসের গতি বিচিত্র! 

31st     March,   2024
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
বিশেষ নিবন্ধ
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ