গল্পের পাতা

কেয়ামত
বিপুল দাস 

বিলের জলে তাকিয়ে ছিল সাধু। একটু দূরে একটা গাছের ডালে বসে মাছরাঙাটা ঘাড় কাত করে একবার সাধুকে দেখল। সাধুর স্পষ্ট মনে হল ওর চোখে যেন একটা তাচ্ছিল্য রয়েছে। একটু আগেই বিলের একদম কিনারা থেকে ছোঁ মেরে একটা মাছ ঠোঁটে তুলে নিয়ে গেছে পাখিটা। আর প্রায় একঘণ্টা হতে চলল সাধুর জালে একটা বড় মাছ তো দূরের কথা, চুনোপুঁটিও ওঠেনি।
এমন নয় যে, মাছ ধরে সেই মাছ বিক্রি করে তার সংসার চলে। সে আসলে বেড়া বাঁধে। বড় পোক্ত হয় তার বেড়ার বাঁধন। ফলত, তার কাজের অভাব হয় না। লোকজন দরকার পড়লে তাকেই খুঁজে বেড়ায়। সাধুর হাতের বাঁধন বড় কড়া। বছরকার ঝড়-জল-রোদ্দুরে কাঠ-বাঁশ পচে খসে পড়ে, কিন্তু তখনও বাঁধন পোক্ত থেকে যায়। দরকার পড়লে সবাই সাধুর খোঁজ করে। কাজ করার শর্ত তার একটাই। হাজিরায় তুমি দুটো পয়সা কম দাও, আপত্তি নেই। কিন্তু দুপুরে তাকে একথালা ভাত দিতে হবে। সঙ্গে ডাল বা কোনও সব্জি থাকলে তো কথাই নেই। নইলে একটা পেঁয়াজ আর দুটো কাঁচালঙ্কা। দিব্যি হয়ে যায় তার।
‘ও সাধু, আর একহাতা ভাত দেব?’
সাধু মাথা নাড়ে। হ্যাঁ বা না কিছুই বোঝা যায় না তার এই মাথা নাড়ানোয়। কিন্তু বাড়ির বউ-ঝিরা জানে প্রথমে কলাপাতায় চুড়ো করে সাজিয়ে দেওয়া ভাতের পরেও আরও অনেক ভাত তাকে বেড়ে দিলেও সাধু আপত্তি করবে না। ঠিক দুপুরে নয়, সে তার নিজের মনে বেড়া বাঁধতে থাকে। দুপুর গড়িয়ে সূর্য একটু পশ্চিমে নামলে তার কাজ শেষ হয়। নদীতে গিয়ে ভালো করে স্নান করে। ফিরে এসে একটু তেল চেয়ে নেয়। শরীরে ডলে নেয়। তারপর পেছনের বাগান থেকে নিজেই একটা কলাপাতা কেটে আনে। পাত পেড়ে উঠোনের এককোণে বসে পড়ে। তার কাজ দেখার দরকার পড়ে না। সবাই জানে তার কাজে কোনও ফাঁকি নেই। বজ্র-আঁটুনি দিয়ে সাধু বেড়া বেঁধেছে। অন্তত দু’বছরের নিশ্চিন্দি। খাওয়া সেরে আয়েস করে একটা বিড়ি ধরায় সাধু। বেশ ক’বার আকাশের দিকে তাকিয়ে কী যেন দেখে। তারপর হাজিরার টাকা ট্যাঁকে গুঁজে রওনা হয়।
‘ও সাধু, তুমি আকাশের দিকে তাকিয়ে কী দেখ?’
 শুধু গোপী সরকারের বউ রাধা বলে নয়, ব্যাপারটা অনেকেই লক্ষ করেছে। আকাশে সাধু কী দেখে। দিনের বেলায় তো আর চাঁদ-তারা দেখার কথা নেই, তবে বেশ ভুরু কুঁচকে পশ্চিম আকাশে কী দেখে সাধু। কী খোঁজে।
গোপী সরকারের বউয়ের কথা শুনে সাধু যেন একটু লজ্জা পেল। তার আকাশ দেখা কেউ লক্ষ করেছে, কৌতূহলী হয়েছে— এটা তার কাছে আশ্চর্য ব্যাপার। সে তো ঠিক নিজেও জানে না। বিড়ির নীলচে ধোঁয়া বাতাসে মিশে যাচ্ছে, তখন হঠাৎ কেন যেন সেই জলের কথা মনে পড়ে। সেই বাদলা দিনের কথা। সেদিন তার বিলের জলে জাল মারতে ইচ্ছে করছিল না। এরকম মেঘ-মেঘ দিনে শরীরে কেমন যেন আলিস্যি জড়ায়। নড়তে চড়তে ইচ্ছে করে না। কাল সারারাত জল ঝরেছে। বেড়া বাঁধার কাজকর্ম আজ পাওয়ার আশা নেই। কিন্তু ভেতরে ভেতরে একটা উত্তেজনা কাজ করছিল। নালাডোবা, বিলপুকুর আজ জলে থই থই করছে। কোথাকার মাছ উজিয়ে নতুন জলের গন্ধে কোথায় চলে যাচ্ছে। গাবের আঠা দিয়ে পোক্তকরা সুতো দিয়ে পুরনো জাল মেরামত করেছে সাধু। সাতমনি বোয়ালেরও সাধ্য নেই সে সুতো ছেঁড়ার। সে নাকি জলের ভেতরে মাছের গন্ধ পায়— লোকজন বলাবলি করে।
তার শরীর আইঢাই করছিল। মনে হল আজ জাল নিয়ে না বেরলে তার জীবন বৃথা। আর এই মাছের কথা ভাবলে তার বড় আশ্চর্য লাগে। খালে ডোবায় বিল পুকুরে নতুন জল এসে পড়লেই ওদের যেন প্রাণে ফুর্তি জাগে। দল বেঁধে চলল স্রোতের উল্টো দিকে। যেন খুব কৌতূহল, এত জল কোথা থেকে আসছে। আসল কারণ অবশ্য তার অজানা নয়। পুরনো জায়গা থেকে ছড়িয়ে পড়তে চায়। ধানখেত আর পুকুর একাকার হয়ে গিয়েছে। বাঁধাধরা এই জলের জগৎ ছেড়ে আরও বড় কোথাও গিয়ে যদি ডিম ছেড়ে আসতে পারে, তবে নিশ্চিন্ত হওয়া যায়। হ্যাঁ, তার বংশ আর নির্বংশ হওয়ার ভয় থাকল না। কে জানে, কোথা থেকে ওরা এসব বুদ্ধি পায়। ওদের মাথার ভেতরে লেখা থাকে নাকি— নতুন জলের দিকে উজিয়ে যাওয়ার কথা। সাধু শুনেছে ডিম ছাড়ার জন্য ইলিশ নাকি সমুদ্দুরের নোনাজল ছেড়ে হাজার হাজার মেইল উজিয়ে যায় মিষ্টিজলের দিকে। ফেরার পথে আর সবাই সাগরে ফিরতে পারে না। বেশির ভাগ মাছ ক্লান্তিতেই মরে যায়। কিছু জালে ধরা পড়ে। সামান্য কিছু মাছ ঘরে ফিরতে পারে। তবু তাদের যেতেই হয়।
মাঝে মাঝে আকাশের দিকে তাকানো তার কেমন যেন নেশায় দাঁড়িয়েছে। সবাই জানে সাধু মিস্ত্রির এটা বাতিক। আগুনে গোলার দাপে যখন আকাশ পুড়ে ঝামা হচ্ছে কিংবা আকাশজুড়ে ঘনমেঘের সাজ জমাট হয়ে সেঁটে আছে— একটা বিড়ি ধরিয়ে তার নীলচে ধোঁয়া বাতাসে ভাসিয়ে কিছুক্ষণ আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে সাধু। কে জানে কী দেখে সাধু। খরার মেঘ, নাকি বাদুলে মেঘ— সেই লক্ষণ দেখে। নাকি পোড়া আকাশের কোথায় একটু মেঘ ঘনাল কি না— সেটা খোঁজে।
সেদিন একটু বেলা বাড়তেই কাঁধে জাল ফেলে সাধু বেরিয়ে পড়ল। কাল সারারাত তুমুল বৃষ্টি ছিল। একটু শীত-শীত করছিল সাধুর। গায়ে একটা কাঁথা টেনে নিয়েছিল। বিকেলে পরান অধিকারীর বাড়িতে বেড়া বাঁধা শেষ করে একথালা ভাত খেয়েছে মুসুরির ডাল আর পেঁয়াজ দিয়ে। পরানের ছেলের বউ আবার শেষ পাতে চুনোমাছের ঝোল দিলে আরও একটু ভাত চেয়ে নিয়েছিল সাধু। তারপর বিড়ি ধরিয়ে আয়েস করে টান দিয়েছিল। হরি সাহার কালোসুতোর হাতবাঁধা বিড়ি। ধকই আলাদা। তারপর আকাশ দেখেছিল। পশ্চিমে একটুকরো কালো মেঘ খুব তাড়াতাড়ি আকাশের দখল নিচ্ছে। রাতে নামতে পারে। খুশি হয়ে বিড়িতে একটা বিধ্বংসী টান দিল সাধু। আগুন ঘুনসিতে নেমে গেলে সাধু ভাবল কাল আর কাজে বেরবে  না। জাল সারিয়েছে, কাল কালাংগির বিলে যাবে। তারপর সকালে ঘুম ভাঙলে দরজা খুলে দেখল পৃথিবীজুড়ে মেঘলা হয়ে আছে। কেমন একটা মন খারাপের আলো ছড়িয়ে আছে ঘরবাড়ি, গাছপালার উপর। বাতাসে একটু ঠান্ডা ভাব রয়েছে। আবার গিয়ে শুয়ে পড়তে ইচ্ছে করছে। চোখে বাকি একটুখানি ঘুম জড়িয়ে আছে। চা বানিয়ে মুড়ি দিয়ে খেল সাধু। তার একার সংসার। বউ একটা ছিল, মাধবী, সে কোন কালের কথা। মাধবী তাকে ছেড়ে নতুন জল পেয়ে উজিয়ে কোথায় যেন চলে গিয়েছে। সাধু জানত খুঁজে লাভ নেই, সাধু ঘরামির সংসার করার জন্য মাধবী বড় বেশি দামি। আর একটু সাধারণ, কম দামি বউ দরকার ছিল তার। মা বলত পেতলের কলস আর মাটির কলস মিলমিশ হয় না। খাঁটি কথা।
কালো মেঘ নিচু হয়ে ঝুলে রয়েছে। খুব হালকা গুঁড়িগুঁড়ি কুয়াশার মতো জলের বিন্দু বাতাসে ভাসছে। ঝুলে থাকা মেঘ ভেঙে যেকোনও সময় মুষলধারায় নামতে পারে। বেরিয়ে পড়বে কি না, ইতস্তত করছিল সাধু। এরকম দিনগুলোতে শরীর কেমন যেন উপোসি একটা ময়াল সাপের মতো আড়মোড়া ভেঙে জেগে ওঠে।
জাল কাঁধে বাইরে বেরিয়েই সাধু দেখল তার বাড়ির সামনের নালা দিয়ে নদীর মতো জল বইছে। আহা, এমন দৃশ্য দেখলে সাধুর মন ভারী ভালো হয়ে ওঠে। ওই জল বেয়ে নদী পুকুর থেকে উঠে আসছে মাছের ঝাঁক। মাঠাঘাটের জলে ছড়িয়ে পড়ছে। জলের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়ে উঠতে থাকে আউশধানের মাথা। ধানখেতের জলে ঘুরে বেড়ায় শিঙি, মাগুর, কই, শোল, পুঁটি, খলসের দল। হঠাৎ কোনও ধানগাছের নড়ে ওঠা দেখে সাধু বুঝতে পারে ওখানে বড় মাছ নড়েচড়ে বেড়াচ্ছে। না, ওখানে নয়, সাধু আজ কালাংগির বিলে যাবে। বিল আজ সমুদ্দুর হয়ে উঠেছে। আজ গভীর জলের মাছ বিলের ধারে আসবে। গেরস্তবাড়ি, বাজারহাট, মাঠাঘাট— সব ধুয়ে জল শেষতক গিয়ে পড়ে ওই বিলে। খাবারের লোভেই মাছগুলো কিনারায় ঘোরাঘুরি করে। পথ পেলে বেরিয়ে গিয়ে মাঠাঘাটে চরে বেড়ায়, ডিম ছেড়ে আসে। তারপর যখন বুঝতে পারে জলে টান ধরেছে, ফিরে আসে নিজের ঘরে।
সত্যিই আজ কালাংগির বিল যেন বিশাল এক সমুদ্দুর। অনেকদূরে গাছপালার অস্পষ্ট ছায়া। আজ আর কোনও নৌকো নেই বিলে। আলতাফের কাছে শুধু নয়, আরও দু’একজন মেছোনৌকোর লোকের মুখে সাধু শুনেছে এক দানোর মতো বিশাল মাছের কথা। সে মাছের দেখা পেতে চায় না মাঝিরা। তার লেজের ঝাপটে ওসব ফঙবেনে নৌকো টুকরো টুকরো হয়ে যাবে। গভীর জলে ঘরবাড়ি। দৈবাৎ জলের বাইরের দুনিয়া দেখবে বলে হয়তো ভেসে ওঠে। পারের লোকজন, দূরের গাছপালা, নীল কিংবা মেঘলা আকাশ, আকাশের মেঘ— এসব দেখে ভারী বজরার চালে একটু ভেসে বেড়ায়। তারপর আবার ডুব দেয় গভীরে। সে মাছ জালে পড়লে শতছিন্ন হয়ে যাবে জাল। আর, সেই জলদেবতার যদি রাগ হয়, তবে উথালপাথাল হয়ে উঠবে কালাংগির বিল। জলস্তম্ভ উঠে আকাশ ছুঁয়ে দেবে, তারপর এই স্তম্ভ যখন ভেঙে পড়বে, প্রলয় নেমে আসবে পৃথিবীজুড়ে। আলতাফ বলেছিল সেটাই নাকি কেয়ামত। মহাপ্রলয়। পৃথিবীর অন্তিম দিন। ইসরাফিল শিঙায় ফুঁ দেবার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়ে যাবে মহাপ্রলয়। আলতাফ আরও বলেছিল সেদিন সবার বিচার হবে, তারপর ঠিক হবে সে বেহেস্তে যাবে, না দোজখে। সুতরাং এই দানব মাছের দেখা কেউ পেতে চাইত না। শুধু যে আলতাফ বা যুধিষ্ঠির দাশ এই গল্প জানত, তা নয়, তারাও তাদের বাপঠাকুরদার মুখে কালাংগির বিলের এই মাছের কথা শুনেছে। হয়তো কোনও দিন কেউ আপনচোখে দেখেছিল তাকে, সেবার হয়তো ভয়ঙ্কর বান এসেছিল। হয়তো খরায় উচ্ছন্নে গিয়েছিল গাঁ-গঞ্জ। মড়কে হয়তো উজাড় হয়েছিল দেশ। সবাই বুঝেছিল এ হল জলদেবতার ভয়ঙ্কর রাগ। নিশ্চয় কেউ তার কোনও ক্ষতি করার চেষ্টা করেছে। এমন কী, হয়তো মনে মনেও ভেবেছে ওই মাছ ধরে বাজারে নিয়ে যাবে। কী ভয়ঙ্কর কথা। ওঁরা তো মানুষের মনের কথাও বুঝতে পারে।
একটা বাতাস উঠল। সূক্ষ্ম জলের রেণু উড়ে এসে জড়িয়ে রইল সাধুর সামনের চুলে। শিরশির করে উঠল সাধুর শরীর। কালাংগির বিল আজ মহাসমুদ্র হয়েছে। আকাশজোড়া কালোমেঘের দিকে তাকিয়ে বুকের ভেতরে ভয় করে উঠল সাধুর। তার সামনে পেছনে ডাইনে বাঁয়ে কোথাও কোনও মানুষজন নেই। একা সে কাঁধে এক জাল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
আচ্ছা, এককাজ করলে হয় না, সাধু একটা বিড়ি ধরিয়ে ভাবল, বিলের কিছুটা সে বাঁশের খুঁটি দিয়ে ঘিরে দেবে। তারপর পোক্ত করে বেড়া দেবে। তারপর সেই ঘেরার ভেতরের জলে ইচ্ছেমতো জাল মেরে মাছ ধরবে। সব মাছ ধরবে না। সবচেয়ে সুন্দর মাছটা সে রেখে দেবে। যেন ঘরের পোষা মাছ। বেড়াটা বাঁশ দিয়ে... না, শক্ত কাঠ দিয়ে ঘিরে দেবে। আর তাও যদি নতুন জলের গন্ধে বেড়া ভেঙে বাইরে যেতে চায়, যদি ওই বিশাল মাছ তাকে ফুঁসলে নিয়ে যেতে চায়... সংসারে তো আর প্রলয় ঘটানোর বড় মাছের অভাব নেই।
এবার আমি বুকের হাড় দিয়ে বেড়া দেব রে মাধু... নীলচে ধোঁয়া আকাশে কালো মেঘের দিকে ভাসিয়ে আপন মনেই বলল সাধু। 
6Months ago
কলকাতা
রাজ্য
দেশ
বিদেশ
খেলা
বিনোদন
ব্ল্যাকবোর্ড
শরীর ও স্বাস্থ্য
বিশেষ নিবন্ধ
সিনেমা
প্রচ্ছদ নিবন্ধ
আজকের দিনে
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
mesh

পারিবারিক অশান্তির অবসানে গৃহ সুখ ও শান্তি বাড়বে। প্রেমের ক্ষেত্রে শুভ। কর্মে উন্নতি। উপার্জন বৃদ্ধি।...

বিশদ...

এখনকার দর
ক্রয়মূল্যবিক্রয়মূল্য
ডলার৮৩.২৬ টাকা৮৪.৩৫ টাকা
পাউন্ড১০৬.৪৬ টাকা১০৯.১২ টাকা
ইউরো৮৯.৭৬ টাকা৯২.২০ টাকা
[ স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া থেকে পাওয়া দর ]
*১০ লক্ষ টাকা কম লেনদেনের ক্ষেত্রে
দিন পঞ্জিকা