গল্পের পাতা

রাজিয়া সুলতানার  সমাধি

সমৃদ্ধ দত্ত: অটো চালাতাম। ভালোই রোজগার হচ্ছিল। তখন তো আর এসব মেট্রো কিংবা এত নানারকম বাসের সুবিধা ছিল না। তাই সেই আয়ে চলে যাচ্ছিল। তাহলে অটো চালানো ছাড়লেন কেন? জানতে চাইলাম জন আন্দ্রিয়াজ লাজারের কাছে। লাজার হেসে বললেন, ঘুম পায়! হঠাৎ একটা সময় দেখছিলাম যে, অটো চালালেই আমার ঘুম পায়। অটোতে উঠে অনেক দূর যাত্রার সময় যাত্রী ঘুমাতেই পারে। তাই বলে চালক যদি দিনেদুপুরেও ঘুমায় চলবে কীভাবে? দুর্ঘটনা হবেই এই ওল্ড দিল্লির ভিড়ে ঠাসা রাস্তায়। তাই ছেড়ে দিলাম। তারপর? সংসার চলল কীভাবে?
ফতেপুরী চার্চের মেম্বার ছিলাম। সেখানে সানডে প্রেয়ারে আসত একটা মেয়ে। জর্জিনা। তার সঙ্গে দেখা হতো। চোখে চোখ পড়ত। তারপর যা হয়! আবার হাসছেন আন্দ্রিয়াজ লাজার। বউ নার্সের চাকরি করত। তাই আমি অটো ছেড়ে ছোটখাট ব্যবসায় ঢুকলাম। ঘুম পেলে রোদ্দুর দেখে ঘুমিয়ে পড়ি। আমার রোদ্দুর ভালো লাগে। 
এই হল তুর্কমান গেট এলাকা। পুরনো দিল্লির দরিয়াগঞ্জের প্রায় কেন্দ্রস্থলে। তুর্কমান নাম কেন? কারণ এখানেই শায়িত আছেন শাহ তুর্কমান। এক সুফি সন্ত। যাঁর ভক্ত ও অনুগামী কে নয়? দাস বংশের কুতুবউদ্দিন আইবক থেকে মুঘল সম্রাট শাহজাহান। সম্রাট শাহজাহান নির্মিত এই তুর্কমান গেটের  দু’দিকে দু’টি গলি ঢুকে গিয়েছে দু‌ই পৃথক মহল্লায়। বাঁ-দিকের গলিতে ঢুকেই দেখা যাবে মিশনারি স্কুল। আর ঠিক পাশেই সামান্য ভিতরে ঢুকে গেলেই সামনে এসে হাজির হবে হোলি ট্রিনিটি চার্চ।  ১৯০৪ সালে সেই চার্চ স্থাপন করেন কয়েকজন মিশনারি। যাঁদের অন্যতম অ্যান্ড্রুজ। এই জন আন্দ্রিয়াজ লাজার সেই অ্যান্ড্রুজ লাজারের প্রপৌত্র। 
এই গল্প কি তাহলে জন আন্দ্রিয়াজের? না। 
এই গল্প কি তাহলে তুর্কমান গেটের ইতিহাসের? না। 
এই ভ্রমণ তুর্কমান গেটের ডানদিকের গলির পিছনে যে মহল্লা, সেই অঞ্চলের এক প্রায়ান্ধকার আলো না আসা এক এলাকায় সকলের অগোচরে দু’টি সমাধি দর্শনের। রহস্যময় সমাধিদ্বয়। তুর্কমান গেটের পাশেই মসজিদ-ই-তুর্কমান বায়াবনি। দীর্ঘ, প্রশস্ত ও কারুকার্যখচিত। এই মসজিদকে বাঁদিকে রেখে হেঁটে চলতে হবে সংলগ্ন রাস্তা দিয়ে। 
পুরনো দিল্লি, চাঁদনি চক আর দরিয়াগঞ্জের মহল্লাগুলি যেমন হওয়ার কথা, অবিকল সেইরকম এই গলি দিয়ে সোজা হেঁটে যেতে হবে। ঠিক যেখানে এই গলি বাঁদিকে বেঁকে চলে যাবে চৌরি বাজারের দিকে, সেখানে থমকে দাঁড়িয়ে যাওয়া দরকার ডানদিকে। যা আদতে আরও সরু এক গলি। এই হল বুলবুলিখানা। এরকম নাম কেন? কেউ বলবে পায়রার জন্য। কেউ বলবে জেনানাহারেম ছিল রাজারাজড়া-বাদশাহদের। সেই সব নগরনটীদের নাম ছিল বুলবুলি। কোনটা সত্যি? 
এই গলির গলি এবং তস্য গলি যখন প্রায় এক ভুলভুলাইয়া অন্ধকারাচ্ছন্ন পাঁচিলের সামনে এনে দাঁড় করাচ্ছে কৌতূহলী আগন্তুককে, তখনই  সূর্যালোক না আসা এক পাঁচিলের সামনে দেখা যাবে একটি বোর্ড। অস্বচ্ছ বোর্ডে লেখা এক বিস্ময়কর নাম! রাজিয়া সুলতানার সমাধি!
 বর্গক্ষেত্র একটি পরিসর। সামনেই পাথর দিয়ে তৈরি একটি প্ল্যাটফর্ম। যার উপরে রয়েছে দু’টি সমাধি। পাশাপাশি। প্রথম সমাধি রাজিয়া সুলতানের। দাস বংশের সম্রাট ইলতুৎমিসের কন্যা। ভারতের প্রথম ও শেষ দিল্লি সাম্রাজ্যের সম্রাজ্ঞী। যেন বিশ্বাস হতে চায় না। ইতিহাসের বিখ্যাত রাজিয়া সুলতানের সমাধি এরকম এক অন্ধকার গলির মধ্যে চরম অনাদর আর অতি সাধারণভাবে রক্ষিত? 
ভিতরে যাওয়ার জন্য কোনও টিকিট লাগে না। টিকিট কীসের? আসে ক’জন দেখতে? নগণ্য। ইতিহাসের অনুরাগী কালেভদ্রে কিছু মানুষ। গবেষক। আর কখনও সখনও এক-আধজন পর্যটক।
বারংবার রহস্যময় শব্দটি ব্যবহার করা কেন হচ্ছে? কারণ, সত্যিই রহস্যে ঢাকা। রাজিয়া সুলতান আর তাঁর প্রেমিককে হরিয়ানায় একটি গাছের নীচে বিশ্রামরত অবস্থায় হত্যা করেছিল কিছু ডাকাতদল। আবার অন্য অভিমত হল ডাকাত নয়, গ্রামবাসীরা। আর সেই গ্রামবাসীদের নিযুক্ত করেছিল রাজিয়ার ভাইয়েরাই। যাদের সিংহাসনে না বসিয়ে সম্রাট ইলতুৎমিস কন্যা রাজিয়াকে নিজের উত্তরাধিকার দিয়ে যান। কিন্তু ভা‌ই঩য়েরা কিংবা সেনাপতিরা সেটা মানবে কেন? একটা বাচ্চা মেয়েকে সম্রাজ্ঞীর সম্মান? নারীর থেকে নিতে হবে রাজ্যশাসন কিংবা যুদ্ধের নির্দেশ? অতএব ইলতুৎমিসের মৃত্যুর পর সেই নির্দেশিকা অগ্রাহ্য করা হল। সিংহাসনে বসেছিল রুকনুদ্দিন। ইলতুৎমিসের এক পুত্র। কিন্তু সে ছিল রাজ্য শাসনে ক্ষমতাহীন।  সব ক্ষমতা কুক্ষিগত করেছিলেন রুকনুদ্দিনের মা। শাহ তুর্কান। সেদিন থেকে শুরু হল নারী বনাম নারীর সংঘাত। রাজিয়া চান পিতার ইচ্ছা অনুযায়ী সিংহাসনে আসীন হতে। আর তাঁর সৎমা ওই শাহ তুর্কান সেটা হতে দেবেন না। 
সিংহাসনের লড়াইয়ে যা দস্তুর সেটাই শুরু হল। অর্থাৎ গুপ্তহত্যা, গ্রেপ্তার করে হত্যা, পথের কাঁটাদের সরিয়ে দেওয়া। ঠিক এভাবেই ফাঁস হল যে, রাজিয়ার বিমাতা গোপনে রাজিয়াকে হত্যা করার চক্রান্ত করেছেন। সেকথা চর মারফত জানতে পেরেই রাজিয়া মসজিদে এক প্রার্থনাসভার পর জনতাকে সরাসরি প্ররোচিত করে যে, এই কুশাসন আর গণহত্যার প্রতিশোধ নিতেই হবে। রাজিয়ার সেই আহ্বানে কাজ হয়। প্রধানত জনগণের চাপেই ক্ষমতাচ্যুত হয় রুকনুদ্দিন। 
কিন্তু সাড়ে তিন বছরের মধ্যেই পালাবদল। রাজিয়া সুলতানের অতিরিক্ত সক্রিয়তা পছন্দ হল না তাঁর নিজের সেনাপতি কিংবা সুবেদারদের। প্রথমে রাজিয়া বোরখা আর পর্দার আড়ালে ছিলেন। জনগণের সামনে সরাসরি আসতেন না। কিন্তু তৃতীয় বছরে রাজিয়া পুরুষের পোশাকে দরবারে বসা শুরু করলেন। নিজের নামে মুদ্রা প্রচলন শুরু হল। যা যেকোনও শাসকের একচ্ছত্র ক্ষমতার প্রদর্শন প্রবণতা। চক্রান্ত, যুদ্ধ ও পরাজয়। রাজিয়ার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার কাহিনি ইতিহাসে সর্বজনবিদিত। প্রেমিক আলতুনিয়াকে সঙ্গী করে রাজিয়া শেষ চেষ্টা করছিলেন পুনরায় মসনদ ফিরে পেতে। পারলেন না। সৈন্যদল তাঁদের দু’জনকেই পরিত্যাগ করে চলে যায় বিরুদ্ধপক্ষে। আর তারপর রাজিয়াকে হত্যা করা হয় হরিয়ানায় একটি গাছের নীচে। 
রহস্য হল হরিয়ানায় যাঁকে হত্যা করা হয়েছে, তাঁর মৃতদেহ অনেক দূরের এই পুরনো দিল্লিতে কেন আনা হল? ওই ১২৪০ সালে পুরনো দিল্লি, শাহজানাবাদ বলে কিছু ছিলই না। ছিল জঙ্গল আর যমুনা। এখানে এসে এই বুলবুলিখানায় রাজিয়াকে সমাধি দিল কে? কেন? একটি অভিমত হল, শাহ তুর্কমান সন্তের ভক্ত ছিলেন রাজিয়া। অন্য অভিমত হল, মৃত্যুর পরও তাঁকে লোকচক্ষুর আড়ালে সরিয়ে রাখতেই এই 
সমাধি নির্বাসন। 
বুলবুলিখানার রহস্য সমাপ্ত হচ্ছে না। আজও প্রশ্ন একটাই। রাজিয়া সুলতানের পাশের ওই সমাধি কার? প্রেমিক আলতুনিয়ার? নাকি বোন সাজিয়ার? ইতিহাস নীরব। শুধু পুরনো দিল্লির এক প্রায়ান্ধকার গলির সমাধিস্থলে সন্ধ্যা হলে পাওয়া যায় একঝাঁক পায়রার ডানা ঝাপটানোর শব্দ! রাজিয়ার হাহাকার? 
6Months ago
কলকাতা
রাজ্য
দেশ
বিদেশ
খেলা
বিনোদন
ব্ল্যাকবোর্ড
শরীর ও স্বাস্থ্য
বিশেষ নিবন্ধ
সিনেমা
প্রচ্ছদ নিবন্ধ
আজকের দিনে
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
mesh

পারিবারিক অশান্তির অবসানে গৃহ সুখ ও শান্তি বাড়বে। প্রেমের ক্ষেত্রে শুভ। কর্মে উন্নতি। উপার্জন বৃদ্ধি।...

বিশদ...

এখনকার দর
ক্রয়মূল্যবিক্রয়মূল্য
ডলার৮৩.২৬ টাকা৮৪.৩৫ টাকা
পাউন্ড১০৬.৪৬ টাকা১০৯.১২ টাকা
ইউরো৮৯.৭৬ টাকা৯২.২০ টাকা
[ স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া থেকে পাওয়া দর ]
*১০ লক্ষ টাকা কম লেনদেনের ক্ষেত্রে
দিন পঞ্জিকা