গল্পের পাতা

কিংবদন্তি বেতারনাট্য প্রযোজক শ্রীধর

তরুণ চক্রবর্তী: ১৯৬৬ সালের জানুয়ারি মাসের একটি দিন। আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্রে একটি নাটকের রেকর্ডিংয়ের জন্য অভিনেতারা সমবেত হয়েছেন। তাঁরা অপেক্ষা করছেন নাটকের প্রযোজকের জন্য। মহড়ার দিনেও যে মানুষটি আগে থেকেই দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতেন শিল্পীদের স্বাগত জানাতে, কই আজ তো তাঁকে দেখা যাচ্ছে না। অভিনেতারা সে বিষয়েই নিজেদের মধ্যে বলাবলি করছিলেন। কিন্তু রেকর্ডিংয়ের নির্ধারিত সময় সাড়ে ৯টা থাকলেও ঘড়ির কাঁটা যখন ১১টা ছুঁতে চলেছে, সবাই বেশ চিন্তায় পড়ে গেলেন। এমনটা তো অস্বাভাবিক, বিশেষ করে এই প্রযোজকের সময়ানুবর্তিতা যে দৃষ্টান্ত যোগ্য!
অবশেষে তিনি এলেন, কিছুটা বিধ্বস্ত যেন। হন্তদন্ত হয়ে ঢুকলেন। কারও সঙ্গে কোনও কথা না বলে সোজা গিয়ে বসলেন ড্রামা স্টুডিওর রেকর্ডিং রুমে। ঝোলা থেকে নাটকের স্ক্রিপ্টটা বের করলেন। এরপরই অভিনেতারা শুনতে পেলেন তাঁর সংক্ষিপ্ত দু’টি কথা, ‘সবাই রেডি? এবার রেকর্ডিং শুরু করছি।’
রেকর্ডিং শুরু হল, এক সময় শেষও হল নির্বিঘ্নেই। তারপর প্রযোজক সহ নাটকের অভিনেতা ও রেকর্ডিস্ট, সবাই মিলে গেলেন ক্যান্টিনে চা খেতে। প্রযোজকের বিলম্ব নিয়ে তখনও কেউ কিছু বলেননি। চা খেতে খেতে প্রযোজকই এবার দুঃখ প্রকাশ করে বললেন, ‘খারাপ লাগছে সবাইকে আজ অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে হল। কিছু মনে কর না। আসলে আমার বড় মেয়ে অণিমা আজ চলে গেল। ওর দাহ কাজের জন্য কেওড়াতলায় যেতে হয়েছিল। সেখান থেকেই সব মিটিয়ে আসতে বড় দেরি হয়ে গেল!’
অবধারিতভাবে মনে পড়ে যায় বনফুল রচিত ‘অগ্নীশ্বর’-এর ছায়াছবিতে উত্তমকুমারের মুখের মর্মস্পর্শী সেই সংলাপটি ‘আমার বাড়িতে একজন প্রিয় অতিথি এসেছিলেন। তিনি আমার সঙ্গে কিছুদিন ছিলেন। আজ তিনি চলে গেলেন। তাঁকে বিদায় দিতে গিয়েই আমার এই দেরি।’
কিন্তু সে ছিল সিনেমা আর এ একেবারে বাস্তব ঘটনা। আকাশবাণীর সেদিনের সেই প্রযোজক আর কেউ নন, বিখ্যাত বেতার নাট্যব্যক্তিত্ব শ্রীধর ভট্টাচার্য।
সুন্দর হাতের লেখার সমাদর সর্বত্রই। আর এই মাধ্যমটিকেই সম্বল করে শ্রীধরবাবু একদিন তাঁর গ্রাসাচ্ছাদনের সংস্থান করতে পেরেছিলেন। তাঁর অন্তরঙ্গ বন্ধু, স্বর্ণকণ্ঠের অধিকারী সঙ্গীত শিল্পী হেমন্ত মুখোপাধ্যায় একবার লিখেছিলেন, ‘ওর হাতের লেখা ছিল মুক্তোর মতো। ওর হাতের লেখা স্ক্রিপ্ট নিয়ে কাড়াকাড়ি পড়ে যেত রেডিও আর্টিস্টদের মধ্যে।’
ছোট থেকেই মেধাবী ছাত্র হলেও দারিদ্র্যের জন্য, পড়াশোনা ছেড়ে, জন্মস্থান পূর্ববঙ্গের ফরিদপুরের ঊনশিয়া গ্রাম থেকে ১৯৩৫ সালে শ্রীধর ভট্টাচার্যকে চলে আসতে হয়েছিল কলকাতায়। কোনও এক সুজনের দৌলতে থিয়েটারে প্রম্পটারির একটা কাজ জুটে গেল। এ কাজে পারদর্শিতার জন্য ক্রমে আরও দু-তিনটি থিয়েটারের সঙ্গে যুক্ত হলেন তিনি। এর সঙ্গে বিভিন্ন রঙ্গমঞ্চে অভিনীত নাটকের প্রতিলিপি তৈরির কাজও হাতে এল তাঁর। চমৎকার হস্তাক্ষরের জন্য এই কাজটি তাঁকে করে যেতে হয়েছিল আজীবন।
কলকাতা বেতারের নাটক বিভাগের অন্যতম কর্তা তখন বৈদ্যনাথ ভট্টাচার্য। বাণীকুমার নামেই যিনি খ্যাত। তিনি বেতারে যোগ দেওয়ার অনেক আগে থেকেই ‘চিত্রা সংসদ’ নামে একটি নাট্য সংস্থার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। একদিন তাঁর চোখে পড়ল শ্রীধর ভট্টাচার্যের হাতে লেখা একটি স্ক্রিপ্ট। জহুরির চোখ ছিল তাঁর, সঙ্গে সঙ্গেই চিনে নিয়েছিলেন রত্ন-বিশেষ মানুষটিকে। কলকাতা বেতারে তাঁকে নিয়ে চলে আসতে আর দেরি করেননি বাণীকুমার।
বাণীকুমারের হাত ধরেই শ্রীধর ভট্টাচার্য আকাশবাণীতে যোগ দিলেন ১৯৩৯ সালের ডিসেম্বর মাসে, একজন Capyist বা প্রতিলিপিকার হিসেবে। কেবল নাটকেরই নয়, বেতার সম্প্রচারের নানা লিপিই তাঁকে কপি করতে হতো। আকাশবাণীতে নাটকের কপি লেখার কাজ হাতে নেওয়ার আগেই তিনি শুরু করেছিলেন মৌলিক নাটক লেখার কাজও। দেখা গেল, একের পর এক বেতার নাটকের প্রযোজনা করে শ্রীধর ভট্টাচার্য হয়ে উঠলেন অত্যন্ত জনপ্রিয় এক প্রযোজক। পৌরাণিক, ঐতিহাসিক, সামাজিক ও কৌতুকনাট্য ছাড়াও বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, বিভূতিভূষণ, পরশুরাম, শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়, নরেন্দ্রনাথ মিত্র প্রমুখ লেখকের উপন্যাস ও গল্পের সার্থক বেতার নাট্যরূপ দিলেন। প্রযোজনা করলেন দু’শোরও বেশি নাটক। সেকালে আকাশবাণীর অন্যতম জনপ্রিয় একটি অনুষ্ঠান ছিল ‘পল্লিমঙ্গলের আসর’। এই অনুষ্ঠানেও ‘মুখুজ্জে মশাই’-এর ভূমিকায় অভিনয় করতেন তিনি। যেসব বেতার নাটকে তিনি অভিনয় করেছেন, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য, খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন, নিঃসঙ্গ নায়ক, পদ্মানদীর মাঝি, মসনদ, মায়ামৃগ, শিলাপটে লেখা, নাইন আপ, আরণ্যক। রবীন্দ্রনাথের ‘খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন’-এ রাইচরণ এবং হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়ের ‘নাইন আপ’ নাটকে জমিদার বাড়ির কাজের লোক ভগবানের ভূমিকায় তাঁর অসাধারণ অভিনয় শ্রোতাদের হৃদয়ে গাঁথা হয়ে থাকবে। তাঁর প্রযোজিত নাটকে ছবি বিশ্বাস, পাহাড়ি সান্যাল, বিকাশ রায়, শম্ভু মিত্র, তৃপ্তি মিত্র, নির্মলকুমার, অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়, রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্তর মতো খ্যাতনামা শিল্পীরা অভিনয় করেছেন।
১৯৬৮ সালে ‘কৃষ্ণলীলা’ নামে একটি চলচ্চিত্রও পরিচালনা করেছিলেন তিনি। এটি ছিল দক্ষিণ ভারতীয় একটি ছবির বাংলা রূপান্তর।
যেসব বিখ্যাত মানুষের সান্নিধ্যে এসেছিলেন তিনি, তাঁদের মধ্যে অন্যতম কাজী নজরুল ইসলাম, দাদাঠাকুর অর্থাৎ শরৎচন্দ্র পণ্ডিত, শিশির ভাদুড়ী, নরেশ মিত্র প্রমুখ। দাদাঠাকুর একবার চমৎকার একটি হেঁয়ালিও করেছিলেন তাঁকে নিয়ে। সেদিন আকাশবাণী ভবনে ঢুকেই দাদাঠাকুরের চোখে পড়ল, নাটকের প্রতি নিবেদিত প্রাণ শ্রীধর একটি নাটকের রিহার্সাল নিয়ে খুব ছোটাছুটি করছেন। তিনি তাঁকে ডাকলেন, ‘এই যে শ্রীধর, খুবই তো খাটাখাটনি করছ দেখছি। তা এত পরিশ্রম করলে তোমার ধড়ে আর শ্রী ফিরবে কেমন করে বাপু?’
তাঁর ‘শ্রীধর’ নামটি বলতে গিয়ে একবার খুবই বিপাকে পড়তে হয়েছিল অস্থায়ী এক বেতার ঘোষককে। সে সময় আকাশবাণী কর্তৃপক্ষের একটি নির্দেশ জারি হয়েছিল, কেবলমাত্র বাইরের শিল্পী ও বক্তাদের নামের ক্ষেত্রেই বেতারে ঘোষণার সময় ‘শ্রী’ বলতে হবে, বেতার কর্মীদের নামের আগে ‘শ্রী’ বাদ দিতে হবে।
নবাগত সেই ঘোষক একদিন একটি নাটকের ঘোষণায় প্রথমে ও শেষে দু’বারই বলে দিলেন ‘নাটকটি প্রযোজনা করেছেন, ধর ভট্টাচার্য।’ বেতারের কর্মী বলেই শ্রীধর ভট্টাচার্যের নামের আগে শ্রী-টি তিনি বর্জন করেছিলেন। দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায় তখন ছিলেন বেতার ঘোষক। এরপরের আখ্যানটুকু তাঁর লেখা থেকেই উদ্ধৃত করা যাক— ‘ভদ্রলোক কাঁদো কাঁদো মুখে বিমলদার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন, বিমলদা বলে চলেছেন, ধর ভট্টাচার্য! ধর কি কারও নাম হয়? সে চুরি করছে না ডাকাতি করছে যে তারে ধরবা? শ্রী তো তার নামের মধ্যেই আছে, তার নামটাই তো শ্রীধর, ‘শ্রী’ তো যুক্ত করা হয় নাই যে বাদ দিবা।’
অত্যন্ত সাধাসিধা মানুষটির প্রতিবাদী রূপেরও একটি প্রকাশ একবার ঘটেছিল। কলকাতা বেতার কেন্দ্র তখন ডালহৌসি অঞ্চলে ১ নম্বর গার্স্টিন প্লেসে। দাদাঠাকুর সেখানে অন্তত দু’টি অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে শ্রোতাদের মনোরঞ্জন করতেন—‘ছোটদের বৈঠক’ আর ‘পল্লি মঙ্গলের আসর’। এ জন্য তাঁকে কিঞ্চিৎ সম্মান-দক্ষিণাও দেওয়া হতো, চেকে।
সেদিন আকাশবাণী ভবনের বাইরে পান খেতে গিয়ে দাদাঠাকুরের মুখোমুখি হলেন শ্রীধরবাবু। তাঁকে দেখেই দাদাঠাকুর বললেন, ‘আরে বল কেন, ব্যাঙ্কে গিয়েছিলাম এখান থেকেই দেওয়া একটা চেক নিয়ে, তা ওরা তো আমাকে বলতে গেলে একরকম তাড়িয়েই দিলে।’ তারপর একরাশ হাসি হেসে বললেন, ‘হয়তো ভিখিরিই ভেবেছে আমাকে। কি আর করি, এখানেই না হয় জমা দিয়ে যাই চেকটা।’
শ্রীধরবাবু তো শুনে থ। প্রচণ্ড রেগে গিয়ে বললেন, ‘না না, এ তো কোনও মতেই সহ্য করা যাবে না। দাদাঠাকুর আমার অনুরোধ, আপনি আর একটু কষ্ট করে চলুন আমার সঙ্গে। দেখি ওরা চেক ভাঙিয়ে দেয় কি না। আর হাঁটতে হবে না আপনাকে, চলুন আমরা ট্রামে করেই যাব।’
ব্যাঙ্কে ঢুকেই বেশ রাগতস্বরে কাউন্টারে বসা কর্মচারীকে শ্রীধরদা বললেন, ‘একটু আগেই ইনি এসেছিলেন একটা চেক ভাঙাতে, জানতে পারি কি, কেন ফিরিয়ে দিয়েছেন এঁকে?’ এ কী করেছেন আপনারা? জানেন কি ইনিই আমাদের দেশবরেণ্য দাদাঠাকুর!’ তাঁর কথা শুনে ব্যাঙ্ক কর্মচারীটি প্রথমে একটু হকচকিয়ে গেলেও পরে নিজের ভুল বুঝতে পেরে সনির্বন্ধ ক্ষমা চেয়ে নিয়েছিলেন তাঁদের কাছে।
ইংরাজিতে যাকে বলে ক্ল্যাসিক, তেমন গল্প, উপন্যাসের বেতার নাট্যরূপ দিতেই বেশি আগ্রহ ছিল শ্রীধরবাবুর। একদিন শুরু করলেন মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘কৃষ্ণকুমারী’র বেতার নাট্যরূপ রচনার কাজ। কিন্তু হায়! সে কাজ অসম্পূর্ণই থেকে গেল। পরদিনই তিনি পাড়ি দিলেন অনন্তলোকে।
শ্রীধরবাবু জন্মেছিলেন ১৯১৫ সালের ১৫ নভেম্বর আর তাঁর চলে যাওয়ার দিন ১৯৭৩-এর ৫ নভেম্বর। তাঁর ‘জন্মদিন মৃত্যুদিন একাসনে দোঁহে’ না বসলেও মাত্র কয়েক দিনের তফাতে ‘দুই আলো মুখোমুখি মিলিছে’।
(লেখক আকাশবাণীর প্রাক্তন উপস্থাপক)
8Months ago
কলকাতা
রাজ্য
দেশ
বিদেশ
খেলা
বিনোদন
ব্ল্যাকবোর্ড
শরীর ও স্বাস্থ্য
বিশেষ নিবন্ধ
সিনেমা
প্রচ্ছদ নিবন্ধ
আজকের দিনে
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
mesh

পারিবারিক অশান্তির অবসানে গৃহ সুখ ও শান্তি বাড়বে। প্রেমের ক্ষেত্রে শুভ। কর্মে উন্নতি। উপার্জন বৃদ্ধি।...

বিশদ...

এখনকার দর
ক্রয়মূল্যবিক্রয়মূল্য
ডলার৮৩.২৬ টাকা৮৪.৩৫ টাকা
পাউন্ড১০৬.৪৬ টাকা১০৯.১২ টাকা
ইউরো৮৯.৭৬ টাকা৯২.২০ টাকা
[ স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া থেকে পাওয়া দর ]
*১০ লক্ষ টাকা কম লেনদেনের ক্ষেত্রে
দিন পঞ্জিকা