বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
গল্পের পাতা
 

বিন্নি ধানের খেত
হিমাদ্রিকিশোর দাশগুপ্ত

রাস্তার পাশে একটা সাইনবোর্ডের গায়ে ‘সুন্দরপুর’ নামটা দেখে সুমিতানন্দ ওরফে সুমিত বুঝতে পারলেন, তিনি তাঁর গন্তব্যে প্রায় পৌঁছে গিয়েছেন। সামনেই একটা প্রাইমারি স্কুল পড়বে। সেখানে তাঁর জ্ঞাতিভাই পলাশের অপেক্ষা করার কথা। সে-ই তাঁকে নিয়ে যাবে। বাড়ি। মোবাইল ফোনে তেমনই কথা হয়েছিল সুমিতের সঙ্গে তার। কিছুদিন আগে কলকাতায় একটা পারিবারিক অনুষ্ঠানে যোগ দিতে গিয়েছিল পলাশ। সুমিত তখনই তার নম্বরটি নিয়ে রেখেছিলেন। যদি কোনওদিন এখানে আসেন সেজন্য। ভাবনাটা বেশ কয়েক বছর ধরেই ঘুরছিল সুমিতের মনে। কিন্তু নানান ব্যস্ততায় এখানে আসাটা  কিছুতেই হয়ে উঠছিল না তাঁর। তারপর যখন কিছুদিন আগে তিনি জানলেন একটি সরকারি কাজে তাঁকে কৃষ্ণনগর আসতে হবে, তখনই মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন পিতৃপুরুষের জন্মভিটে থেকে তিনি একবার ঘুরে আসবেন। মৃত্যুর আগে সুমিতের বাবা সবুজানন্দ বারবার বলতেন ওই বাড়িটার কথা। বলতেন, জায়গাটা তাঁর খুব দেখতে ইচ্ছে করে। সুমিতকেও বলতেন একটিবার সুন্দরপুর থেকে ঘুরে এসে তাঁর জন্মস্থান এখন কেমন রয়েছে, সে কথা তাঁকে জানাবার জন্য। তিনি জানতে চাইতেন সেই হাঁসপুকুরটার কথা। সেটি এখনও আছে কি না। কিংবা বাড়ির পশ্চিমের সেই বেল গাছটা, যার ডালে রাতের বেলা বেহ্মদত্যি বসে পা দোলাত বলে ছোটদের ভয় দেখিয়ে ঘুম পাড়ানো হতো। অথবা বাড়ি সংলগ্ন সেই বিন্নি ধানের খেত ইত্যাদি ইত্যাদি। এসব খুব জানার আগ্রহ ছিল তাঁর। তবে, শেষ পর্যন্ত তাঁর আর ফিরে আসা হয়নি। সুমিতেরও। এবার তাই সুযোগটা হাতছাড়া করতে চাননি সুমিত। চলে এসেছেন সুন্দরপুর। তবে পলাশকে তিনি জানাননি যে, তিনি আসলে একটি সরকারি কাজে গতকালই এসেছেন এবং জেলা সদর কৃষ্ণনগরের একটি অতিথি নিবাসে রাত্রিবাস করেছেন। তিনি বলেছেন, বাপ-ঠাকুরদার ভিটে দেখতে সুন্দরপুর আসছেন। সুমিতের মনে হয়েছিল এটুকু জানালেই তাঁর আগমনের গুরুত্ব বৃদ্ধি পাবে।
বহু বছর আগে বাবার সঙ্গে একবার সুন্দরপুরের এই বাড়িতে এসেছিলেন সুমিত। তখন তাঁর বয়স সাত কি আট। বাড়িটি সম্পর্কে তাই প্রায় কোনও স্মৃতিই নেই আজ তাঁর। শুধু ছোট ঠাকুরদার মুখটাই আবছা মনে পড়ে। ফর্সা, লম্বা। এখনও জীবিত আছেন তিনি। বয়স আশির উপর। সত্যি বলতে ছোট ঠাকুরদা আর পলাশ ছাড়া ও বাড়ির প্রত্যেকেই প্রায় অচেনা সুমিতের কাছে। ছোট ঠাকুরদার স্ত্রী অর্থাৎ ছোট ঠাকুমাও জীবিত আছেন। সম্পর্কে তিনি পলাশের নিজের ঠাকুমা। সম্ভবত তিনিও চিনতে পারবেন সুমিতকে।
সুন্দরপুরের এই বাড়িটি তৈরি করেছিলেন সুমিতের ঠাকুরদা অমিতানন্দ ও তাঁর ছোট ভাই বিমলানন্দ দু’জনে মিলে। বিমলানন্দই বর্তমানে সুমিতের ছোট ঠাকুরদা। অমিতানন্দ সুমিতের জন্মের বহু বছর আগেই প্রয়াত। অমিতানন্দর একমাত্র পুত্র সবুজানন্দ। তিনি সুমিতের বাবা। বিমলানন্দরও এক পুত্র ছিল। বিজয়ানন্দ। কিছুকাল আগে তাঁরও মৃত্যু হয়েছে। তাঁরই পুত্র এই পলাশ ও আরও দু’জন। প্রবীর ও প্রশান্ত। তাঁদের অবশ্য কোনওদিন দেখেননি সুমিত।
সত্যি বলতে বেশ রোমাঞ্চ অনুভব করছেন সুমিত। বাপ-ঠাকুরদার পদধূলি ধন্য সে বাড়ি যাওয়ার কথা ভেবে। কত গল্প শুনেছেন বাবার মুখে। গ্রামের পথ ধরে গাড়ি নিয়ে এগতে এগতে সেই সবই ভাবছিলেন তিনি। হঠাৎ তাঁর মনে পড়ে গেল ছোট ঠাকুরদা বিমলানন্দর কাছে নাকি ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায়ের হাতে লেখা একটি চিঠি আছে। বিমলানন্দ যৌবনে রাজনীতি করতেন। কংগ্রেস। এ চিঠি সেই সময়কারই সম্ভবত। নিঃসন্দেহে সেটি আজ একটি ঐতিহাসিক দলিল। সুযোগ পেলে একটিবার দেখতে চাইবেন ভাবলেন সুমিত। এসব চিন্তার মাঝেই সেই স্কুলটা এসে গেল। সাইকেল নিয়ে সেখানে দাঁড়িয়ে আছে পলাশ। গাড়িটা দেখে হাত নাড়ল সে। তারপর ইশারায় তাকে অনুসরণ করতে বলল।
দুই
অবশেষে গন্তব্যে পৌঁছলেন সুমিত। দু’পাশে এক মানুষ সমান প্রাচীর। ইট বের করা সেই প্রাচীরের গায়ে কারা যেন ঘুঁটে লেপে রেখেছে যত্রতত্র। একটা নড়বড়ে দরজা ঠেলে সুমিতকে নিয়ে ভিতরে প্রবেশ করল পলাশ। সামনে বেশ বড় উঠোনের মতো জায়গা। তার একপাশে বারান্দাওয়ালা কয়েকটি ঘর সমৃদ্ধ পুরনো বাড়ি। তবে বহুদিন তার গায়ে রং পড়েনি। কয়েক জায়গায় পলেস্তারাও খসে গিয়েছে। উঠোনে বিক্ষিপ্তভাবে আরও দুটো ঘর আছে। তারমধ্যে একটি টালির। অপরটি পাকা। পলাশের সঙ্গে উঠোনে প্রবেশ করতেই এ ঘর ও ঘর থেকে দু-তিনজন বউ বাইরে এসে দাঁড়াল। কয়েকটি নানা বয়সি বাচ্চাও খেলা করছিল উঠোনে। সুমিত অনুমান করল এরা সবাই তাঁর জ্ঞাতিভাইদের স্ত্রী-সন্তান হবে। পলাশ তাঁকে নিয়ে সোজা হাজির হল পুরনো বাড়িটার সামনে। এ বাড়িরই কোনও একটি ঘরে জন্মেছিলেন তাঁর বাবা। বড় হয়েছিলেন এখানেই। ব্যাপারটা ভেবেই কেমন যেন একটা শিহরন খেলে গেল সুমিতের শরীরে। সে সময় বাড়ির ভিতরের একটি ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন শীর্ণকায়া এক বৃদ্ধা। পরনে আটপৌরে লাল পাড়ের বিবর্ণ শাড়ি। তিনি সুমিতের ছোট ঠাকুমা। পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে সঙ্গে আনা মিষ্টির প্যাকেটটা তাঁর হাতে তুলে দিলেন সুমিত। তিনিও চিবুকে হাত দিয়ে আশীর্বাদ করে বললেন, ‘বেঁচে থাকো বাবা।’ পলাশ তাকে জিজ্ঞাসা করল, ‘ঠাকুরদা কী করছেন?’
ঠাকুমা জানালেন তিনি ঘরেই আছেন। সকাল থেকে বাক্স-পেটরা হাতড়ে কী যেন একটা চিঠি খুঁজছেন। সুমিত ভাবলেন সেই বিধান রায়ের চিঠিটাই হবে সম্ভবত। যেটা এ বাড়িতে কেউ এলেই তিনি দেখান। ঠাকুমা আবারও বললেন— ‘এসো, এসো, ভিতরে এসো।’
বারান্দায় উঠে ছোট ঠাকুমার সঙ্গে সে ঘরে প্রবেশ করলেন সুমিত। একটি বহু প্রাচীন রংচটা পালঙ্কের উপর বসেছিলেন ছোট ঠাকুরদা বিমলানন্দ। খালি গা। পরনে ধুতি। বয়সের ভারে শরীরের চামড়া কুঁচকে গিয়েছে। চোখে ভারী কাচের চশমা। সামনে ছড়ানো ছিটানো একরাশ পুরনো কাগজপত্র। সুমিত ঘরে ঢুকে তাঁর পা ছুঁয়ে প্রণাম করে উঠে দাঁড়াতেই তিনি তাকালেন তাঁর দিকে। তারপর আশীর্বাদের ভঙ্গিতে হাত তুলে বললেন, ‘আমার মন কিছুদিন ধরেই বলছিল, তুমি আসবে। শেষ পর্যন্ত তুমি এলে।’ সুমিতও বললেন, ‘বহুদিন ধরেই আসার ইচ্ছে। বাবাও খুব বলতেন। শেষের দিকে তাঁরও খুব ইচ্ছে ছিল। আজ অবশেষে আসতে পারলাম।’
সুমিতের কথা শোনার পর ছোট ঠাকুরদার স্বগতোক্তির স্বরেই বললেন, ‘একটা চিঠি খুঁজছি। পেয়ে যাব হয়তো। তোমাকে দেখাব।’
এ কথা বলে তিনি আরও বললেন, — ‘যাও। বাড়ির চারপাশটা ঘুরে দেখ। হয়তো ভালো লাগবে তোমার। আর যাওয়ার আগে দেখা করে যাবে আমার সঙ্গে।’
‘হ্যাঁ অবশ্যই।’ বলে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলেন সুমিত।
সুমিতের বসার ব্যবস্থা করা হল উঠোনে যে পাকা ঘরটা আছে তার বারান্দায়। ওটা পলাশের ঘর। একটি কাপড়ের দোকানে ম্যানেজারি করে সে। টালির ঘরটা থেকে বেরিয়ে সে সময় তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এল প্রবীর। হাতে লাঠি। নারকেল গাছ থেকে পড়ে যাওয়ার পর কোমরে জোর পায় না সে। কাজকর্মও তেমন কিছু করতে পারে না। পলাশ জানাল, তাদের আরেক ভাই প্রশান্ত সিকিউরিটি গার্ডের কাজ করে। এখন বাড়িতে নেই। বিকেলে আসবে। পলাশের মা প্রায় শয্যাশায়ী। পলাশের বউ চা-জলখাবারের ব্যবস্থা করল এবং তার সঙ্গে দুপুরে এখানে খেতে হবে সেটাও জানিয়ে দিল সুমিতকে।
তিন
জলখাবারের পর পলাশকে নিয়ে বাড়ির চারপাশ দেখতে বেরলেন সুমিত। একটি দশ-বারো বছরের ছেলেও সঙ্গী হল হল তাঁদের। তার ডাক নাম পাঁচু। প্রশান্তর ছেলে। সুমিত বললেন, আগে হাঁসপুকুরটা দেখব। বাবার মুখে অনেক শুনেছি, সে পুকুরের কথা। হাঁস চরত। বাবা সাঁতারও শিখেছিলেন সেখানে।’
পলাশ উঠোন পেরিয়ে পুরনো বাড়িটার পিছনদিকে একটা ছোট পুকুর পাড়ে সুমিতকে নিয়ে হাজির হল। সেটাই হাঁসপুকুর। এখন অবশ্য কোনও হাঁস নেই সেখানে। পলাশ জানাল চুরি হয়ে যায় বলে হাঁস পোষা বহুদিন বন্ধ। বেশ কয়েক ধাপ সিঁড়ি নেমেছে পুকুরে। সুমিত তা বেয়ে নীচে নেমে ঝুঁকে ঠান্ডা জল স্পর্শ করলেন। কেমন যেন একটা আশ্চর্য অনুভূতি হল তাঁর। একসময় পুকুরের পাড়ে  দাঁড়িয়ে হাঁক দিলে জল ছেড়ে উঠে আসত হাঁসের দল। গ্রীষ্মের দুপুরে বাড়ির ছেলেরা দাপিয়ে বেড়াত এই পুকুরে। বাবার মুখে বহুবার শুনেছেন সে সব গল্প। সুমিতের মনে হল চোখ বন্ধ করলেই যেন দেখতে পাবেন সেইসব দৃশ্যপট। এরপর সুমিত জানতে চাইলেন সেই বেলগাছটার কথা। বেহ্মদত্যি থাকত যেখানে। গাছটা আজও আছে। পলাশ আর পাঁচু নিয়ে গেল বাড়ির পশ্চিমদিকে সেই গাছটার কাছে। বুড়ো বেলগাছটা বসন্তে পাতাহীন অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে সেখানে। সামান্য একটা বুড়ো বেলগাছ যাকে আগে কোনওদিন দেখেননি সুমিত তাকে দেখেই কেমন যেন একটা টান অনুভব করলেন তিনি। একেই হয়তো বলে ভিটের টান। যা অদেখা হলেও প্রজন্মের পর প্রজন্ম প্রবাহিত হয় রক্তে। বেলগাছটার গায়ে হাত দিয়ে সুমিত বললেন, ‘শুনেছি এখানে একটা জামগাছও ছিল?’
সে সম্পর্কে বলতে গিয়ে পলাশ কেমন একটু ইতস্তত করছিল। কিন্তু উত্তরটা দিল পাঁচু। সে বলল, ‘ওই গাছটা গত বছর প্রবীর কাকা ঘর তৈরির সময় কেটে বিক্রি করে দিয়েছে।’ সুমিত পলাশের মুখ দেখে এবার বুঝতে পারলেন তার অস্বস্তির কারণটা। বাড়ি ও তার চৌহদ্দিতে ইতিউতি ঘোরার পর সবশেষে ধানি জমি দেখার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন সুমিত। যেখানে বিন্নি  ধান ফলত আর তা থেকে খই হতো। দই, কলা দিয়ে মাখলে তার স্বাদ নাকি অমৃতসমান হতো। এ সবই সুমিতানন্দ শুনেছিলেন তাঁর বাবার কাছ থেকে। বাড়ির পিছন দিয়ে বেশ কিছুটা পায়ে চলা পথ পেরিয়ে সুমিত পৌঁছলেন সে জায়গায়। যতদূর চোখ যায় সবুজ ধানের খেত। তার মাঝে মাঝে আল দিয়ে ভাগ করা। পলাশ দেখিয়ে দিল কত দূর পর্যন্ত এ বাড়ির জমি। যে সবুজ ধান গাছগুলি বাতাসে নড়ছে তা বিন্নি ধান কি না জানা নেই সুমিতের। তবুও তাঁর মনে হল ধানগাছগুলিকে তিনি জড়িয়ে আছেন। তারা বড় আপন তাঁর। বেশ কিছুক্ষণ আবেগমথিত হয়ে সেখানে দাঁড়িয়ে রইলেন তিনি। তারপর ফেরার পথ ধরলেন। দুপুরবেলা পলাশের ঘরে ফিরে ভাত, মুসুর ডাল, বেশ কয়েকরকম শাক-তরকারি, চুনো মাছ আর মুরগির মাংস দিয়ে বেশ তৃপ্তি করে খেলেন সুমিত। সবকিছুর মধ্যেই যেন পিতৃভূমির একটা স্নেহের পরশ মিশে আছে বলে মনে হল তাঁর। খাবার পর একটু বিশ্রাম নিতে নিতেই বিকেল হয়ে গেল। ইতিমধ্যে কাজ থেকে ফিরে সুমিতের সঙ্গে দেখা করে গেছে তাঁর আরেক ভাই প্রশান্ত। এবার ফেরার জন্য রওনা হতে হবে সুমিতকে। তিনি তৃপ্ত তাঁর বাবার জন্মভিটেতে এসে। তবে ফেরার আগে একবার দেখা করতে হবে এ বাড়ির অভিভাবক ছোট ঠাকুরদার সঙ্গে। তিনিও তাই বলেছেন।
চার
একইভাবে বিছানাতে বসেছিলেন ছোট ঠাকুরদা বিমলানন্দ। সামনে পুরনো কাগজপত্র তখনও ছড়ানো। খাটের পাশে একটি চেয়ার রাখা ছিল। শহর থেকে আসা নাতিকে সেখানে বসতে বললেন তিনি। তারপর বেশ আক্ষেপের স্বরেই বললেন, ‘নাহ। ও চিঠি খুঁজে পেলাম না। কোথায় যে রাখলাম।’
সুমিত ব্যাপারটায় একটু নিরাশ হলেন ঠিকই। কিন্তু সে প্রসঙ্গে আর কিছু না বলে হেসে বললেন, ‘বাড়ি আর তার চারপাশটা ঘুরে দেখলাম। বাবা যেমন বলেছিলেন ঠিক তেমনই আছে। বেশ লাগল।’
বিমলানন্দ বললেন, ‘হ্যাঁ, পাঁচুর মুখে শুনলাম তুমি সব ঘুরে দেখেছ। খোঁজখবর করেছ। চাষ জমি তো ছিল চার বিঘে। আল চুরি ইত্যাদির পর সেটা এখন সাড়ে তিন বিঘেতে ঠেকেছে। এতবার ও জমি থেকে ফসল উঠেছে যে, জমি বুড়িয়ে গেছে। বিন্নি ধান বা ভালো ফসল আর হয় না। হাঁসপুকুরটা তো দেখলেই। ওটা ছিল পনেরো শতক। এখন বুজতে বুজতে খুব বেশি হলে দশ শতক। আর এই বসত ভিটা আর দুই খান ঘর আর উঠোন মিলিয়ে হবে পাঁচ কাঠা।’ এ কথা বলে বৃদ্ধ তাকালেন সুমিতানন্দর প্রতিক্রিয়া লক্ষ করার জন্য। সুমিত প্রথমে বুঝতে পারলেন না কথাগুলো বলে বৃদ্ধ বিমলানন্দ তাঁর কাছ থেকে কী উত্তর প্রত্যাশা করছেন। অবশ্য এরপরই ব্যাপারটা স্পষ্ট হয়ে গেল সুমিতের কাছে।  বিমলানন্দ বললেন, ‘তুমি তো দেখলেই সামান্য কয়েক বিঘে, কয়েক কাঠা, কয়েক শতক জমিজমা। তার উপর নির্ভর করেই বেঁচে আছি আমরা এতগুলো মানুষ। যাদের মধ্যে কেউ বৃদ্ধ, কেউ অসুস্থ, কেউ বা পঙ্গু। তোমার তো অনেক আছে বাবা। এটুকু অংশ নয় আমাদের ছেড়েই দিলে। তুমি বিশ্বাস কর যে চিঠি আমি হারিয়ে ফেলেছি, তাতে তোমার বাবা সত্যিই আমাকে লিখেছিল যে, এ সম্পত্তির ভাগ ও নেবে না। বিশ্বাস কর। বিশ্বাস কর...’ কথাটা বিশ্বাস করানোর জন্য একটা আকুল ভাব ফুটে উঠল বৃদ্ধের কণ্ঠে। সুমিত খেয়াল করলেন ইতিমধ্যে পলাশ, প্রবীর, প্রশান্ত এসে দাঁড়িয়েছে দরজার সামনে। প্রবল উৎকণ্ঠা নিয়ে তারা চেয়ে আছে সুমিতের দিকে। সুমিত জমিবাড়ির ভাগ নেওয়ার জন্য এখানে আসেননি। এসেছিলেন তাঁর শিকড়কে একটিবার ছুঁয়ে দেখার জন্য। কিন্তু সুমিতানন্দ এবার বুঝতে পারলেন তাঁর বাবার মুখে শোনা বিন্নি ধানের মাঠ আজ বদলে গিয়েছে বিঘেতে, হাঁসপুকুর মানে আজ শতকের হিসাব আর বাস্তুভিটা মানে কাঠা নামের জমি মাপার সূচক। এবাড়িতে আজ যাঁরা থাকেন তাদের সঙ্গে সুমিতের সম্পর্ক নেহাতই বিঘে-কাঠা-শতকের অংশীদারিত্বের। বিমলানন্দর কথা শোনার পর কয়েক মুহূর্ত চুপ করে বসে রইলেন সুমিত। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে ঘর ছাড়ার আগে সবাইকে আশ্বস্ত করে বললেন, ‘হ্যাঁ, বাবা ও চিঠি লিখেছিলেন জানি। ভাগ ছেড়ে দেওয়ার জন্য যদি কোনও সই-সবুদ করতে হয় তো কাগজ পাঠিয়ে দেবেন করে দেব।’
সুমিতানন্দ মনে মনে ভাবলেন তাঁর কল্পনায়, দৃশ্যপটে আগের মতোই বেঁচে থাকুক তাঁর পূর্বপুরুষের এই বসতভিটে, ওই হাঁসপুকুর, সেই বিন্নি ধানের খেত। এ বাড়ির বর্তমান মানুষগুলোর মতো বিঘে-কাঠা-শতক দিয়ে তাঁর ভালোলাগার-ভালোবাসার পরিমাপ নাই বা করলেন তিনি।
অঙ্কন : সুব্রত মাজী

14th     May,   2023
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
বিশেষ নিবন্ধ
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ