বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
গল্পের পাতা
 

মহানগরের ঘোড়ার গাড়ি
কলহার মুখোপাধ্যায়

‘অভিনেতা অক্ষয়কুমারের হাত দিয়েই বদলে গেল কলকাতার ঘোড়ার গাড়ির ইতিহাস...’ শুনেই হেঁয়ালির মতো লাগল। তবে প্রথমেই সত্য-মিথ্যা যাচাই না করে পুরোটা শোনার পর বোঝা গেল গল্পটা। কয়েক বছর আগে ‘রাউডি রাঠোর’ নামে একটা হিন্দি ছবি এসেছিল। সেই ছবির নায়ক অক্ষয়। সেই ছবির শ্যুটিংয়ে গাদাগুচ্ছের ঘোড়ার গাড়ি দৌড়েছিল। তখন কলকাতার ভিক্টোরিয়ার পাশ থেকে সব ঘোড়ার গাড়ি নাকি কিনে মাইসুরু নিয়ে চলে যায় এই ছবির প্রোডাকশন টিম। এরপর বিলকুল ফাঁকা হয়ে যায় ভিক্টোরিয়া চত্বর। গল্পটার মধ্যে খুব সিরিয়াস একটা বিষয় লুকিয়ে আছে কিন্তু। পুরোটা শুনে ফেরার পথে মনে পড়বে সেটা। তক্ষুনি আবার ছুটতে হবে প্রবাল মুখার্জির কাছে। বলা হয়নি, এই প্রবালবাবু ব্যক্তিটি আপাতত কলকাতার ঘোড়ার গাড়ির যে সংগঠন রয়েছে তারই একজন কেউকেটা। 
ঘোড়ার পায়ে নাল লাগানো, কি কোনও ঘোড়ার পেট খারাপ হয়েছে, বা ঘোড়ার গাড়ি নিয়ে চলতে থাকা মামলা লড়তে, বা পুর প্রতিনিধিদের সঙ্গে কোনও মিটিং করতে সদাই ব্যস্ত থাকেন মধ্যবয়স্ক প্রবাল। ফলে যখন তখন  চাইলেই তাঁর সঙ্গে যে কথা বলা যাবে, এমনটা কিন্তু নিশ্চিত নয়। একথাগুলো আগেই বলে রাখা ভালো। সে যাই হোক, কপাল ঠুকে আবার ছুট প্রবালবাবুর দরবারে। তাঁর হাতে সময় ছিল, কথাও বললেন। প্রশ্নটা করা হল তখন, ‘আচ্ছা, রাউডি সিনেমায় তো গাড়িগুলো চলে গেল। তারা আবার ফিরেছিল তো কলকাতায়?’ তিনি বললেন, ‘না ফেরেনি।’ 
তার মানে ল্যান্ডো, ফিটন, ব্রাউনবেরিগুলো কলকাতায় আর ফিরে এল না? তার মানে কলকাতার ঘোড়ার গাড়ির ইতিহাসের একটা অংশ বিলকুল উবে গেল। এর উত্তর দিয়েছিলেন প্রবীণ অন্য এক ঘোড়ার গাড়ির মালিক-চালক। তাঁর বক্তব্য, ‘চালকরা ইতিহাস লিখবে না পেট চালাবে? ওই গাড়িগুলির জায়গায় নতুন গাড়ি কেনা হল। এই যে এখন দেখছেন ‘বাহুবলী’, ‘গুলাবি’— এই গাড়িগুলো চলছে।’ চোখ উপর-নীচ করতে করতে একেবারে অপ্রাসঙ্গিক একটা কথা বললেন হঠাৎ, ‘সবই তো তুলে দিচ্ছেন আপনারা। প্রেস, মিডিয়া, পুলিস, কর্পোরেশন, প্রশাসন, বিজনেসম্যান সবাই মিলে তো ঘোড়ার গাড়ি তুলে দিতে চাইছেন। এতগুলো লোক কীভাবে সংসার চালাবে, ভেবেছেন একবারও?’ এই কথাটার পর আচমকা একটা গভীরতর দিকে মোড় নিল আলোচনা। সেই প্রসঙ্গের সূত্র ধরে আসবে, কলকাতার ঘোড়ার গাড়ির ভবিষ্যৎ। গা঩ড়ির সঙ্গে জড়িয়ে থাকা মানুষগুলোর পেট চালানোর উদ্বেগের কথা। তবে তার আগে রাউডি প্রসঙ্গটা শেষ করা যাক। 
তা সেই আদ্যিকালের ল্যান্ডো, ফিটন গাড়ি যতটুকু অবশিষ্ট ছিল, তা কলকাতার রাস্তা থেকে তো হাওয়া। তার জায়গায় এল বাহুবলী সিনেমায় দেখানো ঘোড়ার গাড়িগুলির মতো রংচঙে চার চাকা। সেগুলি মন্দ নয় মোটেই তবে আগের গাড়িগুলির কথা ভাবলে সেই সিরিয়াস বিষয়টা মন ভার করে দেয়। সব মিলিয়ে মানে দাঁড়াল এই যে, রাউডি রাঠোর গাড়ি কিনে নিয়ে যাওয়ার পর কলকাতায় দশকের পর দশক ধরে ঘোড়ার যে গাড়িগুলি চলত, সেগুলি স্রেফ কর্পূরের মতো গেল উবে। অর্থাৎ পুরনো কলকাতার একটা চ্যাপ্টার ইতিহাসের বইয়ের পাতা থেকে বিলকুল গায়েব! ভাবতে ভাবতে নিজের হাত কামড়াতে ইচ্ছে করবে। ইতিহাস মুছে যাওয়ার আগে কয়েকটা ছবি যদি তুলে রাখা যেত অন্তত। পরের প্রজন্মের জন্য কিছুই রেখে যাওয়া হচ্ছে না...। ইতিহাস গিলে ফেলা রাউডি রাঠোর সিনেমায় গাড়িগুলির কী দশা হয়েছিল, সেগুলি পাল্টে গিয়ে কেমন চেহারার হয়েছিল তা দেখা হয়নি। আচ্ছা, বাপ-দাদাদের কালের ‘প্রিয় সহচর’ গাড়িগুলিকে হারিয়ে প্রবালবাবু, আমির হুসেন বা ভোম্বল মণ্ডলদের মতো মালিক-চালকদের কি মন খারাপ? গড়ের মাঠেও তখন সর্বজনীন মনখারাপের রং ধরছে। স্লেট কালারে নামছে শীতের সন্ধে। সেই স্বল্প অন্ধকারে ঝাপসা কলকাতার ঘোড়াওয়ালাদের মুখও। প্রবালবাবু ডাকলেন চা-ওয়ালাকে। 
অন্ধকার কাটাতে ভিক্টোরিয়ার আলো পেখম মেলল ঠিক তখনই। স্ট্রিট লাইটগুলোও অস্ফুট আলো ফেলল। রাস্তায় সার বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকা ঘোড়ার গাড়িগুলিতে সেই আলোগুলো রোজই গুছিয়ে এসে বসে। গাড়ির নকশায় ঠিকরে যায়। গাড়িগুলো মুঠো খুলে একটা সময় আলোগুলোকে ছড়িয়ে দেয়। তখন রাস্তায় সেই আলো লুটোপুটি খেয়ে চোর পুলিস খেলে। ভিক্টোরিয়ায় রোজই এসব খেলা দেখা যায়। তখন বিলক্ষণ বোঝা যায় বাহুবলী, গুলাবি গাড়িগুলি ফিটন ইত্যাদির মতো গম্ভীর, কেতাদুরস্ত নয় বটে তবে ভারী ঝলমলে, চটকদার ও বেজায় জমকালো। ভিক্টোরিয়ার এক পাশ আলো করে দাঁড়িয়ে থাকে সেগুলি। ‘গরিবের ঘোড়া রোগ’ চাপলে এরাই কলকাতার একমাত্র ভরসা। পকেটে শ’চারেক টাকা থাকলে ভিক্টোরিয়া চলে গেলেই হল। ঘোড়ার গাড়িতে উঠে টগবগ টগবগ, এক চক্কর। যেমন এলেন সুন্দর। স্ত্রী পুনম, শিশুপুত্র রোহণ, দু’বছরের কন্যা সুহানকে নিয়ে গাড়ি চড়ে চক্কর কাটছিলেন সুন্দর শর্মা। রোহণ একটা হাঁটুলম্বা জুতো পরেছে। সুন্দর বললেন, ‘প্রতি রবিবার বিকেল হলেই বায়না ধরে, ঘোড়ায় চড়বে। শুধু গাড়িতে চড়লে বাবুর হয় না। ওকে ঘোড়ার পিঠে চাপাতে হয়। তাই ওরকম কায়দার একটা জুতোও কিনে দিতে হয়েছে।’ দানেশ নামে এক গাড়ি মালিকের কোলে করে রোহণ উঠল ঘোড়ার পিঠে। টগবগ ছুটল ঘোড়া। ‘আমি যাচ্ছি রাঙা ঘোড়ার ’পরে/ টগবগিয়ে তোমার পাশে পাশে’ রবীন্দ্রনাথের ‘বীরপুরুষ’ মনে পড়বেই পড়বে। এদিকে ভ্যাঁ করে কান্না সুহানের। ও এখন অনেকটা বড় হয়ে গিয়েছে। ফলে দাদার মতো ওকেও চড়তে হবে ঘোড়ার পিঠে। 
দানেশদের গাড়িগুলির কারও সাদা জমিতে সোনালি কাজ। কারও গাড়ির বডি টকটকে লাল, তাতে সোনালি-সবুজ-হলুদ কারুকাজ। কারও গাড়ির পিঠে খোদাই গরুড় পক্ষী, কারও হনুমান। কারও রামসীতা। বাহুবলী গাড়িগুলি মূলত গুজরাত থেকে কলকাতায় আমদানি করা। কিন্তু লোকে বলে ফিটন বা ল্যান্ডোতে চড়লে একটা লাটসাহেব মার্কা ফিলিং আসত। সেটা এই গাড়িগুলিতে মিলবে না। এটাতে চড়লে মনে হতে পারে ব্যবসার গদিতে বসে চাট্টি রোজগার হয়েছে। এবার একটু খরচ করা যাক। 
তা, লাটসাহেবের গাড়ি তো সবার ভাগ্যে জোটে না। রাউডি রাঠোর হজম করে নেওয়ার আগে যাঁদের ফিটন চাপার সৌভাগ্য হয়েছিল তাঁরা ভাগ্যবান। এই ভাগ্যবানদের সেইসব পূর্বপুরুষরা, যাঁরা ফিটন ইত্যাদি চড়তেন, তাঁরা কিন্তু দস্তুরমতো বড়লোক বলেই গণ্য হতেন তৎকালীন কলকাতায়। চায়ের ভাঁড় হাতেই থাকবে অথচ সন্ধের গড়ের মাঠের শিরশিরে হাওয়া আচমকা কখন যে দৃশ্যপট সম্পূর্ণ পাল্টে দেবে তা বোঝা যাবে না। প্রবালবাবুর গলার স্বর ফেড আউট হতে থাকবে। সেখানে এতদিনকার পড়া বইগুলো, দেখা সিনেমাগুলো লাউড হয়ে ফেড ইন করবে চিন্তাপথে। ভিক্টোরিয়ার আশপাশটা তখন ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট হয়ে উঠে আসবে স্মৃতিপথের গহিন অন্দরমহল ভেদ করে। কলকাতাটায় তখন কোনও এক সাহেব চকচকে টুপি মাথায় গাউন পরিহিত সঙ্গিনীকে নিয়ে ব্রুহামে চেপে গঙ্গার হাওয়া খেতে যাচ্ছেন। তাঁকে নকল করে ল্যান্ডো চেপে ছুটছেন কোনও এক রায়বাহাদুর। কোনও এক খাঞ্জা খাঁ ফিটন চেপে চক্কর কাটছেন কোম্পানির মাঠের ধারে। পালকিগুলো তখন কলকাতার রাস্তার ফুটপাতে পার্কিং করা থাকত। সাহেবপাড়ায় জ্বলত গ্যাসের উজ্জ্বল আলো। সন্ধের দিকটা পিয়ানোর আওয়াজ ভেসে আসত বাড়ি থেকে। এসপ্ল্যানেড পেরলে সেই আওয়াজে মিশত শঙ্খধ্বনি আর আজান। কলকাতায় তখন তোপ দেগে সময় জানান দিত ‘কোম্পানি’। সেই কলকাতার রাস্তায় তখন গ্রিনফিল্ড, ব্রুহাম, ফিটন, গিগ, কেরাঞ্চি, চ্যারিয়ট, এক্কা, টাঙা, টমটম বা ব্রাউনবেরির মতো কুলীন ঘোড়ার গাড়ির বোলবোলা। এর মধ্যে আলাদা করে উঠবে ব্রাউনবেরির নাম। কারণ তৎকালীন কলকাতায় যাত্রী পরিবহণে ঘোড়ার গাড়ির ব্যবহার শুরু হয় ব্রাউনবেরির হাত ধরেই। বাস্তবিকই সেটা ছিল ইতিহাস পাল্টে দেওয়া একটা ঘটনা। কারণ ব্রাউনবেরির আগমনে কলকাতা শহর থেকে পাততাড়ি গোটাতে একপ্রকার বাধ্য হয় তৎকালীন সময়ে বাঙালি জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ পালকি। সংক্ষেপে ঘটনাটি হল এই, পাঁচু রায় নামে এক ব্যক্তি বেহারাদের সঙ্ঘবদ্ধ করে পালকি ধর্মঘট ডাকেন। নাজেহাল তখন কলকাতা। তিতিবিরক্ত হয়ে এক সাহেব যাঁর নাম ব্রাউনবেরি, তিনি একটি পালকির ডান্ডা খুলে, দু’টি চাকা লাগিয়ে ঘোড়া জুড়ে বানিয়ে ফেললেন মোটামুটি চলনসই একধরনের গাড়ি। দিব্যি ছুটল সেটি। রাস্তায় তা দেখে থ মেরে গেল কলকাতা। সেই ডিজাইন নকল করে অনেকে এই ‘না পালকি না ঘোড়ার গাড়ি’ বানিয়ে ফেললেন। কালে কালে সে গাড়ি ভীষণ জনপ্রিয় হল। পালকি বেহারাদের মাথায় হাত। যাত্রী পরিবহণে ব্রাউনবেরি হয়ে উঠল কলকাতার অন্যতম ভরসা। জ্ঞাতিভাইয়ের সাফল্যে ডগমগ হয় সাহেবরা গাড়িটির নামই দিয়ে দিলেন ব্রাউনবেরি। সেই যে শহরের পথে চলা শুরু করল ঘোড়া। তার চলা থামল না মোটেই। কালীপ্রসন্ন সিংহ লিখলেন, ‘আজব শহর কলকেতা।/রাঁড়ি বাড়ি জুড়ি গাড়ি/ মিছে কথার কি কেতা।’
১৮৭৩ সাল থেকে ঘোড়ায় টানা ট্রাম গাড়ি চলা শুরু করল। দুটো হাট্টাকাট্টা ঘোড়া টানল ট্রাম। লাইন পাতা, কলকাতা ট্রামওয়েজ কোম্পানি তৈরির পর ঘোড়ায় টানা ট্রামই হয়ে উঠল কলকাতার অন্যতম গণপরিবহণ ব্যবস্থা। ১৮ শতকের শেষ দশকে কলকাতায় ট্রাম টানবার ঘোড়ার সংখ্যা সম্ভবত হাজারখানেক। সে যুগ শেষ হল ১৯০২ নাগাদ। এর কিছু আগে ঘোড়ায় টানা বাস চলার কথা শোনা যায়। ধর্মতলা থেকে বারাকপুর পর্যন্ত ঘোড়ায় টানা বাস চলেছিল আঠারোর তৃতীয় শতকে। এর পাশাপাশি ল্যান্ডো, ফিটন, ব্রুহাম বা টমটম তখনকার দিনে যেগুলি চলত, তা ডিজাইন পাল্টে পাল্টে কলকাতায় ঘুরেফিরে আসত বিভিন্ন নামে। সেই ফিটন-ল্যান্ডোরাই  চলে গেল রাউডির জঠরে। আর কলকাতার ইতিহাসের ঘোড়ার গাড়ির বইটা উইয়ে খেয়ে নিয়ে একেবারে যাকে বলে ঝুরঝুরে করে ছেড়ে দিল। হাজার চেষ্টা করলেও সেই বই খুলে আর পড়তে পারবে না ছেলেপুলেরা। এসব ভাবনায় আনমনা। সেই ভাবটায় খানিকটা অসহিষ্ণু হয়েই বোধহয়, ‘শুনছেন’-বলে সংবিৎ ফেরান প্রবাল মুখার্জি। তখন তাঁর মুখে শুনলাম, পুরনো গাড়ি বিক্রি করে দেওয়ার সময় মূল্য বোঝেননি কেউই। এখন দুঃখ পাচ্ছেন। পুরনো গাড়িগুলিতে ব্যবহৃত লোহা, তামা ধাতুগুলি এখন লক্ষ টাকা খরচ করলেও মেলে না। ওসব যন্ত্রাংশ তৈরির কারিগরও অমিল। সেগুলির মতো মজবুতও নয় এখনকার গাড়ি। এগুলো ফঙ্গবেনে টাইপের। 
চালকরা জানালেন, ঘোড়ার গাড়ির জন্য খুব একটা সহানুভূতি কারও নেই। সরকার তাঁদের কথা সেরকম ভাবে না। পুলিস নাজেহাল করে। যতটা সহযোগিতা করার দরকার কলকাতা পুরসভা ততটা করে না। পশুপ্রেমী সংগঠনও তাঁদের উপর অকারণে খড়্গহস্ত হয়ে রয়েছে। তার উপর একটা নয়া উপদ্রব শুরু হয়েছে। স্পষ্ট বললেন প্রবাল, ‘একটি ব্যবসায়ী সংস্থা এখনকার ঘোড়ার গাড়ি বাতিল করে দিতে চেয়েছিল। তারা একধরনের যন্ত্রচালিত আধুনিক গাড়ি দিতে চায়। সে গাড়ি কিনে ভিক্টোরিয়ার পাশে চালাতে বলছে। এই প্রস্তাবে আমরা রাজি হইনি। তারপর নানাভাবে হেনস্তা করা শুরু হয়েছে ঘোড়ার গাড়ির মালিক ও চালকদের। ঘোড়ার গাড়ি নিয়ে আদালতে মামলাও চলছে। আমরা মামলা লড়ছি’। বাকি চালকদের বক্তব্য, ‘গাড়ি তুলে দিতে সর্বতোভাবে চেষ্টা করছে কয়েকটা পক্ষ। তারা মিডিয়ার নাম করে নিজেদের প্রতিনিধি পাঠায়। তাঁরা এসে ভুলভাল ছবি তুলে সেগুলি ছড়িয়ে ঘোড়ার গাড়িকে বদনাম করছে। এসব আমরা জানিয়েছি আমাদের আইনজীবীকে।’ প্রবাল মুখার্জিদের দাবি, ‘১. হেস্টিংসে ঘোড়াগুলোর জন্য নিয়মিত পানীয় জল সরবরাহ করুক পুরসভা। ২. সরকার ঘোড়ার খাবারের জন্য ভুষি বছরে তিন মাস বর্ষাকালে বিনামূল্যে দিলে ভালো। ৩. নিয়মিত ময়লা পরিষ্কার করার ব্যবস্থা করুক পুরসভা। ৪. উৎসবের দিনে পুলিস ঘোড়ার গাড়ি চলার রাস্তা নো এন্ট্রি করে দেয়। সেটা চালু থাকুক। ৫. লাইসেন্স পাওয়া নিয়ে যে সমস্যা চলছে, তা মিটিয়ে দেওয়া হোক।’ এসব শুনতে শুনতে আধো শীতের সন্ধে গভীর হওয়ার পথে এগচ্ছে। বীরপুরুষ রোহণ বাড়ি ফিরে গিয়েছে বাবা-মা-বোনকে নিয়ে। গঙ্গার হাওয়া ঠান্ডা ছড়াচ্ছে আর গড়ের মাঠে ধোঁয়াশা অস্বস্তি তৈরি করছে চোখে। রাস্তায় গাড়ি জুতে দাঁড়িয়ে থাকা ঘোড়াগুলি ঠকঠক নাল ঠুকছে পথে। খুব কম সময় কলকাতাটাকে এমন ঝাপসা দেখায়। এরকম একটা ঝাপসা আশঙ্কা স্মৃতিসৌধটার চারপাশে হায় হায় করে পাক খাচ্ছে এই সন্ধেয়। আর শীতের মতো পাতা খসতে খসতে ইতিহাসের বইটা ক্রমশ পাতলা হচ্ছে। তখন একটা গাড়ি সওয়ারি তুলে রওনা দিল টগবগ করতে করতে। 
টগবগ আওয়াজ সবারই মনে ঝড় তোলে। ‘ম্যাকেনাস গোল্ড’ কিংবা ‘টেক্সাস’ ফিল্ম দেখার মতো উত্তেজনা হয়। ‘বেন হার’ ছবির চ্যারিয়ট রেস দেখার মতো টানটান হয়ে ওঠে শরীর। গুরু দত্তের ‘সিআইডি’ বা ‘শোলে’র টাঙ্গা কিংবা আমির খানের ‘আন্দাজ আপনা আপনা’ ছবির রোমান্টিকতা ছড়ায় মনে। নিজেকে কোনও একটা নায়কের স্বগোত্রীয় মনে করে কলকাতার কোনও একটা বাহুবলীতে চেপে বসতেই হয়—‘এক্কা গাড়ি খুব ছুটেছে।’ ও হরি সত্যি সত্যিই মাথার উপর চাঁদ উঠেছে। এই চড়তে চড়তে জানা যায়, কলকাতার ঘোড়ারা থাকে হেস্টিংসের রাস্তার ধারে ব্রিজের নীচের অস্থায়ী আস্তাবলে। কিছু থাকে রাজাবাজারে। গাড়ির মালিকরা দেশের বিভিন্ন প্রান্ত যেমন শোনপুর বা উত্তরপ্রদেশ, রাজস্থানের প্রত্যন্ত এলাকার মেলায় গিয়ে কেনেন পছন্দের ঘোড়া। পঞ্চাশ থেকে দু’লক্ষ টাকা পর্যন্ত দাম এক-একটার। লরিতে চেপে সেগুলি কলকাতা আসে। আর আসার পর বেশ চিত্তাকর্ষক কাজ করতে হয় তাদের। ঘোড়াগুলি কলকাতা চিনতে বের হয়। কীরকম? 
কলকাতা আসার পর আইসক্রিমের গাড়িগুলিকে প্রথম প্রথম দু’চক্ষে দেখতে পারে না ঘোড়াগুলো। ভাবে হয়তো শত্রুপক্ষ। গাড়িগুলির পাশে নিয়ে গিয়ে ধীরে ধীরে তাদের চেনাতে হয়। তারপর বাস, গাড়ি, লরি চেনানো হয়। চেনাতে হয় লাল-নীল-হলুদের ট্রাফিক সিগন্যাল। তারপর ভিনদেশের ঘোড়ারা কলকাতার হাওয়ায় স্বচ্ছন্দে শ্বাস নিতে শুরু করলে তাদের জুড়ে দেওয়া হয় গাড়িতে। সে এবং তারা কলকাতার বাসিন্দা হয়ে ওঠে। তারপর একদিন গাড়ি জুতে ছুটতে শুরু করে ঘোড়াগুলো। 
ছুটতে ছুটতে একসময় রাত ঘনায়। ভিক্টোরিয়ার পাশে চকচকে ঘোড়ার গাড়িগুলি আলোর আলপনা গুটিয়ে বাড়ি ফেরার তোড়জোড় করে। ড্রোন থেকে যদি তখন টপ শট নেওয়া যায়, দেখা যাবে আপাত অন্ধকার রাজপথে আয়না লাগানো চকচকে গাড়িগুলি নক্ষত্রের মতো জ্বলে। এ নক্ষত্র রাতের পথ কলকাতাকে আরও স্বপ্ন দেখাক। ও পথে টগবগিয়ে আরও অনেক ছুটুক ঘোড়ার গাড়ি। হীরের মতো এ নক্ষত্র অক্ষয় চিহ্ন এঁকে দিক শহরের বায়ুমণ্ডলে। শহরের সব সন্তান যেন থাকে দুধেভাতে।

29th     January,   2023
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
বিশেষ নিবন্ধ
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ