বিশেষ নিবন্ধ

উত্তরপ্রদেশ নিয়ে বিজেপি শঙ্কায় কেন?
শান্তনু দত্তগুপ্ত

কথায় কথায় উত্তরপ্রদেশের এক বিজেপি নেতা ঘনিষ্ঠ মহলে বলেই ফেললেন, ‘৮০টার মধ্যে ৫০টা সিট তো পাব।’ তাতেও যে তিনি খুব আত্মবিশ্বাসী, তেমনটা নয়। সবচেয়ে বড় চমকের জায়গা হল সংখ্যাটা। ৫০। দশ বছর আগে নরেন্দ্র মোদি যখন ক্ষমতায় এসেছিলেন, উত্তরপ্রদেশ তাঁর ঝুলিতে দিয়েছিল ৭১টি আসন। তার পরেরবার, অর্থাৎ ২০১৯ সালে সংখ্যাটা ছিল ৬২। ন’টি আসন কমেছিল বটে, কিন্তু তাতে আধিপত্যে এতটুকু ফাটল ধরেনি। আর এবার তাঁদের দলের ভোট ম্যানেজাররাই বলছেন, অঙ্কটা ৫০’এ নেমে যাবে? একে কী বলা যায়? আশা, নাকি আশঙ্কা? 
নরেন্দ্র মোদির দিক থেকে দেখলে আশঙ্কা বলাই ভালো। ভারতের রাজনীতিতে একটা প্রবাদ আছে, উত্তরপ্রদেশ যার, সংসদ তার। সবচেয়ে বড় রাজ্য, সবচেয়ে বেশি আসন... এই রাজ্যে ৬০’এর বেশি নম্বর পাওয়া মানে ম্যাজিক ফিগারের দিকে অনেকটাই এগিয়ে যাওয়া। সেখানে ৫০টি বলতেও থতমত খাচ্ছে বিজেপি? কারণটা কী? সেটা অবশ্য ভাঙেননি ওই নেতা। আর তাই প্রশ্নের ঘনঘটা আরও বাড়ছে। এই উত্তরপ্রদেশেই রামমন্দির হয়েছে (মাত্র চার মাস আগে)। নরেন্দ্র মোদি শুধু নন, বিরোধীরা পর্যন্ত প্রথমদিকে ভেবেছিল, এই এক মন্দিরেই বিজেপি বাজিমাত করে দিতে পারে। কিন্তু সেই ধারণা যে ভুল, সেটা মাসখানেকের মধ্যেই ধীরে ধীরে বোঝা গিয়েছে। মোদিজির বোধহয় বুঝতে আরও একটু বেশি সময় লেগেছে। তিনি আত্মবিশ্বাসী ছিলেন... রামলালা তাঁকে তৃতীয় ইনিংস উতরে দেবেন। তাই গরমে গরমে ভোটটা করে নেননি। ‘যথা সময়ে’র অপেক্ষায় ছিলেন। কিন্তু লোকসভা নির্বাচন শুরু হওয়ার পর দেখলেন, মন্দির রাজনীতি তো খুব একটা কাজে লাগছে না! কীভাবে তিনি বুঝলেন? কোটি কোটি পাবলিকের মন বোঝা তো সহজ নয়! কপালে ভাঁজটা বাড়ে, যখন মানুষ ভোট দিতেই না যায়। প্রথম চারটে দফার ভোটে দেখা গিয়েছে, ২২ কোটি মানুষ বুথমুখো হননি। সেটা কেন? গরম? তাপপ্রবাহ? সেটা না হয় দেশের দু’তিনটে রাজ্যে ছিল। তাও প্রথম দু’দফায়। তারপর তো ভোট দেওয়ার মতো আবহাওয়া মিলেই গিয়েছে। আর প্রতি বছর এমন সময়েই দেশের নানা প্রান্তে ‘ভোট উৎসব’ হয়। আমরা ভোটের এই জলবায়ুর সঙ্গে পরিচিত। তাহলে ভোটারদের অনীহা কেন? গত লোকসভা ভোটের তুলনায় চলতি বছর পাঁচ কোটি ভোটার বেড়েছে। নতুন যাঁরা ভোটার তালিকায় নাম তোলেন, স্বাভাবিক প্রবণতা অনুযায়ী তাঁরা ভোটটা দিয়ে থাকেন। কারণ, প্রথমবার ভোট দেওয়ার একটা আলাদা রোমাঞ্চ থাকে। তাই ধরে নেওয়া যেতে পারে, নতুন ভোটাররা ভোট দিয়েছেন। তাহলে নিশ্চিতভাবেই ‘পোড় খাওয়া’ ভোটাররা বুথমুখো হননি। এবার প্রশ্ন হল, তাঁরা কারা? শাসকের পক্ষের? বিপক্ষের? নাকি পুরোদস্তুর ফ্লোটিং ভোটার?
দেশের গড় বিচার করলে প্রতি দফাতেই প্রায় ৩-৪ শতাংশ করে ভোটদানের হার কমেছে। নজর করার মতো বিষয় হল, যে কেন্দ্রগুলিতে বিজেপি ‘শক্তিশালী’ সেখানকার ভোটাররা বেশিমাত্রায় ঘরকুনো হয়ে থাকতে পছন্দ করেছেন। বিশেষ করে উত্তরপ্রদেশে। গত লোকসভা নির্বাচনের নিরিখে যোগীরাজ্যে প্রথম দফায় ৫ শতাংশ ভোট কম পড়েছে, দ্বিতীয় দফায় ৬.৭১ শতাংশ, তৃতীয় পর্বে আড়াই শতাংশের বেশি। শুধু চতুর্থ দফায় ভোটদানের হার গতবারের সঙ্গে গা ঘেঁষাঘেষি করে চলেছে। তাহলে কি নরেন্দ্র মোদির ডেডিকেটেড ভোটাররা বুথমুখো হচ্ছেন না? বিরোধীরা অবশ্য রিগিংয়ের অভিযোগও উড়িয়ে দিচ্ছে না। অন্তত ফারুকাবাদের ভিডিও সামনে আসার পর। তাতে দেখা গিয়েছে, এক কিশোর বুথে দাঁড়িয়ে একটার পর একটা ভোট দিয়ে চলেছে। 
তাও আবার মোবাইল ক্যামেরা অন রেখে। সে বলছে, এই ভোট দিলাম। বলেই বিজেপির পদ্ম প্রতীকের পাশের বোতামে চাপ দিচ্ছে। একে একে আটটি ভোট দিল সে। এবং বুথে উপস্থিত নির্বাচন কমিশনের প্রতিনিধিরা তাকে সেটা করতেও দিল। কেন? ওই কিশোর বিজেপি নেতার ছেলে বলে? এই ছাপ্পার পরেও অবশ্য ফারুকাবাদে ভোটদানের হার গতবারের পরিসংখ্যানকে ব্যাপকভাবে ছাপিয়ে যেতে পারেনি। ২০১৯ সালে এই কেন্দ্রে ভোট পড়েছিল ৫৮.৭১ শতাংশ। আর এবার ৫৮.৯৭ শতাংশ।
ভারতের ভোট রাজনীতিতে একটা থিওরি আছে—ভোটদানের হার যদি উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে যায়, সেটা শাসকের পক্ষে ক্ষতিকারক। তাহলে বুঝতে হবে, প্রতিষ্ঠানবিরোধী ভোট বেশি পড়েছে। যে কোনও লোকসভা ভোটে ৬৫ শতাংশ থেকে ৭০ শতাংশের মধ্যে ভোটদানের হার থাকাটাকে সুলক্ষণ বলে মনে করে শাসক। কিন্তু ২০২৪’এ এসে সেই থিওরি কতটা খাটবে, সেটাই এখন লাখ টাকার প্রশ্ন। কেন? ওই যে নতুন পাঁচ কোটি ভোটার! এক ধাক্কায় ৯২ কোটি থেকে ৯৭ কোটি হয়ে গিয়েছে ভোটারের সংখ্যা। সেই হিসেব ধরলে কিন্তু সমীকরণটা নতুনভাবে সাজানোর প্রয়োজন ছিল। এখন কি আর ৬৫ শতাংশের হিসেবে শাসক দলের রক্ষাকবচ তৈরি হবে? নাকি সেটা ৭০ শতাংশের উপর যাওয়া জরুরি? চলতি লোকসভা ভোটের ফল প্রকাশ হলে এই থিওরিটা অন্য একটা আকার পাবে বলেই ধারণা। সেক্ষেত্রে এই মুহূর্তে ভোটদানের হার কমে যাওয়ার অঙ্কেই ফোকাস করতে হবে। বিজেপির চিন্তার কারণ কী? ২০০৪ সালে মাত্র দুই শতাংশ ভোট কম পড়াতেই অটলবিহারী বাজপেয়ির সরকার পড়ে গিয়েছিল। কোনও দল সেবার একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি ঠিকই, কিন্তু সরকারের ভোটব্যাঙ্কই ভাগ হয়ে গিয়েছিল কংগ্রেস ও অন্যান্য আঞ্চলিক দলগুলির মধ্যে। এবার কংগ্রেস আগে থেকে জোট গঠন করে নির্বাচনী ময়দানে নেমেছে। উত্তরপ্রদেশে তাদের সঙ্গী সমাজবাদী পার্টি। রাহুল গান্ধী ও অখিলেশ যাদব একসঙ্গে সভা করছেন। আর সেখানে ভিড়ের ঠেলায় তাঁদেরই নাজেহাল দশা। হেলিকপ্টার থেকে তাঁরা নামতে পারছেন না, ভিড় প্রায় মঞ্চের উপর উঠে আসছে... এটাই এখন উত্তরপ্রদেশের প্রচার-চিত্র। সভার ভিড় কখনও ভোটভাগ্য নির্ধারণ করে না। রেকর্ড ভিড় সত্ত্বেও ভোটযন্ত্রে তার প্রভাব পড়েনি—এমন উদাহরণ ভূরি ভূরি আছে। কিন্তু ভিড়ের এই স্বতঃস্ফূর্ততা ইন্দিরা গান্ধীর পর কিছুটা দেখা গিয়েছিল ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদির আগমনিতে। আর এবার রাহুল-অখিলেশ যুগলবন্দি সভায়। তাহলে কি উত্তরপ্রদেশের ওই বিজেপি নেতার আশঙ্কা সত্যি হতে চলেছে? এখানে ৫০’এর নীচে নেমে যাবে মোদি ব্রিগেড? আর তিনি মোদি পরিবারের সদস্য বলে ধরে নেওয়াই যেতে পারে, কিছুটা গ্রেস মার্কস দিয়েই বিজেপিকে উপস্থাপনা করা হচ্ছে। সেই গ্রেসটুকু বাদ দিলে বিজেপি উত্তরপ্রদেশে ৪০ আসনে নেমে যাবে না তো? আশঙ্কাটা অমূলক নয়। বরং উদ্বেগের। উত্তরপ্রদেশে সমাজবাদী পার্টি এবং বহুজন সমাজ পার্টির বাহুবলী রাজনীতিতে বিজেপি তালা লাগিয়ে দিয়েছে। একের পর এক এনকাউন্টারে সমাজবাদীর ভোট মেশিনারির পঞ্চত্বপ্রাপ্তি ঘটেছে। যে ক’জন বাহুবলী বেঁচেবর্তে আছে, তারাও আন্ডারগ্রাউন্ড। অর্থাৎ, সমাজবাদী বা কংগ্রেস এবার আর ভোট ‘করাতে’ পারবে না। হয় বিজেপি করাবে, আর তা না হলে মানুষের মতদান। তারপরও ৫০ আসনের কনফিডেন্স নেই? 
একবার সাদা চোখে নজরে আসা দেশের সমীকরণগুলো সাজিয়ে নেওয়া যাক—১) উত্তরপ্রদেশে মোদি হাওয়া কাজ করছে না। রামমন্দিরও না। ২) পাঞ্জাব-হরিয়ানায় কৃষকদের ক্ষোভ এবং আম আদমি পার্টির আগ্রাসন। ৩) শিবির বদল করতে করতে বিহারে নীতীশ কুমার ইতিমধ্যেই ডুবিয়ে রেখে দিয়েছেন। মানুষ আর তাঁকে ভরসাই করতে পারছে না। ৪) তামিলনাড়ুতে স্ট্যালিন ঝড় এখনও চলছে। ৫) কর্ণাটকে বিজেপি নিজেরাই বলছে, ১৮ থকে ২০টা আসনে নেমে আসবে জয়ের পরিসংখ্যান। আর বিরোধীদের দাবি ১২টির উপর কেন্দ্র গেরুয়া বাহিনী পাবে না। ৬) পশ্চিমবঙ্গে এনডিটিভি, এমনকী বিবিসি পর্যন্ত বলছে, ৩০’এর বেশি পাবে তৃণমূল কংগ্রেস। আর বিজেপি ১১-১২টা। ৭) উত্তর-পূর্বে মণিপুর এফেক্ট এখনও দগদগে। এখানকার রাজ্যগুলি মিলিয়ে মোট ২৫টি আসন। ধরে নেওয়া গেল, অসমে বিজেপি ভালো ফল করবে। কিন্তু বাকি কোনও রাজ্যেই তারা নিরঙ্কুশ নয়। মণিপুরে বিজেপির উদাসীনতা ছিল, নাকি ইন্ধন... সেই প্রশ্ন আছে। থাকবেও। কিন্তু এই মুহূর্তে সাধারণ মানুষ বিজেপি এবং নরেন্দ্র মোদির উপর এতটাই রেগে আছে যে, পদ্মের ভোটভাগ্য ভালো হওয়ার সম্ভাবনা নেই। সেক্ষেত্রে আঞ্চলিক দলগুলো ভালো ফল করবে। আর পাবলিক সেন্টিমেন্টের গতিপ্রকৃতি বুঝে তারাও এনডিএতে যাওয়ার কথা ভাববে না। বরং ভোটে ‘ইন্ডিয়া’র ফল যদি সরকার গড়ার মতো হয়, তারা মহাজোটেই যোগ দেবে। তাহলে কোন অঙ্গে ৪০০ পার হচ্ছে? হয় বিজেপির হর্তাকর্তারা ওভার কনফিডেন্ট, আর না হলে তাঁরা জানেন, অন্তরালে কী চলছে। দুটোই কিন্তু গণতন্ত্রের জন্য ভয়াবহ। প্রথম সম্ভাবনায় শাসক জনতাকে চটির নীচের ধুলো বলে মনে করে। আর দ্বিতীয়টিতে, গণতান্ত্রিক সত্যতাকে দুমড়ে-মুচড়ে তারা নিজেদের সুবিধা মতো রূপ দিয়ে নেয়। ক্ষমতায় থাকার জন্য।
ইংরেজ দার্শনিক তথা রাজনীতিক জন স্টুয়ার্ট মিল বলতেন, ‘কোনও মহান ব্যক্তির প্রতি কৃতজ্ঞতা থাকতেই পারে। এর মধ্যে ভুল কিছু নেই। তিনি হয়তো আজীবন মানুষকে পরিষেবা দিয়েছেন। সমাজের জন্য, দেশের জন্য ভেবেছেন। কিন্তু তারপরও মনে রাখতে হবে, তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা যেন সীমা ছাড়িয়ে না যায়। সেই মহান ব্যক্তিকে আস্থা দেখাতে গিয়ে যেন ব্যক্তি স্বাধীনতা, আর গণতন্ত্রের বিসর্জন দিতে না হয়।’ মিলের কথাগুলো ১৯৪৮ সালে মনে করিয়ে দিয়েছিলেন বি আর আম্বেদকর। সংবিধান গৃহীত হওয়ার আগে। তাঁর আশঙ্কা ছিল, পৃথিবীর সর্ববৃহৎ গণতন্ত্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে যাওয়া ভারতবর্ষ যেন কখনও ব্যক্তিনির্ভর হয়ে না পড়ে। তাহলে তাকে আবার তুলে দাঁড় করানো খুব কঠিন কাজ হবে। কারণ, গণতন্ত্রের সঙ্গে স্বৈরতন্ত্রের ফারাকটা একটা সুতোর মতো। আর সেই সুতোটা হল শাসকের মানসিকতা। ইন্দিরা গান্ধীর ‘ইমার্জেন্সি’ বুঝিয়েছিল স্বাধীনতা বিসর্জনের যন্ত্রণাটা। ভারত আজ আরও একবার ব্যক্তিনির্ভর। উন্নয়ন নয়, পার্টি নয়... ব্যক্তি। গণতন্ত্র একে কখনও সমর্থন করে না। ভারতের আম জনতা সেটা মনে রাখছে তো?
2Months ago
কলকাতা
রাজ্য
দেশ
বিদেশ
খেলা
বিনোদন
ব্ল্যাকবোর্ড
শরীর ও স্বাস্থ্য
সিনেমা
প্রচ্ছদ নিবন্ধ
আজকের দিনে
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
mesh

পারিবারিক অশান্তির অবসানে গৃহ সুখ ও শান্তি বাড়বে। প্রেমের ক্ষেত্রে শুভ। কর্মে উন্নতি। উপার্জন বৃদ্ধি।...

বিশদ...

এখনকার দর
ক্রয়মূল্যবিক্রয়মূল্য
ডলার৮৩.২৬ টাকা৮৪.৩৫ টাকা
পাউন্ড১০৬.৪৬ টাকা১০৯.১২ টাকা
ইউরো৮৯.৭৬ টাকা৯২.২০ টাকা
[ স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া থেকে পাওয়া দর ]
*১০ লক্ষ টাকা কম লেনদেনের ক্ষেত্রে
দিন পঞ্জিকা