বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
বিশেষ নিবন্ধ
 

লড়াইটা মোদির আমিত্বের বিরুদ্ধে
তন্ময় মল্লিক

অপেক্ষার অবসান। প্রথম দফার ২১টি রাজ্যের ১০২টি আসনের ভোট গ্রহণ শেষ। বাংলায় তিনটি। সবচেয়ে বেশি কেন্দ্রীয় বাহিনী আসছে বাংলায়। তারমধ্যে সর্বাধিক মোতায়েন ছিল অমিত শাহের ডেপুটি নিশীথ প্রামাণিকের নির্বাচনী কেন্দ্র কোচবিহারে। বুথ পাহারায় ‘দাদার পুলিস’। সেই সুযোগে নিশীথবাবুর কেন্দ্রেই তৃণমূলের ব্লক সভাপতিকে পিটিয়ে ভোটের ‘প্রথম সকালে’ বেড়াল মারতে গিয়েছিল গেরুয়া শিবির। তাতে বিজেপির লাভ হল নাকি ক্ষতি, সেটা পরে বোঝা যাবে। তবে, প্রচণ্ড গরমের মধ্যেও মহিলাদের লম্বা লাইন গেরুয়া শিবিরের কপালে ভাঁজ ফেলেছে। কারণ, বাংলায় নরেন্দ্র ‘মোদির গ্যারান্টি’কে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘লক্ষ্মীর ভাণ্ডার’।
‘ইন্দিরা ইজ ইন্ডিয়া, ইন্ডিয়া ইজ ইন্দিরা।’ কথাটি কংগ্রেস নেতা দেবকান্ত বড়ুয়ার। সালটা ছিল ১৯৭৬। তার কয়েক মাস আগেই দেশে লাগু হয়েছে জরুরি অবস্থা। খর্ব হয়েছে মানুষের স্বাধীন মত প্রকাশের অধিকার। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর বিরোধিতা করলে জেলযাত্রা ছিল অনিবার্য। তেমনই এক পরিস্থিতিতে দেবকান্ত বড়ুয়ার এই মন্তব্য। দেবকান্তবাবু কংগ্রেসের সভাপতি, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী, এমনকী রাজ্যপালও হয়েছিলেন। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদ সামলেছেন। কিন্তু তিনি বিখ্যাত এবং একই সঙ্গে সর্বাধিক সমালোচিত হয়েছিলেন তাঁর এই মন্তব্যের জন্যই। নরেন্দ্র মোদি বিভিন্ন জনসভায় সেকথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলছেন, মানুষ অহঙ্কার পছন্দ করে না। সেই অহঙ্কারের জন্যই দেশবাসী কংগ্রেসকে ছুড়ে ফেলে দিয়েছিল।
একেবারে হক কথা বলেছেন আমাদের প্রধানমন্ত্রী। ১৯৭৮ সালের লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেসকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছিল গোটা দেশ। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী পর্যন্ত সেই নির্বাচনে পরাজিত হয়েছিলেন। মানুষ অহঙ্কারীকে অতীতেও পছন্দ করেনি, এখনও করে না, আগামী দিনেও করবে না। কিন্তু মোদিজি, আপনি নিজে কি সেই কথাটা বিশ্বাস করেন? নাকি শুধু কংগ্রেসকে আক্রমণের জন্যই ইতিহাসের পাতা থেকে তুলে এনেছেন অতীতকে?
‘নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ সকলের কথা খুব মন দিয়ে আগে শোনা। আমার এই ঈশ্বর প্রদত্ত ক্ষমতাটি রয়েছে। আমি কিন্তু নিজেও এই গুণটিকে নিয়ে চলি। আমার আরও একটি গুণ রয়েছে। তা হল আমি কখনওই কাজের সময় কে ফোন করল, কে মেসেজ করল, তা নিয়ে বিশেষ ভাবি না। আমি যখন কোনও কাজ করি, তখন নিজের ১০০ শতাংশ দিয়ে করি।’ বক্তা আর কেউ নন, স্বয়ং নরেন্দ্র মোদি। সম্প্রতি সংবাদমাধ্যমে এক সাক্ষাৎকারে এভাবেই নিজের ঢাক নিজে পিটিয়েছেন ‘বিশ্বগুরু’। এখানে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যটি হল, গত দশ বছরে তিনি একবারও সাংবাদিক সম্মেলন করেননি। কারণ কথা শুনতে নয়, কথা শোনাতে তিনি ভালোবাসেন।
দেবকান্ত বড়ুয়াকে মানুষ মনে রেখেছে তাঁর ‘তৈলাক্ত মন্তব্যে’র জন্য। নরেন্দ্র মোদিকেও মানুষ যুগ যুগ ধরে মনে রাখবে। কারণ রাষ্ট্রনায়ক হয়ে নিজের ঢাক নিজে পেটানোর এমন নজির অতীতে নেই, ভবিষ্যতে পাওয়ার সম্ভাবনাও অতীব ক্ষীণ। 
নির্বাচন আসতেই প্রধানমন্ত্রী ফের বাংলায় নিত্যযাত্রী হয়েছেন। ঘনঘন বাংলায় আসছেন। রাজনৈতিক ভাষণের মাঝে দু’চার লাইন বাংলাও বলছেন। বোঝা যাচ্ছে, তিনি বাংলা শিখছেন। এই সুযোগে ‘কে বড়’ ছড়াটা একবার মোদিজি পড়ে নিতে পারেন। তাতে বাংলার সংস্কৃতি, রুচি সম্পর্কে কিছুটা ধারণা হবে। ‘আপনারে বড় বলে, সেই বড় নয়/ লোকে যারে বড় বলে বড় সেই হয়।... বড় যদি হতে চাও, ছোট হও তবে।’ 
এবার প্রচারের স্টাইল বদলে ফেলেছেন নরেন্দ্র মোদি। একুশের ভোটে তাঁর টার্গেট ছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাই প্রতিটি জনসভায় তাঁকে কটাক্ষ করেছিলেন। মুখ থুবড়ে পড়েছিল বিজেপি। তাই আর ‘দিদি, অ দিদি’ বলে কটাক্ষ নয়, এবার তাঁর হাতিয়ার ‘আমিত্ব’। তিনি দেশজুড়ে আত্মপ্রচারে নেমেছেন। তাঁর আত্মপ্রচারের ধাক্কায় কেন্দ্রীয় সরকার এখন হয়ে গিয়েছে ‘মোদি সরকার’, ভারতীয় জনতা পার্টি হয়েছে ‘মোদির পার্টি’। তাই দলীয় হোর্ডিং থেকে সরকারি বিজ্ঞাপন, সর্বত্রই মোদির জয়গান।
এখন চলছে ‘মোদির গ্যারান্টি’। তাঁর কথায় ‘মোদির গ্যারান্টি হল গ্যারান্টি পূরণ হওয়ার গ্যারান্টি।’ তিনি বলছেন, ‘২০১৪ সালে মোদিকে দেশের মানুষ চিনত না। কিন্তু ১০ বছরে তাঁকে দেশের মানুষ চিনেছে। তাই সঠিকভাবে নির্বাচন করবে।’ তাঁর নিজের কাজের উপর ভরসা থাকলে তাঁকে এত ‘গ্যারান্টি’ দিতে হচ্ছে কেন? ১০ বছর দেশ চালানোর পরও তাঁর এত গ্যারান্টি দেওয়ার কি কোনও প্রয়োজন ছিল? মোটেই না। কিন্তু তাঁকে দিতে হচ্ছে। কারণ ‘আচ্ছে দিনের’ স্বপ্ন দেখিয়ে ২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসা নরেন্দ্র মোদি প্রায় কোনও প্রতিশ্রুতিই রক্ষা করেননি। 
বছরে দু’কোটি চাকরির আশ্বাস দিয়েছিলেন নরেন্দ্র মোদি। তা পূরণ যে হয়নি, বলাইবাহুল্য। উল্টে তাঁর আমলে দেশে বেকারত্ব বেড়েই চলেছে। ২০১৩-’১৪ অর্থবর্ষে দেশে বেকারত্বের হার ছিল ৪.৯ শতাংশ। এবছর ফেব্রুয়ারিতে  মাসে তা বেড়ে হয়েছে প্রায় ৮ শতাংশ। বাড়ছে অনাহারে, অর্ধাহারে, অপুষ্টিতে ভোগা মানুষের সংখ্যা। ২০১৮ সালে দেশে অনাহারে থাকা মানুষের সংখ্যা ছিল প্রায় ১৯ কোটি। ২০২৩ সালে তা বেড়ে হয়েছে প্রায় ৩৫কোটি। ক্ষুধা, বেকারত্ব সহ প্রায় সমস্ত ক্ষেত্রেই ভারতের অবনতি স্পষ্ট। তাই বিরোধীদের কটাক্ষ, মোদির গ্যারান্টি মানে দেশকে পিছিয়ে দেওয়ার গ্যারান্টি।
এরাজ্যে লড়াইটা নরেন্দ্র মোদির ‘আমিত্বে’র সঙ্গে বাংলার ‘বহুত্ববাদে’র। বিজেপির সিএএ চালুর উদ্দেশ্য, একটি বিশেষ ধর্মের মানুষকে নাগরিকত্ব থেকে বঞ্চিত করা। অন্যদিকে, বহুত্ববাদে বিশ্বাসী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন, বাংলায় যাঁরা আছেন, তাঁরা সকলেই দেশের নাগরিক। নরেন্দ্র মোদি মুখে বলছেন, ‘সব কা সাথ সব কা বিকাশ।’ অথচ বাংলার গরিব মানুষের ১০০ দিনের কাজ বন্ধ, বন্ধ আবাস যোজনার টাকা। বিকশিত হচ্ছেন মুষ্টিমেয় কিছু শিল্পপতি। কালাধনও ফিরিয়ে আনতে পারেননি। নীরব মোদি, মেহুল চোকসিদেরও দেশে ফেরাননি। এসব দেখে দেশের মানুষ বুঝেছে, স্লোগানে ও প্রচারে নরেন্দ্র মোদিই সেরা। তাঁর ধারেকাছে কেউ নেই। 
নরেন্দ্র মোদির প্রতিটি পদক্ষেপের একটাই লক্ষ্য, প্রচার। প্রচারের আলো কীভাবে নিজের দিকে ঘোরাতে হয় তা তিনি হাতেকলমে করে দেখিয়েছেন। নির্বাচন কমিশনের নিয়ম অনুযায়ী ভোটের ৪৮ ঘণ্টা আগে প্রচার শেষ করতে হয়। উনিশের নির্বাচনে নিজের কেন্দ্রের প্রচার শেষ করেই পৌঁছে গেলেন অমরনাথ। সমস্ত সংবাদমাধ্যমে জায়গা করে নিল ধ্যানমগ্ন প্রধানমন্ত্রীর ছবি। করোনাকালেও তিনি লক্ষ্যচ্যুত হননি। ভ্যাকসিন সার্টিফিকেটে ছাপানো হয়েছিল তাঁরই ছবি। 
বিশ্ববিদ্যালয়ের মঞ্জুরি কমিশন(ইউজিসি) এক নির্দেশিকায় জানিয়েছিল, বিশ্ববিদ্যালয়ে ও কলেজে ‘সেলফি জোন’ তৈরি করতে হবে। পড়ুয়া ও শিক্ষকরা সেখানে দাঁড়িয়ে ছবি তুলবেন। তবে, সেই সেলফি পয়েন্টের ব্যাকগ্রাউন্ডে নরেন্দ্র মোদির ছবি মাস্ট। এমনকী, কোন ইভেন্টে এবং প্রধানমন্ত্রীর কোন মুডের ছবি দিয়ে ব্যাকগ্রাউন্ড তৈরি হবে, সেটাও নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছিল। 
এখানেই শেষ নয়। কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়া, শিক্ষক এবং বিভিন্ন কাজে আসা অতিথিদের সেই সেলফি পয়েন্টে ছবি তোলার ব্যাপারে উৎসাহিত করার জন্য কর্তৃপক্ষকে দেওয়া হয়েছিল বিশেষ নির্দেশ। তরুণ প্রজন্মের মধ্যে নিজের ইমেজ তৈরির এমন পরিকল্পনা অতীতের কোনও প্রধানমন্ত্রী করেননি। কিন্তু মোদিজি পেরেছেন। কারণ কে কী বলল, কে কী ভাবল, তার তিনি তোয়াক্কা করেন না। সেই জন্যই মোতেরা স্টেডিয়ামের নাম বদলে তা নিজের নামে করে নিতে পেরেছেন। বিজেপির কর্মী সমর্থকরাও মোদিজির আত্মপ্রচারের বিষয়টি বুঝে গিয়েছেন। তাই দলীয় সমাবেশে যত না ‘বিজেপি জিন্দাবাদ’ ধ্বনি ওঠে তারচেয়েও অনেক বেশি শোনা যায় ‘মোদি-মোদি’ চিৎকার। কর্মীদের সেকাজে উৎসাহিত করার জন্য মোদিজি আবার ভাষণের মাঝে ‘পজ’ও দেন।
রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘অহংবোধ পৃথিবীর সবচেয়ে বড় চোর। সে স্বয়ং ভগবানের সামগ্রীও নিজের বলিয়া দাবি করিতে কুণ্ঠিত হয় না।’ সঙ্ঘের বিস্তারক থেকে তিনবারের মুখ্যমন্ত্রী, বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের দু’বারের প্রধানমন্ত্রী। এবার স্বপ্ন শুধু ক্ষমতায় ফেরার নয়, ৪০০ ছোঁয়ার। মোদিজি, অহঙ্কার হয়তো আপনাকেই মানায়। কিন্তু সমস্যাটা কোথায় জানেন? বাংলা আমিত্বে নয়, বহুত্ববাদে বিশ্বাসী। এটাই রবীন্দ্রনাথের শিক্ষা।

20th     April,   2024
 
 
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ