বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
বিশেষ নিবন্ধ
 

আজ থেকে পরীক্ষা শুরু তরুণদের
সমৃদ্ধ দত্ত

আপনাদের কাছে এই আজ থেকে যে মহাযুদ্ধ শুরু হচ্ছে, সেটি সবথেকে বড় অগ্নিপরীক্ষা। এটা মাথায় রাখবেন। আপনারা অর্থাৎ রাজ্যে রাজ্যে ছড়িয়ে থাকা ভারতীয় রাজনীতির তরুণ প্রজন্ম কতটা যোগ্য, কতটা আপনারা  নিজেদের প্রস্তুত করতে পারলেন এবং আগামী দিনে রাজ্যবাসী আপনাদের উপর কতটা বিশ্বাস, আস্থা কিংবা ভরসা করতে পারবে, মনে রাখবেন, সেই পরীক্ষাটি আজ থেকেই শুরু হচ্ছে। ৪ জুন কিন্তু নিছক অষ্টাদশ লোকসভার জয় পরাজয়ের ফলাফল প্রকাশিত হবে না। আপনারা, বিশেষ করে যাঁরা নিজেদের পূর্বসূরিদের থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে অধিকার এবং দায়িত্ব পেয়েছেন, সেদিন নিজেদের প্রমাণ করার সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হবে। আপনাদের মধ্যে সিংহভাগ তাঁরাই, যাঁদের পিতা ছিলেন একটি দলের প্রতিষ্ঠাতা অথবা সুপ্রিমো। তাঁরা তাঁদের সেই দায়িত্ব আজ থেকে চল্লিশ পঞ্চাশ বছর আগে কাঁধে নিয়েছিলেন। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস এবং ভারতীয় জনতা পার্টি নামক দুই শক্তিশালী জাতীয় দলের সঙ্গে টক্কর দিয়ে নিজেদের অস্তিত্বকে তাঁরা বজায় রেখেছেন, উন্নীত করেছেন এবং ক্ষমতা দখল করেছেন একক প্রচেষ্টায়। আবার বিখ্যাত ও ঐতিহাসিক জাতীয় দলের পারিবারিক পতাকাকে বহন করে নিয়ে গিয়েছেন এরকমও আছেন। নিজেদের মতো করে সফল হয়েছেন। দলকে শীর্ষে পৌঁছে দিয়েছেন। তাঁদের লড়াইগুলো মনে রাখবেন। তাঁরা শূন্য থেকে শুরু করেছিলেন। অনেক দিন হয়ে গেল আপনাদের সুযোগ দেওয়া হয়েছে। আপনারা এখনও কিন্তু আশাব্যঞ্জক পারফরম্যান্স দেখাতে পারছেন না। 
তেজস্বী যাদব, অখিলেশ যাদব, রাহুল গান্ধী, ওমর আবদুল্লা঩দের রাজনৈতিক কেরিয়ার একই খাতে বয়ে চলেছে। আমরা জানি গণতন্ত্র বিপন্ন। সংবিধান সঙ্কটে। বেকারত্ব চরমে। মূল্যবৃদ্ধির জেরে মানুষ হাহাকার করছে। কিন্তু আপনাদের কাছে প্রশ্ন, এই ইস্যু নিয়ে দেশে তোলপাড় করে দেওয়া আন্দোলন করতে পারলেন না কেন? আপনারা এখনও নিজেদের দলের কাছে গ্রহণযোগ্য নেতা হয়ে রইলেন। রাজ্য অথবা দেশের সকলের কাছে সমীহ পাওয়ার মতো সাফল্য কোথায়? কেন এখনও সেই ষাট, সত্তরোর্ধ্ব নেতা-নেত্রীরাই রাজনীতির অভিমুখ নিয়ন্ত্রণ করে চলেছেন! বিহারে তেজস্বী যাদবের একক ক্যারিশমা কোথায়? কেন তাঁকে জোটের উপর ভরসা করতে হয়? নীতীশকুমার থাকুন না থাকুন, তাঁকে এককভাবে বিজেপি ভয় পাবে না কেন? তিনি বনাম বিজেপি। এই জায়গায় নিয়ে যেতে পারলেন না কেন এখনও রাজনীতিকে? লালুপ্রসাদ যাদব, মুলায়ম সিং যাদবেরা কংগ্রেসের ভোটব্যাঙ্ক ছিনতাই করে নিয়েছিলেন। আটের দশক থেকে কংগ্রেসের শুধুই ক্ষয়িষ্ণু হওয়ার ইতিহাস। কখনও সংখ্যালঘু সরকার, কখনও জোট নির্ভর সরকার চালিয়েছে কংগ্রেস। কেন? কারণ এই আঞ্চলিক নেতা-নেত্রীরা কংগ্রেসের মেরুদণ্ড ভেঙে দিয়েছিল। 
তাঁরা প্রত্যেকেই ছিলেন এক একজন করে অসম সাহসী এবং মানুষের মধ্যে ম্যাজিক সৃষ্টি করা নেতা-নেত্রী। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, মায়াবতী, লালুপ্রসাদ যাদব, মুলায়ম সিং যাদব, নীতীশ কুমাররা প্রবল প্রতাপশালী হয়ে উঠলেন। প্রত্যেকে মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন। মমতা এবং নীতীশ কুমার ছাড়া বাকিরা দলের প্রধান পদ থেকে সরে গিয়েছেন। অসুস্থতা অথবা গুরুত্বহীনতার কারণে। মমতা এখনও নিজের দলের নীতি নির্ধারক। সেকেন্ড ইন কমান্ড হলেও, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় দল চালাচ্ছেন অথবা তৃণমূলের ভোটার ও সমর্থকরা তাঁকে দেখে ভোট দেন, এখনও সেই পর্যায় আসেনি। আগামী দিনে আসতে পারে। এখনও নয়। কিন্তু বাকি উত্তরাধিকারীরা কেন জ্বলে উঠতে পারলেন না এখনও?
তেজস্বী যাদব রাষ্ট্রীয় জনতা দলের কাণ্ডারী হয়েছেন উত্তরাধিকার সূত্রে। তিনি বিহারের সবথেকে সম্ভাবনাময় নেতা। জনপ্রিয় ও ক্যারিশমাটিক। কিন্তু কোথাও একটা খামতি রয়েই যাচ্ছে। এখনও তিনি এককভাবে ক্ষমতা দখল করতে পারার মতো পর্যায়ে যেতে পারলেন না। অখিলেশ যাদব যেদিন থেকে সমাজবাদী পার্টির দায়িত্ব হাতে তুলে নিয়েছেন, তারপর থেকে দলের ক্ষয় বেড়ে চলেছে। তিনি কিন্তু দলকে শক্তিশালী করতে পারেননি। কী হল ওমর আবদুল্লার? ফারুখ আবদুল্লাকে যাও-বা আজকাল কালেভদ্রে কোনও ইস্যুতে গর্জে উঠতে দেখা যায় এবং গরমাগরম সংলাপও উপহার দেন, সেই তুলনায় ওমর আবদুল্লা যেন প্রায় অবসরকালীন জীবন কাটাচ্ছেন। তাঁর দল আগামী দিনে থাকবে কি না সন্দেহ। মেহবুবা মুফতি সম্পূর্ণ দিশাহীন রাজনীতিতে প্রবেশ করেছিলেন অযথা বিজেপির সঙ্গে জোট করে জম্মু-কাশ্মীরে সরকার গঠন করে। একমাত্র উত্তরাধিকারীদের মধ্যে জগনমোহন রেড্ডি অবশ্যই নিজেকে প্রমাণ করেছেন। কংগ্রেসের ছায়া থেকে বেরিয়ে এসে দল গঠন করেছেন। এবং মুখ্যমন্ত্রী হয়ে চলেছেন। 
এবং রাহুল গান্ধী। আর কতদিন আপনি পরীক্ষা দেবেন? আপনি নিজেকে প্রশ্ন করুন এখনও নরেন্দ্র মোদি অথবা তাঁর দল  মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়দের যতটা ভয় করেন, গুরুত্ব দেন, আপনাকে কেন দেন না? জওহরলাল নেহরুর পর কিন্তু সহজেই ইন্দিরা গান্ধী কংগ্রেস নামক দলের সর্বেসর্বা হয়ে যাননি। এসব আপনি জানেন। তাঁকে দলেরই অন্যতম সর্বোচ্চ স্তরের নেতা মোরারজি দেশাই গুঙ্গি গুড়িয়া বলে তাচ্ছিল্য করেছিলেন। কারণ তিনি ক্ষমতাসীন হলেও চুপ করে থাকতেন। দলকে, দেশকে এবং প্রশাসনকে বোঝার চেষ্টা করতেন। তারপর একদিন তিনি ঐতিহাসিক দল ভেঙে বেরিয়ে এসে নিজেই নিজের দল গঠন করলেন। নিজের নাম সেই দলের সঙ্গে জুড়ে দিলেন। কালক্রমে সেই দলই হয়ে গেল আনুষ্ঠানিকভাবে জাতীয় কংগ্রেস। অর্থাৎ ইন্দিরা গান্ধীর মধ্যে সেই আগুন ছিল। উত্তরাধিকার সূত্রে পেলেই তো সফল হওয়া যায় না। রাজীব গান্ধী তার সবথেকে বড় প্রমাণ। বহু ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত ভারতীয় প্রশাসনে নিয়েছেন। কিন্তু দলকে নিজের কর্তৃত্বে আনতে ব্যর্থ হয়েছেন। আব কী বার চারশো পার পাওয়ার পাঁচ বছরের মধ্যে তিনি মুখ থুবড়ে পড়লেন। বিজেপির সঙ্গে হাত মিলিয়ে তাঁর প্রতিপক্ষরা তাঁকে দুর্নীতিগ্রস্ত আখ্যায় ভূষিত করল। অথচ তিনি পাল্টা প্রচার ও আক্রমণে ব্যর্থ হলেন। তারপর যখন ফিরে আসছিলেন তখন অকালে মর্মান্তিক মৃত্যু হল। কিন্তু কংগ্রেস শক্তিশালী আর রইল না। 
এসব ইতিহাস জানা সত্ত্বেও এখনও রাহুল গান্ধী, তেজস্বী যাদব, অখিলেশ যাদবরা মাটি কামড়ে, সিরিয়াস রাজনীতি করে নরেন্দ্র মোদি নামক এক হিমালয়সম শক্তিকে ধাক্কা দিতে পারছেন না। উল্টে তাঁরা মাঝেমধ্যেই অপরিণত রাজনীতি করে লড়াইকে হালকা করে দিচ্ছেন। কেউ নবরাত্রির সময় মাছের ভিডিও দেখাচ্ছেন। দেখিয়ে রাজনৈতিক লাভ এক বিন্দু কী হয়েছে? বুঝিয়ে বলুন। রাহুল গান্ধী এখনও পর্যন্ত স্পষ্ট করে ঘোষণা করতে পারলেন না যে, তিনি আমেথি কেন্দ্র থেকে প্রার্থী হবেন কি না। বলছেন, দল যা বলবে তাই হবে। এটা কোনও বিবৃতি? নরেন্দ্র মোদি কিংবা আপনি, আপনারাই তো দল! এই যে শোনা যাচ্ছে, কেরলের ওয়েনাড়ে ভোট হয়ে গেলে তারপর কংগ্রেস ঘোষণা করবে আমেথি থেকে রাহুল প্রার্থী হচ্ছেন এই মর্মে। এই জল্পনা এবং গুঞ্জন  ওয়েনাড়ের মানুষের কানেও গিয়েছে। তাঁরা কী ভাববেন? শারদ পাওয়ার যতই চেষ্টা করুন সুপ্রিয়া সুলে আজও নিজের প্রভাবকে প্রবলভাবে প্রতিষ্ঠিত করতেই পারলেন না। বরং দল ভেঙে গেল। কোথায় বালাসাহেব থ্যাকারের সেই দাপট? কী করলেন উদ্ধব থ্যাকারে ওরকম দাপুটে পিতার রাজনৈতিক রাজপাট পেয়ে? ধরে রাখতে পারলেন না। আদিত্য থ্যাকারের কোনও উপস্থিতিই টের পাওয়া যায় না। 
 বিজেপি তো দল ভাঙার খেলা, সরকার ভাঙার খেলা করবেই। টাকা আছে। ক্ষমতা আছে। প্রভাব আছে। এজেন্সি আছে। কিন্তু সেটাই তো নিজের নেতৃত্বক্ষমতার সবথেকে বড় পরীক্ষা। আপনারা কেন নিজেদের প্রবল প্রভাব ও সম্মাননীয় অস্তিত্ব রচনা করতে পারলেন না? পারিবারিক সূত্রে আপনাদের একটি আস্ত দল, সংগঠন, ইতিহাস, ভোটব্যাঙ্ক সবই এসেছে। অথচ সেই মিথকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার তুলনায় নড়বড়ে করে দিচ্ছেন। 
তরুণ প্রজন্ম এবং উত্তরাধিকার সূত্রে দলের প্রধান হওয়া নেতাদের কাছে এই ভোট বিশেষ তাৎপযপূর্ণ। তাঁরা তাঁদের দলকে কতটা শক্তিশালী রাখতে পারবেন, কত আসন এককভাবে পাবেন, নতুন প্রজন্মের ভোটারকে কতটা কাছে আনতে পারছেন, সর্বজনগ্রাহ্য নেতানেত্রী হওয়ার ম্যাজিক নির্মাণের সম্ভাবনা কতটা আছে, এসবই এবার প্রমাণিত হবে। 
সুকুমার সেন নামক এক বাঙালিকে প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু দায়িত্ব দিয়েছিলেন ভারত নির্মাণের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভকে কার্যকর করার প্রক্রিয়া তিনি যেন শুরু করেন। নেহরু চাইছিলেন যত দ্রুত সম্ভব। ১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি সাধারণতন্ত্র চালু হল। নেহরু চাইলেন কয়েক মাসের মধ্যেই শুরু হোক গণতন্ত্রের সবথেকে বড় পরীক্ষা। অর্থাৎ লোকসভা ভোট। সুকুমার সেন জানতেন এই কাজ কতটা কঠিন। তিনি আরও সময় চাইলেন। ১৯৫১ সাল থেকে অবশেষে শুরু হল আধুনিক গণতান্ত্রিক ভারতের পথ চলা। ২০২৪ সালের লোকসভা ভোট একটি বাঁকে এসে দাঁড়িয়েছে। আগামী দিনে গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, সংবিধান, বাকস্বাধীনতা, বহুত্ববাদী ভারত কোনদিকে যাবে? স্বাধীনতার পর এটাই সম্ভবত সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন হতে চলেছে। অতএব তরুণ প্রজন্মের বিরোধী নেতা-নেত্রীদের ভূমিকার উপর অনেকটাই নির্ভর করছে আগামী ভারতের ভাগ্য! তাঁদের কাছে এই লোকসভা ভোট নিজেদের যোগ্যতারও লিটমাস টেস্ট! সম্মিলিতভাবে তাঁদের পারফরম্যান্স ইতিবাচক হলেই ভারতের চরিত্র বদল হয়তো হবে না। থমকে যাবে! 

19th     April,   2024
 
 
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ