বিশেষ নিবন্ধ

‘আপ রুচি খানা’
মৃণালকান্তি দাস

দ্বারকার ক্ষত্রিয়ভূমিতে মদ্য-মাংসের বারণ ছিল না, তার প্রমাণ মহাভারতে আছে। আর অযোধ্যার পথেঘাটে ছিল সুরা-মদের ছড়াছড়ি। বলে গিয়েছেন বাল্মীকি।
রামচন্দ্র তো একেবারেই ক্ষত্রিয় বংশের। মাছ, মাংস কিংবা সুরা তাঁর বাদ থাকবে কেন? খাওয়ার ব্যাপারে রাম ছিলেন রীতিমতো সুরসিক। ভালো ভালো রাঁধিয়েরা রামের কাছে রান্নার তারিফ শোনার জন্য ‘আমি রাঁধব, আমি রাঁধব’ বলে সুস্বাদু পান-ভোজন প্রস্তুত করতেন— অহংপূর্বাঃ পচস্তি স্ম প্রশস্তং পান-ভোজনম্। মুশকিলটা ভক্তদের নিয়ে। তাঁরা রাম কিংবা কৃষ্ণকে প্রীত করার জন্য উপাসকের বিধি মেনে ত্যাগ-বৈরাগ্যের মাধ্যমে নিরামিষ আহার করে শরীর শুদ্ধ করেন— এটাই নাকি ভক্তভাব।
অথচ, বিশিষ্ট পুরাণ বিশেষজ্ঞ নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ীর কথায়, ‘বনবাসের প্রথম দিকে অরণ্য-প্রকৃতির মাধুর্য রামচন্দ্রকে রাজভোগ ভুলিয়ে দিলেও মাংস খাওয়া ভোলাতে পারেনি। বনবাসের প্রথম দু-তিন দিনের রাত্রি শুধু জল খেয়েই কাটিয়ে দিয়েছিলেন— সেটা অভিমানবশত, না অন্য কারণে— বাল্মীকি তা স্পষ্ট করে বলেননি। কিন্তু বনবাসের তৃতীয় দিনে সুমন্ত্র সারথি আর গুহককে বিদায় দিয়ে যেই না রামচন্দ্র গঙ্গাপারের অরণ্যসঙ্কুল ভূমিখণ্ডে পৌঁছান, তখনই খিদের চোটে আগে তিন রকমের হরিণ আর একটি শুয়োর মেরে ফেলেছিলেন— তৌ তত্র হত্বা চতুরো মহামৃগান্ বরাহমৃষ্যং পৃষতং মহারুরুম্। আদায় মেধ্যং ত্বরিতং বুভুক্ষিতৌ। খিদে বেশি লাগলে খাবারের জোগাড় কম থাকলে ভালো লাগে না— এই মনস্তত্ত্ব থেকেই হয়তো তিনজনের জন্য চারটে গোটা পশু মেরে ফেলেছিলেন দুই ভাই। কিন্তু পুরোটা তাঁরা খেতে পেরেছিলেন কি না, সে তথ্য আমরা বাল্মীকির কাছে পাইনি। ...দু’ভাই সীতাকে নিয়ে যেদিন চিত্রকূটে বাল্মীকির আশ্রমে পৌঁছলেন, সে দিনটা ছিল বনবাসের পঞ্চম দিন। জায়গাটাও রামের ভারী পছন্দ এবং তৎক্ষণাৎ লক্ষ্মণকে ডেকে তিনি বললেন কাঠ-পাতা দিয়ে একটি পর্ণকুটির তৈরি করতে। পর্ণকুটির তৈরি হলে সেই বনবাসের মধ্যেও রামের ইচ্ছে হল সামান্য একটি গৃহপ্রবেশের অনুষ্ঠান করতে। কিন্তু এই অনুষ্ঠানের প্রথম অঙ্গ হিসেবে রাম ছোট ভাইকে বললেন— একটা হরিণ মেরে আনো আগে— মৃগং হত্বানয় শীঘ্রম্। হরিণের মাংস দিয়েই আজ আমাদের বাস্তুপূজা সারতে হবে— ঐণেয়ং মাংসমাহৃত্য শালাং যক্ষ্যামহে বয়ম্।’ এসব তথ্য তো বাল্মীকির রামায়ণে লিপিবদ্ধ রয়েছে। রামভক্তরা কি তা জানেন?
এ দেশে আমিষ-নিরামিষের বৈচিত্র্যের রসায়ন দীর্ঘদিন ধরেই প্রচলিত। যে বাড়ির খাওয়া-দাওয়া মূলত আমিষ ঘরানার, সেখানেও সপ্তাহে একদিন কি দু-দিন নিরামিষ হয়। যাঁরা একান্তই নিরামিষ খান, তাঁরা ভুলেও আমিষের পথ মাড়ান না। খাবারের ক্ষেত্রে নিশ্চয়ই এই স্বাধীনতা থাকা উচিত। এ নিয়ে কেউ কোনওদিন বিরোধিতাও করেনি। তবে, সম্প্রতি আমিষ এবং নিরামিষ দ্বন্দ্বের যে মাত্রা স্পর্শ করেছে, তা আদতে জাতভিত্তিক সমাজের ভাগাভাগির ফাটলকেই নতুন করে চিহ্নিত করছে। আর তাকে উস্কে দিচ্ছেন দেশের প্রধানমন্ত্রী নিজেই। সম্প্রতি ভোট প্রচারে নবরাত্রির সময় বা শ্রাবণ মাসে মাছ-মাংস খাওয়া বা তার ভিডিও নেট-দুনিয়ায় দেওয়াকে ‘মোগলদের মানসিকতা’ বলে আক্রমণ করেছেন মোদি। প্রশ্ন উঠেছে, নবরাত্রি, শ্রাবণ মাসে দেশের একাংশের হিন্দুরা নিরামিষ খান বলে তাঁদের রুচি-পছন্দ মেনে বাকি অংশের মানুষকেও নিরামিষ খেতে হবে বা লুকিয়ে মাছ-মাংস খেতে হবে? ফেসবুক-টুইটারে প্রশ্ন উঠেছে, এরপরে কি দুর্গাপুজোর সময় মাংস খেয়ে ছবি দিলে সেটাও ‘মোগল মানসিকতা’ বলে নিন্দিত হবে? নাকি গোটা দেশের খাদ্য, পরিধান, সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য মুছে দিয়ে মোদিজি সকলের উপরে নিজের পছন্দমাফিক রুচি-অভ্যাস চাপিয়ে দিতে চাইছেন? গুজরাতি সংস্কৃতি বাংলা মানবে কেন?
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, হরিয়ানা, রাজস্থান এবং গুজরাতে নিরামিষাশীরা জনসংখ্যার ৫০ শতাংশের বেশি। বাকি গোটা দেশেই আমিষভোজীরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। পশ্চিমবঙ্গ ও কেরলের ৯৯ শতাংশই তো মাছ-মাংস বা ডিম খান। মনে হতেই পারে, পশ্চিম আর উত্তর-পশ্চিম ভারত কেমন যেন একদিকে আর এ দেশের বাকি রাজ্যগুলি বিপরীতে। তা সত্ত্বেও হিন্দুত্ববাদীরা ভারতে নিরামিষভোজীদের সংখ্যাগুরু বলে দাবি করে চলেছে। গেরুয়া শিবির আমিষাশীদের নিম্নবর্ণ কিংবা অহিন্দু বলে দেখাতে চায়। তাদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রশ্রয়েই নব নব রূপে ছুতমার্গের প্রকাশ ঘটছে। আমিষ-স্পর্শ বর্জন তেমনই রূপ। ‘আমিষ পরিহার’ থেকে কিছু অবিবেচক মানুষকে ‘আমিষাশী পরিহার’-এর দিকে কত সহজে ঠেলে দেওয়া যায়, গোরক্ষকদের তাণ্ডবেই তা প্রমাণিত। ২০১২-২০২৩ সময়কালে আশিরও বেশি ভারতীয় মহিষ বা আর কোনও মাংস আহারের জন্য খুন হয়েছেন। শিশুদের প্রোটিনের অভাব সত্ত্বেও বহু রাজ্যে স্কুলগুলি ঝুঁকছে নিরামিষের দিকে। দলিত মেয়েদের রান্না খেতে আপত্তি উঠছে।
মহম্মদ আখলাককে যেদিন ‘গোমাংস ভক্ষণকারী’ বলে পিটিয়ে মারা হয়েছিল, আমরা ভেবেছিলাম ব্যাপারটা ‘গোমাতা’ ও ‘বিধর্মী’কেন্দ্রিক। আসলে বিক্ষিপ্ত শক্তি দেখানোর সেটা ছিল শুরুয়াত। আখলাকের খুনিদের হাত লম্বা হতে হতে ‘সমধর্মী’-দের টুঁটিও চেপে ধরছে। আমিষ খাওয়াকে গো-বলয় আগেই অপরাধ সাব্যস্ত করেছিল। এখন গোটা ভারতেই ‘নিষেধাজ্ঞা’র চাপ। প্রস্তুতি চলছিলই— জাতীয় গ্রন্থাগারের প্রদর্শনীতে আমিষ নিষেধ, গান্ধীজির জন্মদিনকে ‘নিরামিষ দিবস’ বলে প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে ভারতীয় রেলে আমিষ বন্ধ রাখার চেষ্টা। এই আমিষবিদ্বেষীর দল যখন যে রাজ্যে ক্ষমতা দখল করেছে, নিরামিষের দাবিতে হয়েছে জবরদস্তি। উত্তরপ্রদেশ, হরিয়ানা ও দিল্লির কিছু এলাকায় নবরাত্রিতে মাংস বিক্রি বন্ধের ফরমান জারি হয়েছে। আমেদাবাদের পথে এবং স্কুল ও ধর্মস্থানের কাছে সব মাংসের দোকান বন্ধের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। গুরুগ্রামে বিশেষ দিনে মাংস বিক্রি নিষেধ। বরোদা, রাজকোটে মাংস বিক্রি করতে হলে তা লুকিয়ে করার ফরমান দেওয়া হয়েছে। নিরামিষ ‘আগ্রাসন’ থেকে বাদ যায়নি শিশুরাও। ১২টি রাজ্যে মিড-ডে মিলে ডিম বাদ। পরিকল্পিতভাবেই আমিষবিদ্বেষ ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। বলা হচ্ছে— আমিষ নাকি মানুষকে হিংস্র বানায়!
বোঝা যায়, এই কঠোর রাজনৈতিক নিষেধাজ্ঞা শুধু একটি ধর্মকেন্দ্রিক কট্টর মতবাদের পরিচয়ই দেয় না, এর পিছনে আছে কিছু গোঁড়া উচ্চবর্ণ হিন্দু সম্প্রদায়ের আধিপত্য। সঙ্গে বেড়েছে অসহিষ্ণুতাও। মনোবিজ্ঞানী ভিক্টর ফ্র্যাঙ্কল দেখিয়েছিলেন, মানুষের ভিতরে একটা সুপ্ত ফ্যাসিবাদী মানসিকতা থাকে, বিভিন্ন সময় কেউ একটা তাকে জাগিয়ে তোলে। ঠিক যেমন, আগ্রাসী হিন্দুত্ব আজ দেশের মানুষের একটা বড় অংশের কাছে কাঙ্ক্ষিত। একদিকে নিজেকে নিপীড়িত মনে করা ও অন্যদিকে নিজেদের অস্বাভাবিক মূল্যবান ভাবার প্রবণতা— এই দু’টি হল ফ্যাসিবাদী চিন্তার দুই স্তম্ভ। বহু হিন্দুর মজ্জায় মজ্জায় এই মানসিকতার অনুপ্রবেশ ঘটেছে। এই কারণেই গোরক্ষাকে কেন্দ্র করে গণপ্রহার, এমনকী হত্যাকাণ্ডের পরে অল্প কিছু উদার মনোভাবাপন্ন নাগরিক প্রতিবাদ করেছেন বটে, কিন্তু তাতে বিশেষ ফল হয়নি। দেশজুড়ে এক গা-ছমছমে নীরবতা বহাল থেকেছে। নিজের রুচি ও পছন্দ মাফিক খাওয়ার অধিকার সংবিধানে স্বীকৃত— এ সব তথ্য ও যুক্তি হিন্দুদের একটা বড় অংশের কাছে অর্থহীন।
সেই তথাকথিত হিন্দুরা কি বাল্মীকির লেখা পড়েছেন? বাল্মীকি জানাচ্ছেন, ‘চিত্রকূট পাহাড়ের এক জায়গায় বসে পাহাড়-ছোঁয়া মন্দাকিনীর তরঙ্গশোভা দেখাতে দেখাতে রামচন্দ্র যে বিষয়ে সীতাকে প্রলোভিত করে তুলতে চাইছিলেন, সেটা কিন্তু সেই হরিণের মাংস— সীতাং মাংসেন ছন্দয়ন্। সীতা বোধ হয় আর খেতে চাইছিলেন না। রাম বললেন— একটু খেয়েই দেখো না। ইদং মেধ্যম্, ইদং স্বাদু।’ হিন্দুধর্মের স্বঘোষিত রক্ষাকারীদের জানা প্রয়োজন, হিন্দুধর্মে কখনওই কারও উপর খাদ্যাভ্যাস জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হয়নি! সাধারণত বৈষ্ণব শাস্ত্রে অহিংসাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। আর শাক্ত ও শৈবদের শাস্ত্রে আমিষাহারকে সমর্থন জানানো হয়েছে। পূজার আবশ্যকীয় অঙ্গরূপে বলিদান করতে বলা হয়েছে। বৈদিক যুগে বলিদান ও সোমরসপান যজ্ঞের আবশ্যকীয় অঙ্গ ছিল। রামচন্দ্র ও কৃষ্ণ উভয়েই মাংসাহারী ছিলেন। মহাবীর ও বুদ্ধ‌ও তাই। ভারতীয় ইতিহাসের গবেষকদের মতে, মূলত বৌদ্ধ ও জৈনধর্মের প্রভাবে ভারতীয় সমাজে সপ্তম-অষ্টম শতক থেকে অহিংসাকে অত্যধিক গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। আধুনিক বৈষ্ণবধর্ম বৌদ্ধ অহিংসার দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত। কিন্তু অন্যান্য শাখায় নিরামিষাহারকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়নি! হিন্দু ধর্ম বরাবর বহুত্বে বিশ্বাস করে এসেছে। কিন্তু মোদি জমানায় তাকে একটি সঙ্কীর্ণ একরূপী অভিন্ন ব্র্যান্ড-এ পরিণত করা হচ্ছে। লক্ষ্য করুন, গেরুয়া ভক্তরা এখন নিজেদের ‘পিওর ভেজিটেরিয়ান’ বলে গর্ব অনুভব করেন। অথচ, এই শব্দবন্ধটির মধ্যেই ছুতমার্গের দ্যোতনা রয়েছে। ইংরেজির ‘পিওর’ শব্দটির অর্থ ‘পবিত্র’। এর অর্থ, ‘পিওর ভেজিটেরিয়ান’ শব্দের প্রয়োগ আসলে আমিষাশীকে ‘অপবিত্র’ বলে চিহ্নিত করার কৌশল!
ভিক্টর উলরিখ তাঁর সম্প্রতি প্রকাশিত ‘হিটলার: অ্যাসেন্ট’ নামে জীবনীগ্রন্থে দেখিয়েছেন, একনায়কের কদর্য বক্তৃতা এবং মতামতগুলি রীতিমতো পরিকল্পনা করেই তৈরি করা হতো, যাতে সংবাদমাধ্যমের নজর কাড়া যায়, জাগিয়ে তোলা যায় জনতার বিপুল প্রতিক্রিয়া। মোদিজি কি আমিষ ভক্ষণকারীদের ‘মোগলদের মানসিকতা’ বলে কোনও নজর কাড়তে পারলেন? নিরামিষাশী জনগণকে কি আমিষাশীদের বিরুদ্ধে জাগিয়ে তুলতে পারলেন? গুজরাত, রাজস্থানের মতো বাংলায় কি তা সম্ভব? বাঙালিরা তো ‘আপ রুচি খানা’-তেই বিশ্বাসী!
3Months ago
কলকাতা
রাজ্য
দেশ
বিদেশ
খেলা
বিনোদন
ব্ল্যাকবোর্ড
শরীর ও স্বাস্থ্য
সিনেমা
প্রচ্ছদ নিবন্ধ
আজকের দিনে
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
mesh

পারিবারিক অশান্তির অবসানে গৃহ সুখ ও শান্তি বাড়বে। প্রেমের ক্ষেত্রে শুভ। কর্মে উন্নতি। উপার্জন বৃদ্ধি।...

বিশদ...

এখনকার দর
ক্রয়মূল্যবিক্রয়মূল্য
ডলার৮৩.২৬ টাকা৮৪.৩৫ টাকা
পাউন্ড১০৬.৪৬ টাকা১০৯.১২ টাকা
ইউরো৮৯.৭৬ টাকা৯২.২০ টাকা
[ স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া থেকে পাওয়া দর ]
*১০ লক্ষ টাকা কম লেনদেনের ক্ষেত্রে
দিন পঞ্জিকা