বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
বিশেষ নিবন্ধ
 

আমে-দুধে মেশায় আইএসএফ এখন ‘আঁটি’
তন্ময় মল্লিক

ডুবন্ত মানুষ বাঁচার আশায় খড়কুটোকেও আঁকড়ে ধরে। একুশের নির্বাচনে সেই আশায় ডুবন্ত সিপিএম আইএসএফকে আঁকড়ে ধরেছিল। বাংলার রাজনীতিতে টিকে থাকার জন্য ব্রিগেডের জনসভায় অধীর চৌধুরীকে সরিয়ে দিয়ে আইএসএফ নেতা আব্বাস সিদ্দিকীর হাতে মাইক্রোফোন তুলে দিয়েছিলেন মহম্মদ সেলিম। আর এখন? আইএসএফের গুঁতোয় সেলিমের প্রাণ ওষ্ঠাগত। মুক্তির পথ, ‘অধীরং শরণং গচ্ছামি’। বাংলার অন্যত্র কংগ্রেস-সিপিএম জোট নিয়ে জট থাকলেও মুর্শিদাবাদে নেই। উনিশের ভোটে চতুর্থ স্থানে থাকা সিপিএমকে মুর্শিদাবাদ লোকসভা আসনটি ছেড়েছে কংগ্রেস। জোট নিয়ে অধীরবাবুর এই ‘উদারতা’ আগে কেউ দেখেনি। তবে এটা ‘লিমিটেড টাইম অফার’। কেবল চব্বিশের লোকসভা ভোটের জন্য ‘আম’ আর ‘দুধ’ মিশেছে। তাই আইএসএফ আপাতত ‘আঁটি’। 
বাংলায় ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর প্রতিটি নির্বাচনে বামেদের শক্তি কমেছে। বারবার স্লোগান দিয়েও ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে উৎখাত করার আশায় কখনও ‘বুর্জোয়া’ কংগ্রেসের সঙ্গে, কখনও ‘সাম্প্রদায়িক শক্তি’ আইএসএফের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে। কিন্তু ‘আত্মনির্ভর’ হওয়ার চেষ্টা করেনি। কখনও নীতির সঙ্গে, কখনও আদর্শের সঙ্গে সমঝোতা করায় বামপন্থায় বিশ্বাসী মানুষজন সিপিএমের পাশ থেকে সরে গিয়েছে। বাংলায় ‘শূন্য’ তারই পরিণতি।
একুশের নির্বাচনে তৃণমূলের সংখ্যালঘু ভোটব্যাঙ্ক ভাঙার আশায় আইএসএফকে তোল্লা দিয়েছিল সিপিএম। শরিকি আপত্তিকে আমল দেয়নি। হাত মিলিয়েছিল আইএসএফের সঙ্গে। সেলিম সাহেবরা বেড়ালকে ‘বাঘ’ বানাতে গিয়েছিলেন। এখন সেই বাঘই ঘাড় মটকাতে চাইছে। তাই ‘বাঘ’কে ‘পুনঃ মুষিকঃ ভবঃ’ করার চেষ্টা।
চব্বিশের নির্বাচন বাংলায় সিপিএমের জন্য সবচেয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জ। ২০১১ সালের নির্বাচনটা বামেদের কাছে খুব কঠিন ছিল। বামেদের তাড়া করছিল ক্ষমতা হারানোর ভয়। কিন্তু ২০০৯ সাল থেকেই বোঝা যাচ্ছিল, বামেরা ক্ষমতা থেকে যেতে চলেছে। কংগ্রেসের সঙ্গে তৃণমূলের জোট হওয়ায় তা নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এবারের লোকসভা নির্বাচন সিপিএমের অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই। ভোট ফেরাতে না পারলে বাংলার রাজনীতিতে প্রাসঙ্গিকতা আর থাকবে না। তাদের ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াইয়ের কফিনে শেষ পেরেকটা এবারই পোঁতা হয়ে যাবে।
সিপিএম নেতারাও সেটা জানেন। সেই 
জন্যই এবার নির্বাচনে সম্ভবনাময় এক ঝাঁক তরুণকে প্রার্থী করেছে। পাশাপাশি রাজ্য সম্পাদক মুর্শিদাবাদ কেন্দ্রে প্রার্থী হওয়ার পার্টির একাংশের মধ্যেই প্রশ্ন রয়েছে। তাদের বক্তব্য, দল এক কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। রাজনীতি নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে কর্পোরেট সংস্থা দ্বারা। এই পরিস্থিতিতে রাজ্যজুড়ে জনমত সংগঠিত করার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারতেন দলের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম। কিন্তু তিনি প্রার্থী হওয়ায় ৭মে পর্যন্ত একটি কেন্দ্রেই নিজেকে সীমাবদ্ধ করে ফেললেন। 
সেলিম সাহেব প্রার্থী হওয়ায় লঙ্ঘিত হয়েছে 
‘এক ব্যক্তি এক পদ’ নীতি। বিরোধীদের কটাক্ষ, মহম্মদ সেলিম ‘পরিযায়ী প্রার্থী’ হয়ে গিয়েছেন। জেতার ক্ষীণতম সম্ভাবনা থাকলেই তিনি 
সেখানে প্রার্থী হওয়ার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ছেন। 
২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে রানিং এমপি অবস্থায় তিনি হেরে গেলেন। তারপর আর উত্তরবঙ্গের দিকে ফিরেও তাকালেন না। একুশে হুগলির চণ্ডীতলার আসনটি বামেদের ‘পজিটিভ’ বলে মনে হল। কারণ শাসক দলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব। মুসলিম ভোটের লোভে ঝাঁপিয়ে পড়ে আইএসএফের সঙ্গে জোট করলেন। তিনি সেখানে প্রার্থীও হলেন। কিন্তু বেড়ালের ভাগ্যে শিকে ছিঁড়ল না। 
২০২২ সালে দলের কঠিন সময়ে তাঁকে রাজ্য সম্পাদক করা হল। সূত্রের খবর, তিনি এই দায়িত্ব নেওয়ায় খুব একটা আগ্রহী ছিলেন না। তাঁকে একপ্রকার জোর করেই রাজ্য সম্পাদক করা হয়েছিল। তখন অনেকে ভেবেছিলেন, পার্টির রাজ্য সম্পাদক হয়ে যাওয়ায় তিনি আর ভোটে দাঁড়াবেন না। কিন্তু সেই ধারণাকে ভুল প্রমাণ করে ফের তিনি প্রার্থী। 
প্রশ্ন উঠছে, সিপিএমের শীর্ষ নেতৃত্বের মধ্যেও কি তাহলে জনপ্রতিনিধি হওয়ার ‘ডানপন্থী ঝোঁক’ ঢুকে গিয়েছে? তা না হলে সেলিম সাহেব রাজ্য সম্পাদক হয়েও ফের প্রার্থী হতে গেলেন কেন? তিনি লোকসভায় দলের ডেপুটি লিডার ছিলেন। রাজ্যের মন্ত্রীও ছিলেন। এখন তিনি রাজ্য সম্পাদক। তাঁর রাজনৈতিক জীবন অনেক লম্বা। প্রচুর অভিজ্ঞতা। সেটাকে কাজে লাগিয়ে কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলায় তিনি মন দিতে পারতেন। তা না করে তিনি প্রার্থী হয়ে গেলেন। তাঁর প্রার্থী হওয়ার বিষয়টা নিয়ে দলের নিচুতলায় জোর চর্চা চলছে।
গত লোকসভা ভোটে মুর্শিদাবাদ আসনে তৃণমূল পেয়েছিল ৬ লক্ষ ৪ হাজারের মতো ভোট। কংগ্রেস প্রায় ৩ লক্ষ ৭৮ হাজার, বিজেপি প্রায় ২লক্ষ ৪৮ হাজার এবং সিপিএম প্রায় ১লক্ষ ৮০ হাজার ভোট পেয়েছিল। অর্থাৎ সিপিএম চতুর্থ। তা সত্ত্বেও সেলিম সাহেব এমন একটা আসনে প্রার্থী হতে গেলেন কেন? অনেকেই বলছেন, রীতিমতো অঙ্ক কষে তিনি এই আসনে প্রার্থী হয়েছেন। কী সেই অঙ্ক?
মুর্শিদাবাদ আসনে কংগ্রেস আর সিপিএমের উনিশের ভোট যোগ করলে সংখ্যাটা সাড়ে পাঁচ লক্ষ টপকে যাচ্ছে। এভাবে জয়ী প্রার্থীর কাছাকাছি পৌঁছে যাওয়ার আসন বাংলায় আর নেই। সেলিম সাহেবের অঙ্কটা এটাই। দলের না হোক, তাঁর ঘুরে দাঁড়ানোর এটাই সুবর্ণ সুযোগ। তবে, অধীরবাবু না চাইলে এই সমঝোতা কিছুতেই হতো না। মুর্শিদাবাদ সিপিএমকে ছেড়ে দেওয়াটা ‘উদারতা’ নয়, অধীরবাবুর অঙ্ক।
অতীতে অধীর চৌধুরী কংগ্রেস হাইকমান্ডের নির্দেশ সত্ত্বেও জোট মানেননি। গোঁজ প্রার্থী দাঁড় করিয়ে জিতিয়ে এনেছেন। সেই অধীরবাবু বিনা বাক্যব্যয়ে গতবার চতুর্থস্থানে থাকা সিপিএমকে আসনটি ছেড়ে দিলেন কেন?
অধীর চৌধুরী বহরমপুর কেন্দ্রের পাঁচবারের সাংসদ। কিন্তু একুশের ভোটে তাঁর কেন্দ্রের একটি বিধানসভাতেও কংগ্রেস জেতেনি। এমনকী, একদা তাঁর খাসতালুক বলে পরিচিত বহরমপুরেও নয়। বিজেপি ক্রমশ শক্তিশালী হচ্ছে। এই অবস্থায় মুসলিম ভোট টানতে না পারলে তাঁর লড়াইয়ে টিকে থাকাই কঠিন। তাই কোলাকুলিটা একেবারে সেয়ানে সেয়ানে। 
তবে, কংগ্রেসের সঙ্গে সমঝোতা হলেও স্বস্তিতে নেই সেলিম সাহেব। কারণ যাঁদের সামনে রেখে তিনি ‘কাঁটা’ তোলার প্ল্যান করেছিলেন সেই আইএসএফই এখন তাঁর পথে কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। দফায় দফায় অনুরোধ সত্ত্বেও মুর্শিদাবাদ থেকে প্রার্থী প্রত্যাহার করেনি আইএসএফ। তাতে সিপিএমের আম ও ছালা দুই-ই যাওয়ার অবস্থা। এরপর আর তৃণমূলের সংখ্যালঘু ভোটব্যাঙ্ক ভাঙার জন্য আইএসএফের হাত সিপিএম ধরতে নিশ্চয়ই যাবে না। তবে এব্যাপারে ‘গ্যারান্টি’ দেওয়া মুশকিল। কারণ যে অধীর চৌধুরীকে জোড়া খুনে অভিযুক্ত করে জেলে ভরেছিল, বাঁচার জন্য এখন তাঁরই হাত ধরছে সিপিএম। এই জন্যই বলে, রাজনীতি হল সম্ভাবনার শিল্প। 
সেলিম সাহেব ভালো বক্তা, দক্ষ রাজনীতিবিদ এবং প্রার্থী হিসেবেও বেশ ওজনদার। রাজ্যের ৪২টি আসনের মধ্যে বামেদের জন্য মুর্শিদাবাদ সবচেয়ে ‘ভালো আসন’। বেছে বেছে সেই আসনেই প্রার্থী হয়েছেন তিনি। কংগ্রেস আর সিপিএমের মধ্যে সমঝোতা হয়েছে ঠিকই। তবে তাতে উভয় দলের ভোট এক জায়গায় যাবে, এমন ভাবার কোনও কারণ নেই। বিশেষ করে মুর্শিদাবাদ জেলায়। এই জেলার অলিতে গলিতে রয়েছে কংগ্রেস এবং সিপিএমের সংঘর্ষের রক্তাক্ত ইতিহাস। দুই দলের লড়াইয়ে বহু মা সন্তানহারা হয়েছেন, অনেকের জীবনে নেমে এসেছে অকাল বৈধব্য। সেই সব কর্মী সমর্থক শীর্ষ নেতৃত্বের স্বার্থে হওয়া বোঝাপড়াকে কি এতটা গুরুত্ব দেবেন? সব দ্বন্দ্ব, ক্ষতি ভুলে ‘শত্রু’ দলের প্রতীকে বোতাম টিপবেন? এই সব প্রশ্নের উত্তর যদি ‘হ্যাঁ’ হয় তবেই মুর্শিদাবাদ কেন্দ্রের লড়াই হবে টানটান।
ব্যক্তিগত রেকর্ড অপেক্ষা দলকে জেতানোই ক্রিকেট টিমের আদর্শ ক্যাপ্টেনের লক্ষ্য হয়ে থাকে। তিনিই প্রকৃত ক্যাপ্টেন যিনি সেঞ্চুরির দোরগোড়ায় দাঁড়িয়েও টিমকে জেতানোর জন্য ইনিংস ডিক্লেয়ার করতে পারেন। সেলিম সাহেবের সামনে সেই সুযোগটা ছিল। কারণ রামে যাওয়া ভোট বামে ফেরাতে পারলেই হাল ফিরত লালের। হাল ফেরানোর মূল দায়িত্ব তাঁরই। কিন্তু তিনিই হয়ে গেলেন প্রার্থী। নজরটা ব্যক্তিগত রেকর্ডেই থেকে গেল।
অনেকেই বলছেন, সেলিম সাহেব জিতলে শূন্যের গেরো থেকে সিপিএম মুক্তি পাবে, তিনি ফের সাংসদও হবেন। কিন্তু রামের ভোট বামে ফেরাতে না পারলে? দলকে গ্রাস করবে এক অসীম শূন্যতা। যার দায় সেলিম সাহেব কিছুতেই এড়াতে পারবেন না।

13th     April,   2024
 
 
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ