বিশেষ নিবন্ধ

ইতিহাসমেধ যজ্ঞের শেষ পরিণতি কী?
মৃণালকান্তি দাস

সদ্য ক্ষমতায় বসা নরেন্দ্র মোদি সরকারের মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রী তখন স্মৃতি ইরানি। ২০১৪-র অক্টোবর মাস। দিল্লির মধ্যপ্রদেশ ভবনে মন্ত্রীকে ডেকে এনে প্রায় সাত ঘণ্টা বৈঠক করেছিলেন আরএসএস নেতারা। বৈঠকে সুরেশ সোনি, দত্তাত্রেয় হোসাবোলে ছাড়াও শিক্ষাক্ষেত্রের সঙ্গে যুক্ত সঙ্ঘের বিভিন্ন শাখার নেতারাও উপস্থিত ছিলেন। সঙ্ঘ নেতারা সেদিন সাফ জানিয়ে দিয়েছিলেন, শিক্ষাক্ষেত্রে দ্রুত আমূল সংস্কার চাই। অটলবিহারী বাজপেয়ি প্রধানমন্ত্রী থাকার সময় তাঁর মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রী মুরলীমনোহর যোশি যেভাবে শিক্ষায় গৈরিকীকরণ করতে চেয়েছিলেন, মোদি জমানায় সেই পথেই হাঁটতে পরামর্শ দিয়েছিলেন আরএসএস নেতারা। উদ্দেশ্য— প্রচলিত ‘সেকুলার’ শিক্ষাব্যবস্থার ‘ভারতীয়করণ’। শিক্ষার গৈরিকীকরণের মূল দায়িত্ব দেওয়া হয় সঙ্ঘ পরিচালিত ‘শিক্ষা সংস্কৃতি উত্থান— ন্যাস’-এর প্রেসিডেন্ট দীননাথ বাত্রার উপর। তাঁর হাতেই তুলে দেওয়া হয় ইতিহাস বিকৃত করার, হাতে-কলমে ইতিহাস ধ্বংস করার প্রকল্প। 
দীননাথ বাত্রা সরাসরি রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের সঙ্গে যুক্ত। ‘শিক্ষা বাঁচাও আন্দোলন’ নামে একটি এনজিও তৈরির মাধ্যমে দেশে শিক্ষার হাল পাল্টানোর আন্দোলনে যুক্ত। ২০১৭ সালে সেই দীননাথ বাত্রা এনসিইআরটিকে চিঠি দিয়ে ব্যাখ্যা করেছিলেন, কেন পাঠ্যক্রম থেকে রবীন্দ্রভাবনা বাদ যাওয়া উচিত। তাঁর মতে, জাতীয়তাবাদী মনোভাবের সঙ্গে খাপ খায় না রবীন্দ্রচেতনা। তাই রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কিত অংশ ইংরেজি পাঠ্যপুস্তক থেকে বাদ দেওয়ার দাবি তুলেছিল ন্যাস। রবীন্দ্রনাথ ছাড়াও দীননাথের কোপে পড়েছিলেন মির্জা গালিব, চিত্রকর এম এফ হুসেন থেকে কবি রামধারী সিং দিনকর। আর পড়ুয়ারা যাতে বিশুদ্ধ হিন্দি শেখে সে জন্য পাঠ্যপুস্তক থেকে সমস্ত উর্দু, ইংরেজি বা আরবি শব্দ বাদ দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন দীননাথ। বাদের তালিকায় পড়েছিলেন ‘সারে জঁহা সে আচ্ছা’ গানের স্রষ্টা উর্দু ভাষার কবি ইকবাল, ডারউইনের বিবর্তনবাদের অধ্যায়। সেই তালিকায় কোথাও নারী আন্দোলনের ইতিহাস। কোথাও বা ভারতের সামাজিক বৈষম্য। গত পাঁচ বছর ধরে সর্বত্রই এ নিয়ে চলেছে বিতর্ক।
আসলে রাষ্ট্রযন্ত্র যাঁদের হাতে, ইতিহাসের পাঠ্যসূচিতে তাঁদের রাজনৈতিক মতামত ও অভিসন্ধির প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রভাব পড়ে। এই অভিজ্ঞতা এ দেশেও নতুন নয়। স্কুলপাঠ্য ইতিহাস সংশোধন প্রকল্পটি এই অভিযানের নতুন পর্ব। এমন প্রকল্প অবশ্যম্ভাবী ছিল, কারণ ভাবী নাগরিকদের মস্তিষ্কগুলিকে দখলে আনতে পারলে সামাজিক চিন্তায় ও চেতনায় হিন্দু রাষ্ট্রের ভিত আরও অনেক বেশি জোরদার হয়ে উঠতে পারে। ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় আসার পর এক নতুন ভারতের সূচনা হয়েছে, যেখানে মোদি-শাহকে প্রকাশ্যে বলতে শোনা গিয়েছে ৭৫ বছরের ভারতের ধারণাকে তাঁরা বদলে দিতে চান। বদলের অন্যতম হাতিয়ার পাঠ্যবই। ইতিহাস ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে চাঁদমারি করেই তাই অমিত শাহের আস্ফালন। তিনি তো জোর গলায় বলেছিলেন, এখন আমাদের কে আটকাবে? শিক্ষায় শাসকের এই শক্তি প্রদর্শনের ফলটা ঠিক কী? শেষপর্যন্ত পড়ুয়াদের কাছে বিচ্ছিন্ন বা খণ্ডিত ইতিহাস তুলে ধরা। যে পাঠ্যসূচি যত্ন করে গঠনমূলক পদ্ধতিতে সাজানো হয়েছিল, সেখান থেকে আস্ত একটা পর্ব বাদ দেওয়া মানে ইতিহাস বা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ভিতকে নড়বড়ে করে দেওয়া। জীবনের সর্ব ক্ষেত্রে হিন্দুত্ববাদী মাতব্বরি চালাতে চাওয়া গেরুয়া শিবির শিক্ষাকে গৈরিক করতে চেয়েছে শুরু থেকেই। বিজ্ঞান তথ্য ও তত্ত্বসাপেক্ষ, যুক্তি ও প্রমাণনির্ভর, তাতে কী! প্রাচীন শাস্ত্র বা পুরাণের আশ্চর্য বস্তু ও ঘটনা সামনে এনে প্রাণপণ প্রমাণের চেষ্টা চলেছে, তা বৈজ্ঞানিক। প্রাচীন হিন্দু ভারতে আগে থেকেই ছিল। উগ্র জাতীয়তাবাদী আবহে ভূগোলে অখণ্ড ভারতকে দেখিয়ে তা পুনরাধিকারের স্বপ্নও জাগিয়ে তোলা হয়েছে। ইতিহাসেরও করুণ দশা! শেখানো হচ্ছে মুঘল তথা ইসলামি শাসন মানেই অন্ধকার যুগ। হলদিঘাটের যুদ্ধে আসলে হিন্দু রাজপুত রানাপ্রতাপই জিতেছিলেন।
ইতিহাস এখন বাত্রা-গোত্রীয় ব্যক্তিদের কাছে এমনই একটি বিষয়, যাতে গবেষণা কিংবা অধিকার কষ্ট করে অর্জন করার আর দরকার নেই। ইতিহাস তাঁদের কাছে চর্চাযোগ্য বিদ্যা নয়, রাজনীতির উপাদান-মাত্র। বাত্রা তাই বলেছিলেন, গৈরিকীকরণের অভিযোগে তিনি বিন্দুমাত্র আহত নন। বরং গর্বিত। গোটা দেশ গৈরিকীকৃত হলে তবেই-না দেশের ভাবমূর্তি খুলবে! সেই বাত্রা-রচিত বইগুলি একটি রাজ্যে (গুজরাতে) বিদ্যালয় স্তরে চালু হয়ে গিয়েছে কবেই। রাজ্য সরকার সেগুলি অনুমোদন দিয়েছে। এমনকী বইগুলির সূচনা-পৃষ্ঠা অলঙ্কৃত করেছে খোদ প্রধানমন্ত্রী মোদির স্বাক্ষর। বইয়ের ভিতরের পৃষ্ঠায় কী কী আছে? আছে প্রাচীন ভারতের ‘ইতিহাসে’ দেবতাদের আবির্ভাব ও দেব-দানবের যুদ্ধের কথা। কিংবা প্রাচীন রাজাদের মহাড়ম্বর গো-সেবা ও গো-আরাধনা প্রথার বিস্তারিত প্রশংসা। রামায়ণের ঐতিহাসিকতা প্রমাণের চেষ্টা ইত্যাদি। ভারতীয়ত্ব যেকোনও মতেই একটি মিশ্র সংস্কৃতি নয়, বরং দেব-নন্দিত ধর্ম-সিঞ্চিত একটি অটল ও অচল সভ্যতা। এই মৌলিক তথ্যটি ছাত্রছাত্রীদের মাথায় ঢুকিয়ে দেওয়ার বন্দোবস্ত। এ কথা ঠিক, গভীরতর সমস্যা লুকিয়ে আছে আমাদের শিক্ষার, বিশেষত ইতিহাস-শিক্ষার ভুবনে। ইতিহাসকে আমরা পাঠ্যবইয়ের খোপেই পুরে রেখেছি, দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে তার সংযোগ হারিয়ে গিয়েছে। তার ফলে ইতিহাসের বিকৃতি আমাদের মনে আজ আর কোনও অভিঘাত সৃষ্টি করে না। সিনেমার পর্দায় ঐতিহাসিক কাহিনি বা চরিত্রের উপস্থাপন নিয়ে থেকে থেকেই অন্তঃসারশূন্য শোরগোল ওঠে বটে, একইসঙ্গে সমাজমাধ্যমে রকমারি বিকৃত ইতিহাস প্রচারের পিছনেও থাকে হিন্দুত্ববাদীদের অভিসন্ধি। অথবা নিখাদ অজ্ঞতার সবজান্তা আস্ফালন। ইতিহাস-বিচ্ছিন্ন সমাজে সেই সব আবর্জনার স্তূপই জ্ঞানভাণ্ডার হিসেবে স্বীকৃত হয়।
২৪ নভেম্বর ২০২২। দেশবাদী ভুলে যায়নি দিল্লির বিজ্ঞান ভবন থেকে অমিত শাহের নতুন ইতিহাস লেখার নিদান। যে ইতিহাসে লেখা হবে রামমন্দিরের কথা। ইতিহাসে থাকবে শুধুই হিন্দু রাজাদের সাহসের ইতিহাস। তাই বাদ পড়ার তালিকায় প্রথমেই মুঘলরা। এনসিইআরটি-র দ্বাদশ শ্রেণির ইতিহাসের পাঠ্যবই থেকে ‘কিংস অ্যান্ড ক্রনিকলস: দ্য মুঘল কোর্টস’ শীর্ষক ৩১ পৃষ্ঠার একটি অধ্যায় বাদ, ছাঁটা হয়েছে অন্য একাধিক অধ্যায়ের পাঠও। এর মূল সুর অবশ্য আগেই বাঁধা হয়ে গিয়েছিল। সেই ২০০৫ সালে। অর্থাৎ আর্য সভ্যতা, বৈদিক যুগ থেকে রাজপুত পেরিয়ে মাঝের দীর্ঘ মুঘল যুগ সম্পর্কে জানা থেকে বঞ্চিত হবেন পড়ুয়ারা। গোটা মুঘল যুগ বাদ দেওয়া মানে মধ্যযুগের একটা বড় পর্ব ইতিহাস থেকে বাদ দেওয়া। যা আসলে ইতিহাসের উপর বিরাট এক কোপ। হিন্দু রাজাদের ইতিহাস পড়ুয়ারা পড়বে, কিন্তু মুঘল শাসকদের সম্পর্কে পড়বে না। কারণ পাঠক্রমের বর্তমান নিয়ন্তাদের মতে, মুঘল মানেই মুসলিম। আর মুসলিম মানেই নিষিদ্ধ। এ দেশে একাংশের ধর্মের নেশা দেখে একসময় মির্জা গালিবও লিখে গিয়েছিলেন, বেহুঁশ ধর্মপ্রচারীদের খুদা কীভাবে হুঁশে ফেরান: ‘হোশ তব আয়া যব উসনে কহা কে খুদা কিসি এক কা নহি হোতা’। হিন্দুত্বের বেহুঁশ প্রচারকদের অবশ্য এই সার সত্য বোঝানোর কেউ নেই। মোদি সরকারের প্রথম চার বছরে ১৮২টি পাঠ্যবইয়ে ১৩৩৪টি ‘পরিবর্তন’ হয়েছিল। আর গত পাঁচ বছরে স্কুলশিক্ষা সংস্কার সবকিছু ছাপিয়ে গিয়েছে। বার্তা পরিষ্কার, শিক্ষা ধর্মনিরপেক্ষ নয়, হিন্দুত্ববাদী হবে।
ইরফান হাবিব, শিরিন মুসভি, বরুণ দে, সতীশ চন্দ্র, নুরুল হাসান প্রমুখ ঐতিহাসিক প্রমাণ করেছেন যে ভারতের ইতিহাসে মধ্যযুগ আদৌ অন্ধকারময় ছিল না। সেখানে জ্ঞান-বিজ্ঞান-প্রযুক্তি, স্থাপত্য-শিল্পকলা, শাসনপদ্ধতি— অনেক ক্ষেত্রেই গৌরবোজ্জ্বল অগ্রগতি ঘটেছিল। এই তত্ত্ব মেনে নিলে আজকের শাসকের বড়ই অসুবিধে। মুঘল শাসকরা তাঁদের শাসনে যোগ্য ব্যক্তিদের উপযুক্ত মর্যাদা দিয়েছিলেন। ব্যক্তির ধর্মীয় পরিচয় কখনও বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। আকবরের আমলে রাজস্বব্যবস্থা তথা অর্থনীতির ভারপ্রাপ্ত টোডরমল ছিলেন হিন্দু। তাঁকেই আকবর করেছিলেন মুন্সিফ-ই-দেওয়ান বা সাম্রাজ্যের অর্থমন্ত্রী। একইসঙ্গে তিনি ছিলেন ভকিল-আস-সুলতানাত বা সম্রাটের মন্ত্রণাদাতা। কতটা বিশ্বাসযোগ্যতা থাকলে কাউকে প্রশাসনে এতটা গুরুত্ব দেওয়া যায় তা একবার ভেবে দেখুন। এই ইতিহাস ছাত্রছাত্রীরা শিখলে তো তাদের একথা বোঝানো যাবে না, মুসলিম মুঘল শাসকদের হিন্দুদের প্রতি বিদ্বেষ ছিল। যে হলদিঘাটের যুদ্ধে আকবর রানাপ্রতাপকে পরাজিত করেছিলেন সেই যুদ্ধে আকবরের প্রধান সেনাপতি ছিলেন অম্বরের রাজা মানসিংহ। আর রানাপ্রতাপের সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন শের শাহের বংশধর হাকিম খান সুরি। 
একথা ছাত্রছাত্রীরা জানলে তো আর আজকের শাসকদল বলতে পারবে না, মুঘল যুগ মানেই হিন্দু-মুসলিম দ্বন্দ্বের ইতিহাস। তাদের তো লক্ষ্য একটাই, মধ্যযুগকে অগ্রাহ্য করতে হবে, বিকৃত করতে হবে, সবকিছুর উপর হিন্দু আধিপত্য স্থাপন করতে হবে। কিন্তু এঁদের কে বোঝাবে, শিক্ষার বিপর্যয় একদিনে ধরা পড়ে না, কিন্তু গভীরে অগোচরে সমাজের বাস্তুতন্ত্র ধ্বংস করে।
ত্রিশের দশকের জার্মানি থেকে আজকের ভারত— জাতীয়তাবাদ কাদের শেষ আশ্রয় হয়, ইতিহাস তা বারবার দেখিয়েছে। সেই আশ্রয় শেষ পর্যন্ত পতন ডেকে আনে, তাও ইতিহাসেরই শিক্ষা। শাসকদল সেই শিক্ষা নিতে না পারলে ইতিহাস তাকে অভিশাপ দেয়— ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটানোর অভিশাপ!
3Months ago
কলকাতা
রাজ্য
দেশ
বিদেশ
খেলা
বিনোদন
ব্ল্যাকবোর্ড
শরীর ও স্বাস্থ্য
সিনেমা
প্রচ্ছদ নিবন্ধ
আজকের দিনে
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
mesh

পারিবারিক অশান্তির অবসানে গৃহ সুখ ও শান্তি বাড়বে। প্রেমের ক্ষেত্রে শুভ। কর্মে উন্নতি। উপার্জন বৃদ্ধি।...

বিশদ...

এখনকার দর
ক্রয়মূল্যবিক্রয়মূল্য
ডলার৮৩.২৬ টাকা৮৪.৩৫ টাকা
পাউন্ড১০৬.৪৬ টাকা১০৯.১২ টাকা
ইউরো৮৯.৭৬ টাকা৯২.২০ টাকা
[ স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া থেকে পাওয়া দর ]
*১০ লক্ষ টাকা কম লেনদেনের ক্ষেত্রে
দিন পঞ্জিকা