বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
বিশেষ নিবন্ধ
 

ইতিহাসের তর্ক বিতর্ক: সর্বনাশ কিন্তু বাঙালিরই
সমৃদ্ধ দত্ত

আমরা সবথেকে কী পেতে ভালোবাসি? ধনসম্পত্তি, প্রশংসা এবং সমর্থন। ধনসম্পত্তি, অর্থাৎ টাকাপয়সা সম্পদ পেলে আনন্দ হয়। প্রশংসা শুনলে মন খুশিতে ভরে ওঠে। আর আমাদের কথার সমর্থন পেতে পছন্দ করি আমরা। সাধারণ মানুষ অথবা ক্ষমতার শীর্ষস্তরে থাকা ব্যক্তিত্ব সকলেরই এই একইরকম মনের সুর। আমাদের কথার ভিত্তিতে কেউ যখন বলে, হ্যাঁ, এটা তুমি ঠিক বলেছ, তখন সেটা শুনতে ভালো লাগে।  কিন্তু আমাদের মতের বিরুদ্ধতা আমরা তৎক্ষণাৎ পছন্দ করি না। তাই ক্রমেই তর্কবিতর্ক বৃদ্ধি পায় এবং সিংহভাগ ক্ষেত্রেই সেটি পর্যবসিত হয় গোপন তিক্ততায়। 
আর আমরা কী দিতে ভালোবাসি? মতামত, পরামর্শ এবং উপদেশ। আমাদের মনে এক গোপন উদ্দীপনার জন্ম হয়, যখন কেউ আমাদের কাছে জানতে চায়, এ বিষয়ে তোমার কী মত? অথবা একটা সমস্যায় পড়েছি, তোমার পরামর্শ চাই। এবং সর্বোপরি যে কোনও পরিস্থিতিতেই উপদেশ প্রদান করলে এক আত্মসন্তোষ হয়। এই প্রবণতা নতুন নয়। তবে সমাজে পরিচিত বৃত্তের বাইরে এটি তেমন প্রকট ছিল না। এখন সোশ্যাল মিডিয়ার কারণে এই প্রবণতা প্রকাশ্যে এসেছে। তাই দেখা যায়, যে কোনও ইস্যু সমাজে উত্থাপিত হলেই, আমরা আর নীরবে থেকে অপেক্ষা করি না যে, আমাকে প্রশ্ন না করা হলে, অথবা কেউ জানতে না চাইলে, আমি মতামত দেব না। আমরা এখন আর তোয়াক্কা করি না যে, কে কী জানতে চাইল অথবা চাইল না। নিজেরাই ঝাঁপিয়ে পড়ে নিজের মতামত উপযাচক হয়ে বলে দিই। কেন? কারণ, এক সময় বাঙালি মেধা নিজেকে আড়ালে রাখতে স্বচ্ছন্দ ছিল। এখন প্রকাশের যুগ। যে যত বেশি কথা বলবে, সে তত বেশি সামাজিক এবং স্মার্ট। 
আর এই প্রতিটি ক্ষেত্রে আমাদের সবথেকে বড় ভুল হল, আমরা ধরেই নিই আমরা যা ভাবছি এবং যা বলছি এটা সঠিক। ‘আমি ঠিক’ এটা নিশ্চিত জেনেই সব তর্কে প্রবেশ করি। ‘আমি ভুল’ এটা প্রমাণ হলেও দ্রুত মেনে নিতে পারি না। তখন অন্য যুক্তি দিয়ে নিজের ঠিক হওয়া প্রতিষ্ঠা করার জন্য মরিয়া চেষ্টা করি। যে কোনও ইস্যুতে ‘আমি ঠিক’ অর্থাৎ আমি যে মতামত দিচ্ছি সেটাই ঠিক, এটা কে ঠিক করে দিল? আমরা আর নিজেদের মতামতকে অর্থাৎ নিজেকেই ক্রস চেক করি না। আমরা জানি যে, আমরা ঠিক!
এই মনস্তাত্ত্বিক সর্বজনবিদিত বৈশিষ্ট্যগুলি আরও একবার মনে করার কারণ হল, লোকসভা ভোট এসেছে। আমাদের রাজ্যে ভোট এলেই অসংখ্য নতুন নতুন থিওরি, ফর্মুলা, বিশ্লেষণ কিংবা মনোভাব জানতে পারা যায়। সম্প্রতি দেখা গিয়েছে, আমাদের রাজনৈতিক চর্চায় প্রবলভাবে ইতিহাস প্রবেশ করেছে। এ ব্যাপারে বর্তমান কেন্দ্র সরকারে পরিচালক এবং শাসকদলের অবদান সবথেকে বেশি। তাদের প্রধান নেতার অনুকরণ করে বাকিরাও একটি তত্ত্ব স্থাপনের প্রাণপণ চেষ্টা করেন যে, তাঁদের পূর্বসূরিরা ভুল। তাই ভারতের সর্বনাশ হয়েছে। তাঁরা এসে সেই ভুলগুলো ঠিক করছেন। মানুষের সাধারণ স্নায়ুধর্ম অনুযায়ী তাঁরাও যথারীতি সবথেকে বেশি পছন্দ করেন টাকাপয়সা পেতে (ইলেক্টোরাল বন্ড ইত্যাদি), প্রশংসা পেতে এবং সমর্থন পেতে। প্রশংসা অর্থাৎ সারাক্ষণ বলতে হবে এটা অমৃতকাল। সমর্থন, অর্থাৎ তাঁদের সব সিদ্ধান্তই  ঠিক এটা মেনে নেওয়া। আর তাঁরা সবথেকে বেশি যা দিতে পছন্দ করেন তাও ওই আবহমানের ধর্ম। মতামত, উপদেশ এবং পরামর্শ। 
তাই আমরা তাঁদের উপদেশ পেয়েছিলাম ব্যালকনিতে থালা বাজানো, ঘরের আলো রাত ৯টায় নিভিয়ে দিয়ে প্রদীপ নিয়ে বারান্দায় দাঁড়ানো এবং পুরনো নোটের মায়া কাটিয়ে নতুন নোট নেওয়ার জন্য পাঁচ সাত ঘণ্টা নোটবদলের লাইনে দাঁড়ানোর।
২০২৪ সালের লোকসভা ভোটে সিরাজউদ্দৌলা বনাম ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মধ্যে একটিকে বেছে নেওয়ার একটি তাড়না নিয়ে প্রবল চর্চা শুরু হয়েছে। ভরকেন্দ্র কৃষ্ণনগর রাজপরিবারের এক লোকসভার প্রার্থী। প্রশ্ন উঠছে, মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র যেহেতু সিরাজের বিরুদ্ধপক্ষীয়দের দলেই যোগ দিয়েছিলেন এবং সেক্ষেত্রে পরোক্ষে মিরজাফর তথা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পক্ষাবলম্বী হিসেবেই বিবেচনা করা হয় তাঁকে। সুতরাং এক্ষেত্রে তাঁর সেই অবস্থান অন্যতম বিতর্কের কেন্দ্রে এসেছে। অর্থাৎ লোকসভার বিজেপি প্রার্থীকে ভোট দেওয়ার সপক্ষে কৃষ্ণচন্দ্রের বংশপরম্পরার জয়গান গাওয়া আদৌ কতটা গ্রহণযোগ্য? এই প্রশ্ন নিয়েই তর্ক বিতর্ক! 
আবার রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের পক্ষাবলম্বন করে ১৭৫৭ সালের জুন মাসের যে যুদ্ধ পরবর্তী ২০০ বছরের ব্রিটিশ শাসনের বীজ বপন করেছিল, সেটাকে সমর্থন করার কারণ হিসেবে অনেকে বলছেন, সিরাজ অত্যন্ত অযোগ্য এবং অপদার্থ শাসক ছিলেন। অত্যাচারী এবং দুর্বিনীত। তাই তাঁর হাতে বাংলার মসনদ থেকে গেলে অর্থাৎ ব্রিটিশ না এলে সর্বনাশ হয়ে যেত! তাছাড়া পরবর্তীকালে প্রমাণ হয়েছে ব্রিটিশরা প্রচুর উপকার করেছে ভারতের ও বাঙালির। আবার অন্য পক্ষের যুক্তি,  ব্রিটিশদের হাতে ভারতকে তুলে দেওয়া তো ২০০ বছরের পরাধীনতায় ভারতকে ঠেলে দেওয়া!  
ইতিহাসের কোনও একটি ব্যাখ্যা হয় না। বিশ্লেষণও তাই। আবেগ এবং পক্ষপাত সরিয়ে রেখে বিচার করলে ইতিহাসের গতিপ্রকৃতি অনুধাবন করা সহজ হয়। সিরাজ যে অতি দুর্বিনীত এবং অত্যাচারী ছিলেন, কোনও সন্দেহ নেই। তাঁর নিজের আত্মীয় মুঘল আমলের সবথেকে কৃতবিদ্য ইতিহাসকার গুলাম হোসেন খানই হোক অথবা সমকালীন এক ফরাসি সামরিক প্রধান জঁ লঁ, দুজনেই নিজেদের গ্রন্থে সিরাজের উদ্ধত চরিত্র সম্পর্কে লিখে গিয়েছেন। এই প্রসঙ্গ টেনে এনেই তাঁকে সরিয়ে ব্রিটিশ রাজ স্থাপনের পক্ষে মতামত প্রকাশ করার একটি প্রবণতাও দেখা যাচ্ছে এখন আলোচনায়। 
ঠিক এখানেই ভুল হবে যদি এরকম সরলীকরণের ইতিহাসকে দেখা হয়। কারণ, সিরাজকে সরিয়ে যাদের আনা হয়েছিল, সেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলাকে লুট করেছে প্রথম দিন থেকেই।  ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ক্ষমতাসীন হওয়ার পর একের পর এক দুর্ভিক্ষ শুরু হয় বাংলায়। ১৭৭০ সালের দুর্ভিক্ষকে ছিয়াত্তরের মন্বন্তর বলা হয়। ১৮৬৬ সালের দুর্ভিক্ষ কোনও অংশের কম নয়। এবং ১৯৪৩! তিনটি দুর্ভিক্ষই সম্পূর্ণ প্রশাসনিক গাফিলতি এবং উপেক্ষার কারণে। 
লক্ষ লক্ষ বাঙালির মৃত্যু হয়েছে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এবং পরে ব্রিটিশ শাসনকালে। সিরাজের ঠাকুরদা আলিবর্দী খানের আমলে বাংলা কেমন ছিল? মুর্শিদাবাদের একটি গঞ্জের বাজারেই বছরে সাড়ে ৬ লক্ষ টন চালের পসরা হতো। চিনি, আফিম এবং নীলের রপ্তানি শিখরে ছিল। ১৩ লক্ষ তাঁতি ছিল বস্ত্র নির্মাণক্ষেত্রে। ১৭৫৩ সালে বাংলায় তাল তাল সোনা এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যেত প্রায় বিনা প্রহরায়। এহেন মুর্শিদাবাদে মাত্র অনাবৃষ্টি আর খরার জেরে হাজার হাজার মানুষের অনাহারে মৃত্যু হয় কীভাবে মাত্র ১৭ বছরের মধ্যে? হয়। কারণ, ঠিক যে বছরে দুর্ভিক্ষ চলছে, সেই সময় দু বছরে  ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি রেকর্ড রাজস্ব পাঠিয়েছিল লন্ডনের অফিসে। ১৭৭১ সালে ১০ লক্ষ পাউন্ড পাঠানো হয় লন্ডনে কোম্পানির পক্ষ থেকে।
এবার তেতাল্লিশ! ১৯৪১ সালের হিসেবে দেখা যায়, বাংলায় ৪৮ কোটি মণ ধান এক বছরে উৎপাদিত হতো। যদি সকল বঙ্গবাসীকে ভাত জোগাতে হয় তাহলে দরকার ছিল ৫৪ কোটি মণ। বার্মা থেকে আমদানি করা হতো ঘাটতি মেটাতে কিছু। আবার রপ্তানিও করতে হতো। কমবেশি তাই ঘাটতি থাকতই। কিন্তু প্রথম থেকেই ব্রিটিশ সরকার কৃষির উন্নতি আর উৎপাদন বাড়ানোর কোনও প্ল্যানই নেয়নি। বাংলায় ১৯৪০ সালে ৭০ লক্ষ টাকা কৃষিতে বরাদ্দ করা হয়েছিল। ১৯৪৩ সালে সেটা হয়েছিল ৫১ লক্ষ টাকা। অথচ সিভিল ডিফেন্স দপ্তরের জন্য বরাদ্দ করা হয় ৪ কোটি টাকা। 
১৯৪১ সাল থেকে ১৯৪৩ সালের এপ্রিল পর্যন্ত পার্ল হারবারে জাপানি আগ্রাসনের পর জাপানের ভারত আক্রমণের জেরে পূর্ব ভারতে কতজনের মৃত্যু হয়েছিল? ৮১৬ জন। আর ১৯৪৩ সালের ১৬ আগস্ট থেকে ১৬ ডিসেম্বরের মধ্যে শুধু কলকাতার রাস্তায় অনাহারে কত বাঙালির মৃত্যু হয়? ৯৫০০!
মুসলিম শাসনের বহু অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছে বাঙালিকে। আবার মারাঠা বর্গীরা এসে দফায় দফায় বাংলাকে শ্মশান করে দিয়েছে গণহত্যা আর লুণ্ঠন করে। তারা হিন্দু ছিল! আধুনিক শিক্ষা, আধুনিক সভ্যতা এবং আধুনিক বিজ্ঞান তথা নবজাগরণের অন্যতম সহায়ক হয়েছিল ব্রিটিশদের শিক্ষা ও শাসনব্যবস্থা। আবার সেই ব্রিটিশের উপেক্ষা এবং অত্যাচারী ভূমিকায় দুর্ভিক্ষ কিংবা চিকিৎসাহীনতায় লক্ষ লক্ষ বাঙালির মৃত্যু হয়েছে। সিরাজ অত্যাচারী ছিল। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আরও বড় লুটেরায় পরিণত হয়। 
১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট ভারত আনন্দে মেতে উঠেছিল। অথচ ঠিক সেই সময় বাঙালির নামে নতুন বিশেষণ সৃষ্টি হয়েছে—উদ্বাস্তু! সুতরাং, ক্ষমতায় যেই থাকুক! সর্বনাশ হয়েছে বাঙালিরই! যুগে যুগে! 

5th     April,   2024
 
 
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ