মার্চ পেরিয়ে এপ্রিল এলেই কী কী কথা মনে পড়বে? এসি সার্ভিসিং করা দরকার। কিংবা এবার একটা এসি কিনতে হবেই। পয়লা বৈশাখের শপিং সেরে নিতে হবে। রোদ্দুর একটু কমলে চৈত্র সেল মার্কেটে যেতে হয়। এবার বেশি বেশি জল কিংবা ফলের রস খেতে হবে। অপেক্ষা করতে হবে কবে প্রথম হিমসাগর আসবে বাজারে। নতুন সানগ্লাস কিনতে হয়। এবার জলছাদ করে নিলে ভালো হয়। এই হল স্বাভাবিক নিয়ম।
কিন্তু মহারাষ্ট্রের লাটুর অথবা পালঘর, মধ্যপ্রদেশের টিকমগড়, পান্না অথবা ঝাড়খণ্ডের খুন্তি ইত্যাদি এলাকায় এই মার্চ ও এপ্রিল হল জারিকেন এবং কলসি কেনার সিজন। এই সময় সস্তায় পাওয়া যায়। কারণ অনেক বেশি, ডিমান্ড। তাই উৎপাদন ও বিক্রি হয় বেশি বেশি। সুতরাং ভারতের এইসব প্রান্তের চৈত্র সেল হল জারিকেন, কলসি। জল আনার এবং স্টোর করে রাখার জন্য। পালঘরের একের পর এক গ্রামে গেলে দেখা যাবে অটো চলছে জারিকেন ভর্তি করে। তারা যাত্রী তুলবে না। যাত্রী নিয়ে যাতায়াত করার তুলনায় জল নিয়ে যাতায়াত করায় মুনাফা বেশি। অটো কেন? কারণ গ্রামগুলি থেকে নিকটবর্তী জলের সোর্স ক্রমেই দূরে সরে যাচ্ছে। তাই গ্রামে গ্রামে জল বিক্রি করাই ক্রমবর্ধমান পেশা। কংগ্রেস এবং বিজেপি তো পরস্পরের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ। এমন কোনও ইস্যু থাকতে পারে না যা তাদের একজোট করতে পারবে। হ্যাঁ, জল পেরেছে। কয়েক বছর আগে পালঘরের সব রাজনৈতিক দল আর সংগঠন একসঙ্গে বন্ধ পালন করেছে। কেন? কারণ পালঘর জেলার গ্রামগঞ্জ, ব্লকের জন্য যে জল সাপ্লাই বরাদ্দ হয়েছিল, সেই জল পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে ভীরার, মীরা রোড, ভায়েন্দার, ভাসাইয়ে। জল প্রকল্পের নাম সূর্য ওয়াটার প্রজেক্ট। এই চারটি জনপদ নতুন মুম্বইয়ে পরিণত হয়েছে। এখানেই নতুন নতুন জনবসতি, আবাসন প্রকল্প এবং আধুনিক উন্নয়নের পরিকাঠামো তৈরি হয়ে চলেছে। যেখানে উচ্চবিত্ত এবং উচ্চমধ্যবিত্ত বেশি করে বাস করে, সেখানে আর্থিক লেনদেন, ব্যবসা আর বাণিজ্য বেড়ে যায়। শপিং মল হয়, বিদ্যুৎ ব্যবহার বেড়ে যায়, ভোগ্যপণ্য বিক্রি বাড়তে থাকে। রিয়াল এস্টেট আর কর্পোরেটের লাভ হয়। আর সরকারের মুনাফা হয় আরও বেশি বেশি জিএসটি আদায়ের রাস্তা খোলায়। তাই স্বাভাবিকভাবেই এই এলাকাগুলিকে জল পাওয়ার ক্ষেত্রে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছিল। আর তার জেরে কী হয়েছে? পালঘর জেলার গ্রামের পর গ্রামে জারিকেন আর কলসি বিক্রি বেড়ে চলেছে। এইসব গ্রামের ছেলেমেয়েদের অন্যতম প্রধান কাজ হল, জারিকেনে বাবা, মায়ের নাম লিখে দেওয়া। কুয়ো অথবা ডিপ টিউবওয়েল কিংবা ট্যাঙ্কারের সামনে যে লম্বা জলের লাইন পড়ে, সেখানে এইসব জারিকেন রেখে দেওয়া হয়। নাম লিখে।
মধ্যপ্রদেশের টিকমগড়ের গ্রামগঞ্জে ঘরবাড়ির সম্পদের জন্য কেউ সিকিউরিটি গার্ড রাখে না। অনেক সময়ই গ্রামের একমাত্র এটিএমেও দেখা যায় না কোনও সিকিউরিটি। কিন্তু বন্দুক হাতে সিকিউরিটি থাকে ট্যাঙ্কার এলে অথবা নদীবাঁধের সামনে। জল চুরি অথবা জল ডাকাতি ঠেকাতে।
নাসিকের ডান্ডিচি নামক এক জনপদ, কাশ্মীরের শ্রীনগরের ডাল লেকের কাছের একঝাঁক মহল্লা অথবা বুন্দেলখণ্ডের মধ্যে মিল কোথায়? ছেলেদের বিয়ে হচ্ছে না। কারণ জলের সঙ্কট। ডান্ডিচিতে বিয়ে হওয়া মানে হল মেয়ের সারাদিন কেটে যাবে জল আনতে। তাই কোনও পিতামাতাই ওই গ্রামে মেয়ের বিয়ে দেয় না। অতএব যুবকদের সামনে দুটি বিকল্প। হয় গ্রামে থাকো। কিংবা বিয়ে করো। বিয়ে করলে গ্রাম ছাড়তে হবে। অতএব দ্বিতীয় বিকল্পই গ্রহণযোগ্য। যুবকরা কৃষিতে আগ্রহী নয়। এমনিতেই জল নেই গ্রামে গ্রামে। অতএব চাষ হয়ও না বিশেষ। বর্ষার পর ছাড়া। আর চাষ কিংবা অন্য কাজে গ্রামে থাকলে বিয়ে হবে না। তাই ক্রমেই একের পর এক গ্রাম হয়ে যাচ্ছে পুরুষশূন্য। যে ডাল লেক ভারতের বিখ্যাত এবং বৃহৎ হ্রদগুলির অন্যতম, তার নিকটবর্তী মহল্লার যুবকদের বিয়ে হচ্ছে না? পরী নেটওয়ার্ক তাদের সাম্প্রতিক সমীক্ষায় এই বিস্ময়কর তথ্য দিয়েছে। অর্থাৎ ডাল লেকের সংলগ্ন এলাকাতেই জলের সঙ্কট চরমে। ১০ বছর আগেও বোটে করে কিছুটা গিয়ে জল আনা সম্ভব হতো। এখন সব জলের সোর্স শুকিয়ে গিয়েছে। অতএব ভরসা ট্যাঙ্কার অথবা প্যাকেজড ওয়াটার।
কেন্দ্রীয় সরকারের জল জীবন মিশন মিশনের লক্ষ্য কী? ২০২৪ সালের মধ্যে ১৪ কোটি পরিবারে পানীয় জল পাইপের মাধ্যমে পৌঁছে দেওয়া। আগে এই সময়সীমা ছিল ২০২২। পূরণ করা যায়নি। এখনও পর্যন্ত। কিন্তু ২০১৪ সালেও মার্চ ও এপ্রিল এলেই দেশের বিভিন্ন প্রান্তে জলের হাহাকার শুরু হয়। বিহারের আকবরপুরের বেশ কিছু গ্রামে পাইপ লাইনের সংযোগ হয়ে গিয়েছে। কিন্তু জলের জন্য এইসব পরিবারকে আজও প্রতিদিন গ্রামের বাইরে ৪ কিলোমিটার হেঁটে জল আনতে হয়। কেন? কারণ এই গ্রামগুলির দলিত পরিবারের। তাই তাদের ঘরে জলের পাইপ গিয়েছে। জল যায়নি।
ঠিক এই আবহে ভারতে দ্রুত হারে বিগত ২০ বছরে কোন বিজনেস এবং ইন্ডাস্ট্রি বেড়েছে? ওয়াটার ইন্ডাস্ট্রি। ২০২২ সালের তুলনায় ২০২৩ সালে, অর্থাৎ এক বছরে অবিশ্বাস্য ২৯ শতাংশ গ্রোথ কোন সেক্টরে? রিভার্স অসমোসিস সেক্টরে। এটা কী? আমরা যাকে RO বলি। উচ্চমধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত এবং অফিসে অফিসে যা লাগানো থাকে। ভারতে প্যাকেজড ওয়াটার ইন্ডাস্ট্রির আয়তন কত? ৪৬ হাজার কোটি টাকা। এয়ার ইন্ডিয়ার পর কোন সংস্থা ক্রয় করার জন্য বিগত ২ বছর ধরে ঝাঁপিয়েছে টাটা গ্রুপ? বিসলেরি কোম্পানি কেনার জন্য! ১৯৬৫ সালে মুম্বইয়ে প্রথম ইতালিয়ান ব্র্যান্ড বিসলেরি স্থাপিত হয়েছিল। ১৯৬৯ সালে সেই সংস্থা কিনে নেয় পার্লে গ্রুপের চৌহানরা। কত টাকায় ডিল হয়েছিল? ৪ লক্ষ টাকা। আজ ভারতের বিসলেরি কত টাকার সংস্থা? ৯৫০০ কোটি টাকার!
RO, ওয়াটার পিউরিফায়ার, প্যাকেজড ওয়াটার বাণিজ্য যতই বাড়ছে, ততই দেখা যাচ্ছে গ্রাম ছাড়িয়ে শহরে শহরেও বিনামূল্যে পাওয়া জলের হাহাকার বেড়ে চলেছে। সাম্প্রতিকতম উদাহরণ বেঙ্গালুরু। কোভিডের পর এবার বেঙ্গালুরুতে স্কুল, টিউটোরিয়াল এবং কলেজে অনলাইন ক্লাস শুরু হয়েছে। অফিসগুলিকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যথাসম্ভব ওয়ার্ক ফ্রম হোমে ফিরতে। অন্তত গরমের সময়টায়। দেশে যতই বাড়ছে জারে করে জল বিক্রি, প্যাকেজড ওয়াটার কোম্পানি, ততই সর্বত্র গ্রাউন্ড ওয়াটার স্তর কমে যাচ্ছে কেন? মানুষ জল পায় না। এরা এত জল কোথা থেকে পায়?
সরকারি প্রতিষ্ঠান নীতি আয়োগ কয়েক বছর আগে কী রিপোর্ট দিয়েছিল? ভারতের ৭০ শতাংশ ওয়াটার সাপ্লাই দূষিত। শুদ্ধ পানীয় জলের অভাবের কারণেই বছরে গড়ে ২ লক্ষ ভারতবাসীর মৃত্যু হয়। দেড় বছর আগে ভারত সরকারের জল শক্তি মন্ত্রকের মন্ত্রী গজেন্দ্র সিং শেখাওয়াত সাংবাদিক সম্মেলনে গর্বের সঙ্গে বলেছিলেন, ২০১৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত সময়সীমায় ওয়াটার ইন্ডাস্ট্রিতে লগ্নির পরিমাণ প্রায় ২ লক্ষ কোটি টাকা হতে চলেছে। প্রশ্ন হল এই টাকা কোথায় যাচ্ছে? সাধারণ মানুষের আয়ত্তে ক্রমেই সরকারি ব্যবস্থায় পাওয়া জল কমছে এবং ট্যাঙ্কার, জার, প্যাকেজড ওয়াটারের মতো বেসরকারিভাবে পাওয়া জলের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে। অঙ্কটা জলের মতো সহজ হচ্ছে না কেন? গ্রামে গ্রামে ভোটের বুথ বাড়ছে। টিউবওয়েল অথবা কুয়ো বাড়ছে না!