বিশেষ নিবন্ধ

সন্দেশখালি দিয়ে গোটা বাংলার বিচার!
হিমাংশু সিংহ

গেল গেল রব উঠেছে চারদিকে। একজনেরও প্রাণ যায়নি। এক রাউন্ডও গুলি চলেনি। আদালত কোনও রায় দেয়নি। ঠিক একুশ সালের বিধানসভা ভোটের আগের রিপ্লে যেন। অনেকে এও বলছেন, সাক্ষাৎ দেড় দশক আগের নন্দীগ্রামের আন্দোলনকে কপি করার চেষ্টা। কিন্তু কারা করাল? রাস্তায় গাছের গুঁড়ি ফেলে সেই বিদ্রোহের আবহ তৈরির মরিয়া চেষ্টা বহিরাগতদের দিয়ে। আরএসএসের এক ডজন বাছাই করা প্রচারক ছড়িয়ে পড়েছেন গ্রামবাসীদের উত্তেজিত করতে। দিল্লি থেকে সাংবাদিক সম্মেলন করে নোয়াখালির দাঙ্গার সঙ্গে তুলনা টানা হচ্ছে। হ্যাঁ দাঙ্গা! ওটা হলেই ষোলোকলা পূর্ণ হয় গেরুয়া দলের। টানটান মেরুকরণই পদ্ম ফোটার আদর্শ মরশুম! ভোটের বাজারে ইস্যুটাকে তপ্ত কড়াইতে ফেলে আগুন পোয়ানোর বর্ণাঢ্য আয়োজন। সেই পটভূমিতে কেন্দ্রের মন্ত্রীসান্ত্রিদের ডেলি প্যাসেঞ্জারি, যার শুরু আগামী সপ্তাহে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে দিয়ে। এক সপ্তাহে তিনবার। আরামবাগ, কৃষ্ণনগর ও বারাসত। এমনও শোনা যাচ্ছে, বিশ্বগুরুর সফর পর্যন্ত তাওয়া গরম রাখার নির্দেশ এসে গিয়েছে দিল্লি থেকে। তাই সার, জল দাও। সোজা আঙুলে পশ্চিমবঙ্গে আসন বাড়ানো যাবে না দেখে আঙুল বেঁকিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা তোলার প্রাণান্তকর চেষ্টা। জল ঘোলা করার এই খেলায় চোদ্দো আনা বিজেপি আর বাকি এক আনা সিপিএম, এক আনা কংগ্রেস। কান পাতলেই শোনা যাচ্ছে, সংগঠন বলে তো কিছুই নেই, আগের বারের ১৮ আসন জেতার রেকর্ডটা অন্তত স্পর্শ করতে হবে তো!
কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের চার দশকেরও বেশি দীর্ঘ রাজনৈতিক কেরিয়ারে যখনই আঘাত নেমে এসেছে তখনই আরও দ্বিগুণ বেগে প্রত্যাঘাত করেছেন। শত প্রতিকূলতা, হামলা তাঁর লড়াইকে আরও উজ্জ্বল করেছে, মহান করেছে। এবারও এজেন্সির হানা, নেতা, মন্ত্রী, বিধায়কদের গ্রেপ্তারি এবং সবশেষে কলকাতা থেকে ৭৫ কিলোমিটার দূরের সন্দেশখালির ‘অমানবিক’ কার্যকলাপের পর্দা ফাঁস। নিঃসন্দেহে একটা অন্যায় হয়েছে। এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই। কতজনের জমি দখল হয়েছে, ক’জন নারীর সম্ভ্রম হরণ হয়েছে তা তদন্তের বিষয়। কিন্তু একজনেরও হয়ে থাকলে তা যেমন ঘৃণ্য অপরাধ, তেমনই স্রেফ ভোটের লক্ষ্যে নারীর ইজ্জত হরণের কাহিনি নিয়ে তিলকে তাল করার প্রয়াসও সমান দোষে দুষ্ট। জোর করে চাষের জমিতে নোনা জল ঢুকিয়ে বলপূর্বক ভেড়িতে পরিণত করা নিঃসন্দেহে অন্যায়। দোষীর শাস্তি চাই। আরও আগে স্থানীয় প্রশাসনের সতর্ক হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু অন্যায়টা করল কারা? সত্যি কোনও রাজনৈতিক দল, কোনও গোষ্ঠী, সরকার না কতিপয় ব্যক্তি। যতজন নারী কিংবা পুরুষ ক্যামেরার সামনে অভিযোগ করেছেন তাদের কথায় উঠে এসেছে প্রধানত তিনটি নাম। শেখ শাহজাহান, শিবু হাজরা এবং উত্তম সর্দার। এরা তিনজনই কি একটা দল হতে পারে কিংবা সরকার? তা তো হতে পারে না। সরকার ও দলটা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নামে চলে। তাঁকে দেখেই ২৯৪ আসনে মানুষ ভোট দেয়। একুশের ভোটেও নেত্রীকে সামনে রেখেই তৃণমূল প্রার্থী সুকুমার মাহাত পেয়েছেন ১ লক্ষ ১২ হাজার ভোট। এই লক্ষাধিক মানুষের জনসমর্থনের উৎস কারা? অনুগামী আছেন, সমর্থক আছেন, আছেন কট্টর দলীয় কর্মী, সৎ নেতা, অসৎ ধান্দাবাজ স্থানীয় ব্যবসায়ী সবাই। এদের সবাইকে মমতাদেবী বাছাই করে আনেননি, ভালোমন্দ নিয়েই সমাজ। শুধু তিনজনের অপকর্মের জন্য সব শেষ হয়ে যেতে পারে। প্রতিবাদ সবসময় স্বাগত কিন্তু ভোটের নামে বাড়াবাড়ি? শিবু, উত্তমরা দলেরই অংশ যেহেতু তাই নিশ্চয় জবাব দিতে হবে। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক জীবন খোলা খাতার মতো। স্বচ্ছতা সংশয়াতীত। কী বিরোধী নেত্রী আর কী মুখ্যমন্ত্রী, শত প্রতিকূলতার সামনে দাঁড়িয়েও মানুষের আদালতে কৈফিয়ত দিতে তিনি কসুর করেননি কখনও। তাঁর জনসমর্থনের তল আজও পায়নি বিরোধীরা। এবারও কিন্তু তিনি তৈরি। আবারও খেলা হবে। আরও প্রোঅ্যাকটিভ মেজাজেই খেলা হবে। মরিয়া চেষ্টা হবে, টাকার বন্যা বইবে, হাওয়াই জাহাজের মহার্ঘ জ্বালানি নষ্ট হবে। সকাল বিকেল ডেলি প্যাসেঞ্জারি চলবে পাল্লা দিয়ে। তবু মাত্র তিনজনের কৃতকর্মের দায় চাপিয়ে একটা রাজনৈতিক দলকে কলঙ্কিত করার চক্রান্ত এবারও সফল হওয়া কঠিন। কারণ সন্দেশখালি গোটা রাজ্য নয়। তার চেয়েও কঠিন বাংলা ও বাঙালির অস্মিতাকে বিসর্জন দিয়ে বহিরাগতদের দ্বারা চালিত একটি দলকে বাংলায় পাকাপাকি জায়গা দেওয়া।
২০১১ সালে পশ্চিমবঙ্গের যে-ক’টি বিধাসভা আসনে পরিবর্তন চৌকাঠে ধাক্কা খেয়ে থমকে যায় তার মধ্যে সন্দেশখালি ছিল অন্যতম। কেন? তখনও চারদিকে দ্বীপে ঘেরা এই নোনা জলের সন্দেশখালির জমি ও ভেড়ি হাঙররা সিপিএমের নিয়ন্ত্রণেই ছিল। সেদিনের মমতা ঝড়েও ৪৩ শতাংশ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছিলেন সিপিএমের নিরাপদ সর্দার। এখন সেই ঩নিরাপদই জেলে। সেবার মমতা ঝড়ের মধ্যেও ৪০ শতাংশ ভোট পেয়ে পরাজিত হয়েছিলেন তৃণমূলের পদ্মা মাহাত। এগারোয় নয়, সন্দেশখালিতে পালাবদল হয় পাঁচ বছর পর ষোলো সালে। ৯৬ হাজার ভোট পেয়ে জয়ী হন তৃণমূলের সুকুমার মাহাত। তার তিন বছর আগে ২০১৩ সালে শেখ শাহজাহান সিপিএমের ছত্রচ্ছায়া ছেড়ে জোড়াফুলে যোগ দেন। আড়াই বছর আগে টানটান একুশের নির্বাচনে ওই আসনে সুকুমারবাবু দ্বিতীয়বার জয়ী হন ৫৫ শতাংশ ভোট পেয়ে। দ্বীপ ঘেরা এই জনপদে মূলত কৃষক ও মৎস্যজীবীরই বাস। আছেন গরিব, দিনমজুর ও প্রান্তিক মানুষও। মানুষের অধিকার লঙ্ঘিত হয়নি বামেদের ৩৪ বছরে? এর প্রধান কারণ গুন্ডা, বদমায়েশ, মাফিয়াদের কোনও রং হয় না। কোনও দলও হয় না। এরা সব জমানাতেই মানুষের অধিকার হরণ করার জন্য উদ্যত হয়। তাই যোগীরাজ্যেও হাতরাস হয়, মোদিরাজ্যে বিলকিস বানো ধর্ষিত হন, তখন বিজেপির এই প্রতিবাদ কোথায় থাকে? বিপদ বুঝলেই মাফিয়ারা নিমেষে জার্সি বদল করে এবং পুলিস থেকে বাঁচতে ক্ষমতাসীনদের গায়ে এঁটে থাকে। এটাই আমাদের গণতন্ত্রের দস্তুর। এগারোর পরে সন্দেশখালিরও নানা পট পরিবর্তন হয়েছে। আবাসের ঘর হয়েছে, গরিব মহিলাদের অ্যাকাউন্টে লক্ষ্মীর ভাণ্ডার, বিধবাভাতার টাকা ঢুকেছে, রাস্তাঘাট, স্থানীয় হাসপাতালের উন্নয়ন হয়েছে। স্বাস্থ্যসাথী, কন্যাশ্রী থেকেও বঞ্চিত হয়নি জনপদের মানুষ। এখনও ক্যাম্প চলছে। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দু’শো জনমুখী প্রকল্প ও প্রচেষ্টাকে বানচাল করে দিয়েছে তিন মূর্তিমান শিবু হাজরা, উত্তম সর্দার ও শেখ শাহজাহানের অতিমাত্রায় লোভ আর লালসা। মমতাদেবী দিনের আলোয় বৈঠক করেন, প্রশাসনের কর্তাদের আরও সংবেদনশীল হতে অনুরোধ করেন। আর এইসব স্বঘোষিত চুনোপুঁটিরা মিটিং করেন রাতের অন্ধকারে নারীবেষ্টিত হয়ে। মমতা তাঁদের এত দিয়েছেন তবু লোভ যায় না!
কিন্তু এটাই কি গোটা পশ্চিমবঙ্গ? পশ্চিমবঙ্গের মোট এলাকা ৮৮ হাজার ৭৫২ বর্গ কিলোমিটার বা ৩৪ হাজার ২৬৭ বর্গমাইল। মোট জনসংখ্যা প্রায় ১০ কোটির মতো। আর এই সন্দেশখালির ১ ও ২ নং ব্লক মিলিয়ে তিন লক্ষের কিছু বেশি মানুষের বাস। এলাকা ৪০০ বর্গ কিলোমিটারের মতো। সাক্ষরতার হার ৭০ শতাংশের বেশি। শেখ শাহজাহান, শিবু সর্দারদের হাতে জমি লুট হয়েছে, মহিলাদের সম্ভ্রম গিয়েছে সন্দেশখালি বিধানসভার সর্বত্র নয়, একটি দু’টি এলাকায়। তবু এটাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলতে আমি রাজি নই, সংখ্যাটা যতই হোক একটা হলেও অপরাধ। প্রশ্ন হচ্ছে, ৮ ফেব্রুয়ারির পর অভিযোগ আসতেই রাজ্য সরকার শিবু ও উত্তমকে ধরলেও এখনও কেন অধরা শাহাজাহান? এই প্রশ্নটা কিন্তু শুধু রাজ্য সরকারকে করলেই চলবে না। করতে হবে কেন্দ্রীয় এজেন্সিকেও। ইডি কী করছে? গত ৫ জানুয়ারি সন্দেশখালিতে তল্লাশিতে গিয়ে এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেটের অফিসাররা আক্রান্ত হলেন। তারপর এতদিনেও ইডি তাকে ধরতে পারল না কেন? প্রাথমিকভাবে মামলাটা তো কেন্দ্রীয় এজেন্সির, তারা ধরছে না কেন? ওই ঘটনার পর দিল্লি থেকে তদন্তকারী সংস্থার কর্তারা বার কয়েক রাজ্যে এসেছেন। বাড়তি বাহিনীও এসেছে। শেখ শাহজাহানকে ধরার দায়িত্ব শুধু রাজ্য সরকারের একার হতে পারে না। এই দায়িত্ব সমানভাবে বর্তায় কেন্দ্রীয় এজেন্সির ঘাড়েও। ওই যে বললাম মাফিয়াদের কোনও রং হয় না, দল হয় না। আপনি যত বড় সৎই হোন না কেন, গোটা কলকাতা শহরের বাড়ির নকশা পাশের ক্ষমতা আপনার উপর ন্যস্ত হলে কিংবা মন্ত্রী হলে ওরা সিঁদ কেটে ঢুকবেই, আপনি টেরও পাবেন না। এটাই আজকের আর্থ সামাজিক অবক্ষয়ের প্রধান কারণ। সৎ মানুষ নয়, সংবেদনশীল সরকার নয়, শেষকথা বলছে মাফিয়ারাই। কিন্তু তাবলে সুবিচার চাওয়ার নাটক করার নামে কর্তব্যরত এক পুলিস কর্তাকে খালিস্তানি বলে দেগে দেওয়াও কি সমান অপরাধ নয়? জাত সম্প্রদায় তুলে কথা বলা কেমন সংস্কৃতি। কোনও কারণ না দেখিয়ে বেছে বেছে মতুয়াদের আধার কার্ড বাতিল করাই বা কেমন আহ্লাদ। একজন বিজেপি নেতার (থুড়ি মন্ত্রী) শংসাপত্র নিয়ে সেই কার্ড আবার অ্যাক্টিভেট করতে হবে? এ তো বিরাট রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র! 
আসলে ভোট বড় বালাই। মানবিকতা সংবেদনশীলতা এসবই প্রসাধনী। ভোট কড়া নাড়ছে দুয়ারে, তাঁকে ৩৭০ পেতেই হবে। আর কে না জানে এপথে প্রধান বাধা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই। তিনি থাকতে বাংলায় অপারেশন লোটাস সম্ভব নয়। তাই এমন পরিস্থিতি তৈরি কর যাতে সেনা, আধাসেনা দিয়ে রেকর্ড দশ কি এগারো দফায় ভোট হয়। গোটা তৃণমূল দলটাকে জেলে পুরে সেনা দিয়ে ভোট করানো যায়। তাহলেও কি ইচ্ছাপূরণ হবে মোদি অমিত শাহের কিংবা ৩৫৬ করে। একা মমতাই যথেষ্ট ওদের মোকাবিলায়। এতকিছুর পরও পশ্চিমবঙ্গের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ কিন্তু এখনও বহিরাগতদের হাতে পদ্মফুল ফোটা দেখতে চায় না। রাগ হতে পারে অভিমান হতে পারে অসন্তোষ থাকতে পারে তবু চেনা ঘরের মেয়ে তো, একবার ৩৫৬ করে দেখুন না!
5Months ago
কলকাতা
রাজ্য
দেশ
বিদেশ
খেলা
বিনোদন
ব্ল্যাকবোর্ড
শরীর ও স্বাস্থ্য
সিনেমা
প্রচ্ছদ নিবন্ধ
আজকের দিনে
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
mesh

পারিবারিক অশান্তির অবসানে গৃহ সুখ ও শান্তি বাড়বে। প্রেমের ক্ষেত্রে শুভ। কর্মে উন্নতি। উপার্জন বৃদ্ধি।...

বিশদ...

এখনকার দর
ক্রয়মূল্যবিক্রয়মূল্য
ডলার৮৩.২৬ টাকা৮৪.৩৫ টাকা
পাউন্ড১০৬.৪৬ টাকা১০৯.১২ টাকা
ইউরো৮৯.৭৬ টাকা৯২.২০ টাকা
[ স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া থেকে পাওয়া দর ]
*১০ লক্ষ টাকা কম লেনদেনের ক্ষেত্রে
দিন পঞ্জিকা