বিশেষ নিবন্ধ

বারবার আক্রান্ত হয়েছে বাংলা ভাষা
সন্দীপন বিশ্বাস

বাংলা ভাষার যে প্রাচীনতম নিদর্শন পাওয়া গিয়েছে, তা কম করে হাজার বছরের। মোটামুটি ‘চর্যাপদ’ই হল বাংলা ভাষার প্রথম প্রামাণ্য গ্রন্থ। এই হাজার বছর ধরে বাংলা ভাষাকে বার বার লড়াই করতে হয়েছে অন্য ভাষার সঙ্গে। তার উপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে অন্য ভাষাকে। অন্য ভাষা দিয়ে বাংলাকে নির্মূল করার চেষ্টা বাঙালি কিন্তু মেনে নেয়নি। বার বার সে তার মাতৃভাষা রক্ষার জন্য লড়াই চালিয়ে গিয়েছে। সেই লড়াইকেই স্বীকৃতি দিয়েছে রাষ্ট্রসঙ্ঘ। তাই আজ সারা বিশ্বে পালিত হয় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। 
২১ ফেব্রুয়ারি এক ঐতিহাসিক দিন। ১৯৫২ সালে এই দিনেই বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার লড়াইয়ে প্রাণ দিয়েছিলেন রফিক, জব্বাররা। এই লড়াইয়ের সূচনা ১৯৪৭-এ পাকিস্তানের জন্ম নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই। পাকিস্তান জোর করে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসাবের ঘোষণা করে। মনে রাখা দরকার, তখন কিন্তু সমগ্র পাকিস্তানে উর্দুভাষীর থেকে বাংলায় কথা বলা মানুষই সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিলেন। পূর্ব পাকিস্তানের তৎকালীন বাঙালি মুসলমানদের জাতীয়তাবোধ ছিল ধর্মনিরপেক্ষ। তাই সেই সিদ্ধান্ত তাঁরা মেনে নেননি। তাঁদের প্রতিবাদ ছড়িয়ে পড়েছিল। দাবি ছিল, সরকারি কাজে বাংলা ভাষাকেও স্বীকৃতি দিতে হবে। মাতৃভাষার সম্মান রক্ষার লক্ষ্যে ধর্মীয় প্রশ্নকে দূরে সরিয়ে রেখে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়লেন পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিরা। তাঁদের কাছে প্রধান লক্ষ্য ছিল বাঙালির জাতীয়তাবোধকে রক্ষা করা, বাঙালির সংস্কৃতিকে রক্ষা করা। ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকার রাজপথে নেমে এল ছাত্র-যুবকদের অনমনীয় প্রতিবাদের ঝড়। সেই আন্দোলনে শাসকের গুলিতে প্রাণ গেল রফিক, সালাম, বরকত, জব্বারদের। সেই ভাষা আন্দোলনকে স্বীকৃতি দিয়ে ১৯৯৯ সালে রাষ্ট্রসঙ্ঘ ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক ভাষা দিবস হিসাবে ঘোষণা করে। 
কিন্তু বাংলা ভাষার উপর আক্রমণ সেটাই প্রথম ছিল না। তার আগে ইংরেজ আমলেও তার লক্ষণগুলি দেখা গিয়েছিল। আরবি, ফারসি, হিন্দি দিয়ে বাংলা ভাষার অগ্রগতি রুদ্ধ করার চেষ্টা হয়েছিল। সেদিন বাংলা ভাষার সম্মানের জন্য প্রতিবাদী ভূমিকা গ্রহণ করেন একজন ইংরেজ। নাম তাঁর উইলিয়াম কেরি। ১৭৬০ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যু হল মধ্যযুগের শেষ শক্তিমান কবি ভারতচন্দ্রের। তারপর একবারে ঈশ্বর গুপ্তের হাত ধরে সূচনা হল সাহিত্যের নতুন যুগের। মোটামুটি একশো বছর ছিল বাংলা সাহিত্যের অন্ধকার যুগ। যে কোনও ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখে তার সাহিত্য। সারস্বত সাধনার মধ্য দিয়ে পুষ্ট না হলে ভাষার মান অধোগামী হয়ে ওঠে। তখন একদিকে নিম্নমানের কুরুচিকর সাহিত্য ও খেউড় গানের মধ্য দিয়ে বাংলা ভাষা বেঁচে থাকার চেষ্টা করছিল, অন্যদিকে ইংরেজদের অবজ্ঞা আর অবহেলায় তার মর্যাদা ক্রমেই ক্ষুণ্ণ হচ্ছিল। একদম প্রথম যুগের ইংরেজদের মধ্যে অনেকেই বাংলা ভাষাকে পছন্দ করত না। তাই আরবি, ফারসি আর হিন্দি ভাষার চাপে শ্বাসরুদ্ধ হচ্ছিল বাংলা ভাষার। সেই বদ্ধ আবহ থেকে তাকে মুক্ত আলোয় পাখা মেলার উদ্যোগ নিলেন উইলিয়াম কেরি। ১৮০০ সালে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের প্রতিষ্ঠা একটি মাইলস্টোন। ভারতে কেরি আসেন ১৭৯৩ সালে। এসেই তিনি সংস্কৃত, ফারসি, হিন্দি ভাষা শেখেন। বুঝেছিলেন বাংলায় কাজ করতে গেলে বাংলা ভাষাটাও শেখা দরকার। সেটা শিখলেন রামরাম বসুর কাছ থেকে। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে যোগদানের পর তিনি বাংলা ভাষার প্রসারে উদ্যোগী হন। তিনি মনে করেছিলেন বাংলা ভাষাকে  শক্তিশালী করতে গেলে বাংলায় লেখা কয়েকটি বইয়ের প্রয়োজন। ১৮০১ সালে কেরি লিখলেন বাংলা ব্যাকরণ বই। অবশ্য এ ব্যাপারে কেরির আগে আরও দুই বিদেশির নাম করতে হয়। প্রথমে মানোয়েল দ্য আসসুম্পসাঁও এবং পরে নাথানিয়াল হ্যালহেড। দু’জনেই বাংলা ব্যাকরণ রচনা করেন। কেরির ব্যাকরণ অবশ্য ছিল অনেক বেশি স্বয়ংসম্পূর্ণ। তিনি বুঝেছিলেন, শুধু সাধু ভাষা নয়, বাংলা ভাষাকে সমুন্নত করার জন্য দরকার সাহিত্যে সাধারণ মানুষের অর্থাৎ শ্রমজীবী মানুষের মুখের ভাষাকে তুলে ধরা। সেই উদ্দেশ্য থেকে লিখলেন ‘কথোপকথন’। জেলে, মুটে, মজুর থেকে ভিক্ষুকের ভাষা সেখানে স্থান পেয়েছে। এরপর তিনি অন্যদেরও বাংলা ভাষায় বই লেখার প্রেরণা দিলেন। রামরাম বসুকে দিয়ে লেখালেন ‘প্রতাপাদিত্য চরিত্র’। নিজে লিখলেন বাংলা অভিধানও। তারপরেও চলল প্রবল লড়াই। কলেজের ফরাসি, উর্দু, হিন্দি বিভাগের জন্য যে টাকা বরাদ্দ হল, তার অর্ধেকও হল না বাংলা বিভাগের জন্য। এছাড়াও বাংলা বিভাগকে সঙ্কুচিত করার জন্য কর্তৃপক্ষ উঠে পড়ে লাগল। হাল ছাড়লেন না কেরি। একদিকে কলেজে বাংলার মর্যাদা রক্ষার লড়াই, অন্যদিকে কলেজের বাইরে সাধারণ মানুষের মধ্যে বাংলা বই ছড়িয়ে দেওয়ার প্রয়াস। এই লড়াইয়ে তিনি হেরে যাননি। তাঁর ‘কথোপকথন’ বইটি থেকে উৎসাহিত হয়ে সেই ভাষায় সাহিত্য রচনায় প্রয়াসী হয়েছিলেন টেকচাঁদ ঠাকুর, হুতোম পেঁচা, দীনবন্ধু মিত্ররা। বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার লড়াইয়ে তাই উইলিয়াম কেরির অবদান ভোলার নয়।       
২১ ফেব্রুয়ারির আড়ালে যেন খানিকটা চাপা পড়ে গিয়েছে আর একটি ঐতিহাসিক দিন। ১৯৬১ সালের ১৯ মে। অসমে রাজ্যভাষা হিসাবে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছিল অসমিয়া ভাষাকে। অথচ সেই সময় সেখানে বাংলায় যত মানুষ কথা বলতেন, প্রায় ততজন মানুষই অসমিয়া ভাষায় কথা বলতেন। কিন্তু দিল্লি এবং অসম সরকার মদত দিল অসমিয়াদের। বরাক উপত্যকার বাঙালিদের প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও ১৯৬০ সালের ১০ অক্টোবর অসম বিধানসভায় পাশ হয়ে গেল রাজ্যভাষা বিল। সেখানে অসমিয়া ভাষাকেই একমাত্র রাজ্যভাষা বলে স্বীকৃতি দেওয়া হল। প্রতিবাদে শুরু হল বাঙালিদের আন্দোলন। মাতৃভাষার সম্মান রক্ষার্থে এবং বাংলা ভাষার স্বীকৃতি আদায়ের সেই আন্দোলন হয়ে উঠেছিল রক্তাক্ত। ধিকি আগুন জ্বলছিল হাইলাকান্দি, শিলচর, বদরপুর, করিমগঞ্জ, মাজুলিতে। অসমিয়াদের অত্যাচারে জর্জরিত হলেন সেখানকার বাঙালিরা। তাঁদের স্লোগান ছিল, ‘জান দেব, জবান দেব না’। কিন্তু ১৯৬১-র ১৯ মে সত্যাগ্রহ আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ঘটে গেল বিপর্যয়। শিলচর স্টেশনে  বাঙালির অহিংস আন্দোলনের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল সেনারা। গুলির পর গুলি চলল। স্বাধীন ভারতে যেন আর এক জালিয়ানওয়ালাবাগ। মুহূর্তে লুটিয়ে পড়লেন ১১ জন সত্যাগ্রহী। কমলা ভট্টাচার্য, হিতেশ বিশ্বাস, কুমুদ দাস, শচীন পাল সহ ১১ জন। সেই ভাষা-শহিদদেরও আমরা যেন ভুলে না যাই।     
আসলে ভাষার সম্মান রক্ষার লড়াই হল অধিকার রক্ষার লড়াই, যে অধিকারের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে রাজনৈতিক অধিকারও। ভাষা একটা জাতির সংস্কৃতির পরিচয়। জাতিসত্তার বিকাশের মাধ্যম হল এই ভাষা। মনে রাখা দরকার, আজও বাংলা সহ দেশের অহিন্দিভাষী রাজ্যগুলি ভাষা সন্ত্রাসের শিকার। বাহুবলী সরকার হিন্দি ভাষার দাদাগিরি চালানোর চেষ্টা চালাচ্ছে। প্রত্যেকেই এর বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। তাই ভাষাদিবস স্মরণ করার একটা তাৎপর্য রয়েছে। বাঙালির জাতীয়তাবোধ এতটুকু খর্ব হলে তার ভাষা ও সংস্কৃতি বিপর্যস্ত হতে পারে। তার কিছু কিছু লক্ষণও দেখা যাচ্ছে। তাই সাবধান হওয়া দরকার। সতর্ক থাকতে হবে, বাংলা ভাষার ওপর যেন গুটকার ছাপ না পড়ে।  প্রতি মুহূর্তে নিঃশব্দে সোশ্যাল মিডিয়া, সিরিয়াল, চলচ্চিত্র, কথোপকথনের মধ্য  দিয়ে আমাদের ভাষা থেকে বাস্তুচ্যূত করার খেলা চলছে, আমাদের পরাধীন করার চেষ্টা চলছে। 
শুধু কবিতা লিখে আর গল্প, উপন্যাস লিখে বাংলা ভাষাকে রক্ষা করা সম্ভব নয়। মুখের কথার মধ্য দিয়ে তার অস্তিত্ব বজায় থাকে। তা বলে কী আমরা অন্য ভাষা থেকে শব্দ ধার নেব না! অবশ্যই নেব। পৃথিবীর সব ভাষাই অন্য ভাষা থেকে শব্দগ্রহণ করে পুষ্ট হয়েছে। কিন্তু বিদেশি শব্দকে প্রত্যেক ভাষা নিজের মতো করে আত্তীকরণ করেছে। বাংলাও তার চলার পথে নানা ভাষা স্বতঃস্ফূর্তভাবে আত্তীকরণ করেছে। কিন্তু চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হলে সে বিদ্রোহ করেছে। 
ভাষা হল স্রোতস্বিনী নদীর মতো। চলতে চলতে তার শব্দভাণ্ডার পূর্ণ হয়। কিছু শব্দ আসে, কিছু হারিয়ে যায়। হাজার বছরে বাংলা ভাষার বারবার বদল ঘটেছে। চর্যাপদের কাহ্নপাদ, ভুসুকপাদ থেকে বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন হয়ে জ্ঞানদাস, গোবিন্দদাস, বিদ্যাপতি, চণ্ডীদাসের সরণি বেয়ে বাংলা ভাষা এগিয়েছে। মুকুন্দরাম, ভারতচন্দ্র, রামপ্রসাদের কাল পেরিয়ে ভাষা এসে পৌঁছেছে আধুনিক কালে। বঙ্কিমচন্দ্র যে ভাষায় সাহিত্য রচনা করেছেন, রবীন্দ্রনাথ সে ভাষায় করেননি। শরৎচন্দ্র, তারাশঙ্কর, বিভূতিভূষণ, মানিকের ভাষার মধ্যেও ভিন্নতা আছে। আবার জীবনানন্দ যে বাংলায় কবিতা লেখেন, বিষ্ণু দে, সুধীন্দ্রনাথ সেই ভাষায় কবিতা লেখেন না। কিন্তু সবই বাংলা ভাষা। মনে রাখা দরকার, বাংলা ভাষার মধ্য দিয়ে আমরা প্রতিনিয়ত মাতৃদর্শন করি।  তাই কেউ যখন বলেন, ‘আমার ছেলের বাংলাটা ঠিক আসে না’, তখন বোঝা যায় তিনি আসলে নিজের অজান্তেই ভাষা-সন্ত্রাসের শিকার। তিনি মৃত এক সত্তা।   
5Months ago
কলকাতা
রাজ্য
দেশ
বিদেশ
খেলা
বিনোদন
ব্ল্যাকবোর্ড
শরীর ও স্বাস্থ্য
সিনেমা
প্রচ্ছদ নিবন্ধ
আজকের দিনে
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
mesh

পারিবারিক অশান্তির অবসানে গৃহ সুখ ও শান্তি বাড়বে। প্রেমের ক্ষেত্রে শুভ। কর্মে উন্নতি। উপার্জন বৃদ্ধি।...

বিশদ...

এখনকার দর
ক্রয়মূল্যবিক্রয়মূল্য
ডলার৮৩.২৬ টাকা৮৪.৩৫ টাকা
পাউন্ড১০৬.৪৬ টাকা১০৯.১২ টাকা
ইউরো৮৯.৭৬ টাকা৯২.২০ টাকা
[ স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া থেকে পাওয়া দর ]
*১০ লক্ষ টাকা কম লেনদেনের ক্ষেত্রে
দিন পঞ্জিকা