বিশেষ নিবন্ধ

ভোটের আগেই দুর্নীতির পর্দাফাঁস!
হিমাংশু সিংহ

স্বাধীন ভারতের বৃহত্তম দুর্নীতি। কালো টাকা উদ্ধারের নামে কালো টাকাকেই ঘুরিয়ে সাদা করার আইনি ফাঁদ। পরপর তিনবার। ২০১৬, ২০১৮ এবং ২০২০। প্রথম অঙ্কে নোট বাতিল, দ্বিতীয় খেপে নির্বাচনী বন্ড এবং সর্বশেষে কোভিড প্রহরে রহস্যজনক পিএম কেয়ার্স। যার চারআনা তথ্যও এখনও দেশবাসীর হাতে নেই। এমনকী অর্থমন্ত্রক ও রিজার্ভ ব্যাঙ্কও বহু ব্যাপারে অন্ধকারে। সেই সুযোগেই কয়েক লক্ষ কোটি টাকা হাতবদল হয়েছে। সাদা কালো আর কালো সাদার রূপ বদলে মঞ্চস্থ হয়েছে একের পর এক জুমলা। সিবিআই, ইডি, ইনকাম ট্যাক্সের মুরোদ নেই ওখানে ঢোকার। ওদের যত কারিকুরি বিরোধী রাজ্যে, মায় বাংলায়। বিকশিত ভারতের জন্য না হোক এই অদ্ভুত ধাঁধার আড়ালে বিজেপির তহবিলকে ধরাছোঁয়ার বাইরে নিয়ে যাওয়ার কৃতিত্বের জন্যই ২০৪৭ সালে দেশ আজকের ‘মহান’ প্রধানমন্ত্রীকে স্মরণ করবে। সঙ্গে ফাউ মন্দির আর মেরুকরণের ঘোর, আর নেতা কেনাবেচা। যার জয়গানে রক্তশূন্য জনগণও আজ উদ্বাহু!
আপাতত ১৩ মার্চের অপেক্ষায় দেশবাসী। না ভোটের দিন ঘোষণার প্রহর গোনা নয়। নির্বাচনী ফল জানার উৎকণ্ঠাও নয়। ফল তোলা থাক মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহের জন্য। তার আগেই পর্দাফাঁস হবে নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে কোন শিল্পপতি কোন দলকে মোদি জমানায় কত টাকা দিয়েছে সেই গুরুত্বপূর্ণ পরিসংখ্যানের। ভোটের ফলের চেয়ে তা কম চিত্তাকর্ষক হবে না। এখানেই শেষ নয়, বিনিময়ে গত সাতবছরে সেই শিল্পগোষ্ঠী সরকারের থেকে কী কী সুবিধা পেয়েছে তাও বেআব্রু হবে। দুধ কা দুধ পানি কা পানি। কোন শিল্পপতি গেরুয়া দলকে কত টাকা দিয়েছে এবং বিনিময়ে কতটা জমি, লাইসেন্স, হরেক কিসিমের ব্যবসায়িক অনুগ্রহ পেয়েছে তার পোস্টমর্টেমের সুযোগ করে দিয়েছে দেশের সর্বোচ্চ আদালত। সরকারি দলকে কোটি কোটি টাকার চাঁদা ও সরকারি নীতি প্রণয়নের অভিমুখ যদি একই সরলরেখায় এগয়, অঙ্কের ভাষায় সমানুপাতিক হয় তাহলে নিঃসন্দেহে বড় দুর্নীতির খোঁজ মিলবে এবং বিনা দ্বিধায় বলতে পারি, তা হবে বর্তমান গেরুয়া সরকারের সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর কেলেঙ্কারি। সুপ্রিম কোর্টের প্রবীণ আইনজীবী, প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী কপিল সিবালের মতে, এটাই হবে স্বাধীনতার পর দেশের সর্ববৃহৎ কেলেঙ্কারি। তার অভিঘাত ছাড়িয়ে যাবে বোফর্স, টু-জি, কয়লা কেলেঙ্কারি ও বিতর্কিত এয়ারসেল-ম্যাক্সিস চুক্তিকেও। 
বৃহস্পতিবার দেশের সর্বোচ্চ আদালত এক ঐতিহাসিক রায়ে আগামী ৬ মার্চের মধ্যে ভারতীয় স্টেট ব্যাঙ্ককে বন্ড বিক্রেতাদের সবার পরিচয় জানাতে বলেছে। স্টেট ব্যাঙ্ককে সেই তথ্য দিতে হবে দেশের স্বয়ংশাসিত সাংবিধানিক সংস্থা নির্বাচন কমিশনকে। এরপর কমিশন সেই তথ্য ১৩ মার্চের মধ্যে ওয়েবসাইটে আপলোড করবে। এমনই নির্দেশ সর্বোচ্চ আদালতের। অর্থাৎ এতদিন যার বিন্দুবিসর্গ সাধারণ মানুষের জানার অধিকার ছিল না, তা সর্বসমক্ষে এসে যাবে। ১৯ (১এ) ধারায় তথ্য জানার অধিকার প্রতিটি ভারতবাসীর স্বীকৃত অধিকার। গত সাতবছর তা লঙ্ঘিত হয়েছে পদে পদে। জনগণের মৌলিক অধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে কোভিড জমানায় চালু হওয়া পিএম কেয়ার্স ফান্ড এবং ২০১৬ সালের ৮ নভেম্বরের নোট বাতিলের তুঘলকি সিদ্ধান্তেও। মোদি সরকার এসবকে পাত্তাই দেয়নি। কখনও বলেছে, কালো টাকা ধরতেই এমন জবরদস্ত পদক্ষেপ, আবার কখনও বলেছে এটা সরকারি তহবিল নয় (পিএম কেয়ার্স), তাই আরটিআইয়ের আওতায় আসবে না। স্বচ্ছতাই গণতন্ত্রের প্রথম ও শেষ শর্ত। প্রধানমন্ত্রীর নামাঙ্কিত তহবিল কী করে মানুষের জানার অধিকারের বাইরে থাকে? জনগণকে এড়িয়ে বিকাশের মেকি ফানুস ওড়ালে তা দীর্ঘস্থায়ী হয় না। প্রথমে মানুষের দুর্ভোগ বাড়ে, সময় এগলে শাসকের কাছেই ব্যুমেরাং হয়ে তা ফিরে আসে। এটাই ইতিহাসের শিক্ষা।
নির্বাচনী বন্ড সংক্রান্ত আইনেও কালো টাকার দৌরাত্ম্য কমানোর বদলে যদি ঘুরিয়ে অসাধু ধান্দাকেই প্রশ্রয় দেওয়া হয় তাহলে কালের কষ্টিপাথরে একদিন সত্যটা বেরিয়ে আসবেই। আসল সত্য সামনে এলেই কোন দলের সঙ্গে কোন শিল্পপতির কতটা মাখামাখি তা জলের মতো পরিষ্কার হতে বাধ্য। সেই দিক দিয়ে সাধারণ নির্বাচনের দু’মাস আগে শীর্ষ আদালতের পাঁচ সদস্যের সাংবিধানিক বেঞ্চের রায় নিঃসন্দেহে তাৎপর্যপূর্ণ। এই রায়ে শুধু বিজেপিই নয়, বিপাকে পড়বেন শিল্পপতিরাও। রাজনৈতিক ঘূর্ণির আঁচ লাগবে তাঁদের গায়ে। স্টেট ব্যাঙ্ক যদি আদালতের নির্দেশ মেনে শিল্পপতিদের পরিচয় জানায় তাহলে তা ভোটের মুখে মোদি সরকারের চরম অস্বস্তির কারণ হবে। পরিচয় সর্বদা গোপন রাখা হবে, এই শর্তেই ব্যবসায়ীরা বন্ড উপহার দিয়ে শাসকদলের নেক নজরে থাকার চেষ্টা করেছেন। ব্যবসা চালাতে এ এক দস্তুর। এখন সেই শর্ত ভঙ্গ হলে সরকারের বিশ্বাসযোগ্যতায় টান পড়তে বাধ্য। ভবিষ্যতে শিল্প বিনিয়োগেও তার প্রভাব পড়লে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।  যদি দেখা যায়, নির্বাচনী বন্ড থেকে গেরুয়া দলের পাওয়া ৬ হাজার ৫৬৬ কোটি টাকার মধ্যে শুধু একজন শিল্পপতিই দু’হাজার কোটি দিয়েছেন, তাহলে দেশের মানুষের চোখ কপালে ওঠা স্বাভাবিক নয় কি? তখন অঙ্ক কষা চলবে, দান খয়রাতি করা সেই কয়েকজন বাছাই করা ধনীর দুলালের হাতেই গত এক দশকে দেশের সিংহভাগ সম্পদ গিয়েছে কি না। দু’য়ে দু’য়ে মিললেই ভাগফল শূন্য। মৌচাকে ঢিল মারলেই মধুর স্বাদ কিন্তু গরিবের ঘরে পৌঁছয় না। গরিব মানুষের দস্তুর সেই হাতে পেন্সিল, মুখে কুলুপ আর আকাশের ঠিকানায় লেখা অব্যক্ত চিঠি। এটা তো জানাই যে আমাদের ১৪০ কোটির দেশে গরিবি সবার আর ‘ধনসম্পদ’, ‘বিকাশ’ হাতেগোনা মাত্র কয়েকজনেরই অধিকার!
মধ্যরাতে নোট বাতিলের বিভীষিকার পর কেটে গিয়েছে প্রায় সাড়ে সাত বছর। কালো টাকা দেশে কমেনি, ধরা যায়নি উৎসও। উল্টে নতুন ২ হাজার টাকাও বাতিল হয়ে ইতিহাসে স্থান পেয়েছে। উচ্ছন্নে গিয়েছে কোটি কোটি টাকা। বরং সরকারি সৌজন্যে বড় বড় ওস্তাদ বেওসায়িরা কালা ধান্দা বাড়িয়ে নিয়েছেন দৈর্ঘ্য ও প্রস্থে। এমনও রটনা আছে রাজনৈতিক দল হিসেবে নোট বাতিলের ষোলো আনা উশুল করেছে বিজেপি নিজেও। তবে নোট বাতিল যেহেতু সরকারের একটা নীতিগত প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত তাই সুপ্রিম কোর্ট তাকে বেআইনি ও অসাংবিধানিক বলেনি। কিন্তু নির্বাচনে কালো টাকার রমরমা রুখতে সতেরো সাল থেকেই নির্বাচনী বন্ড চালুর ঘোষণা করেন তখনকার অর্থমন্ত্রী প্রয়াত অরুণ জেটলি। নির্বাচনে নগদের প্রভাব কমানোর এই কৌশলও ঘুরিয়ে কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন বিজেপিকেই সবচেয়ে লাভবান করেছে। দেখা যাচ্ছে, ৫৭ শতাংশ থেকে শুরু করে কোনও কোনও বছর নির্বাচনী বন্ডের ৯০ শতাংশ পর্যন্ত ঢুকেছে বিজেপিরই কোষাগারে। এই ক্রম তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে কংগ্রেস থাকলেও ব্যবধান অনেক। শতাব্দী প্রাচীন দলটি পুওর সেকেন্ড। উল্টে লঘু পাপে কংগ্রেসের অ্যাকাউন্ট পর্যন্ত ফ্রিজ করে দেওয়ার পথে হাঁটছে আয়কর দপ্তর।
ইলেক্টোরাল বন্ডকে বেআইনি ঘোষণা করে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড় একটা বিশেষ শব্দবন্ধ ব্যবহার করেছেন। ‘কুইড প্রো কিউও’। এটি এমন এক ব্যবস্থা যাতে চাঁদার বিনিময়ে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল বাছাই করা শিল্পপতিদের দিয়ে থাকে। গিভ অ্যান্ড টেক। সোজা কথায় ‘আমি সে ও সখা’। ‘তুতু ম্যায় ম্যায়’।  এর বাইরে জগৎ চলে না। গত সাত বছর ধরে এই ব্যবস্থার সুযোগ নিয়েই গেরুয়া দলের তহবিল ফুলে ফেঁপে উঠেছে থরে থরে। দিল্লিতে প্রাসাদোপম সাততারা অট্টালিকা হয়েছে। বাইরের রাজ্য থেকে আসা কর্মী সমর্থকদের জন্য আলাদা বাড়ি হয়েছে। রাজ্যে রাজ্যে সংগঠন বাড়াতে প্রাসাদ তৈরি হয়েছে, বিরোধীদের ভাঙাতে, এমপি-এমএলএ কিনতে কোটি কোটি টাকা ঢালছেন এই চাঁদার জোরেই। একে কী বলবেন, দুর্নীতি না সুনীতি? নির্ভেজাল স্বচ্ছতা, নাকি মন্দির গড়েছেন বলে সাতখুন মাফ! বোফর্স কেলেঙ্কারি ছিল মাত্র ৬৪ কোটির কিকব্যাকের। তারপর এককভাবে কেন্দ্রে আর কংগ্রেস ক্ষমতা দখল করতে পারেনি। অথচ নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে সরকারি সাহায্য বিলিয়ে কয়েক হাজার কোটি টাকা পকেটে পুরেছে বিজেপি। স্বভাবতই অন্য আর সব রাজনৈতিক দল যেহেতু এই মুহূর্তে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার ধারেকাছে নেই তাই তাদের ভাগ্যে জুটেছে ছিটেফোঁটা খই-মুড়কি। ২০১৮ সালের ২ জানুয়ারি থেকে এপর্যন্ত বন্ডের মাধ্যমে রাজনৈতিক দলের তহবিলে এসেছে প্রায় ১৩ হাজার কোটি টাকা। অঙ্কটা মোটেই হেলাফেলার নয়। বিক্রি হয়েছে অথচ ভাঙানো হয়নি এমন যা বন্ড আছে তা ফেরত দিতে নির্দেশ দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। এই সামান্য নির্দেশ থেকেই বোঝা যায় বিষয়টিকে কতবড় বেআইনি কাজ বলে আদালত মনে করছে। এই বেআইনি কাজের দায় কার? ২০১৭ সালের অর্থবিল রচনা করেছিলেন প্রয়াত অরুণ  জেটলি। তিনি আজ আর ইহলোকে নেই। সাড়ে চারবছর আগে প্রয়াত হয়েছেন। কিন্তু সরকার আছে। নরেন্দ্র মোদির সরকার। সেই সরকারের তৃতীয়বার ক্ষমতায় আসার যাবতীয় প্রস্তুতিও সারা। দেশে-বিদেশে মন্দির, মেরুকরণ দিয়ে প্রকৃত সমস্যা থেকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে দেওয়ার আয়োজনও সম্পূর্ণ। কিন্তু কালো টাকা জব্দ করার আড়ালে দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেওয়ার এই নয়া কৌশল মানুষ কতদিন সহ্য করবে। যদি সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশকে বুড়ো আঙুল দেখাতে এবং নির্বাচনের আগে অস্বস্তি ঢাকতে সরকার অর্ডিন্যান্স জারি করে তাহলে তার ফল হবে আরও মারাত্মক। গণতন্ত্রের একনিষ্ঠ পূজারি নরেন্দ্র মোদি সেই পথে যাবেন কি না সেটাই এখন দেখার। ক্ষমতার দম্ভে তিনি ওপথে যেতেই পারেন, কিন্তু মানুষের আদালতে তা ইতিবাচক বার্তা পাঠাবে না। দেওয়ালের চেয়েও ইতিহাসের চোখ কান কিন্তু আরও প্রখর। 
5Months ago
কলকাতা
রাজ্য
দেশ
বিদেশ
খেলা
বিনোদন
ব্ল্যাকবোর্ড
শরীর ও স্বাস্থ্য
সিনেমা
প্রচ্ছদ নিবন্ধ
আজকের দিনে
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
mesh

পারিবারিক অশান্তির অবসানে গৃহ সুখ ও শান্তি বাড়বে। প্রেমের ক্ষেত্রে শুভ। কর্মে উন্নতি। উপার্জন বৃদ্ধি।...

বিশদ...

এখনকার দর
ক্রয়মূল্যবিক্রয়মূল্য
ডলার৮৩.২৬ টাকা৮৪.৩৫ টাকা
পাউন্ড১০৬.৪৬ টাকা১০৯.১২ টাকা
ইউরো৮৯.৭৬ টাকা৯২.২০ টাকা
[ স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া থেকে পাওয়া দর ]
*১০ লক্ষ টাকা কম লেনদেনের ক্ষেত্রে
দিন পঞ্জিকা