বিশেষ নিবন্ধ

শিক্ষায় নির্মলার উপেক্ষার জবাব রাজ্যের
হারাধন চৌধুরী

 

আজ সরস্বতী পুজো। প্রতিমা সাজিয়ে বিদ্যাদেবীর আরাধনা সব স্কুলে‌‌ হয় কি না কিংবা সেই পরিবেশের উন্নতি অবনতির বিতর্কিত প্রসঙ্গ একপাশে সরিয়েই রাখা যাক। সেই জায়গায়, আজ প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যা, শিক্ষা ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা হলে মন্দ কী।‌ 
***
দু’সপ্তাহ হল, মোদি সরকার আগামী অর্থবর্ষের (২০২৪-২৫) জন্য অন্তর্বর্তী বাজেট পেশ করেছে। তার মধ্যে শিক্ষামন্ত্রকের সামগ্রিক বাজেট বরাদ্দের পরিমাণ ১ লক্ষ ২০ হাজার ৬২৮ কোটি টাকা প্রায়। চলতি বছরের (২০২৩-২৪) বাজেট বরাদ্দের প্রেক্ষিতে বৃদ্ধি ৬.৮ শতাংশ। কিন্তু সংশোধিত বরাদ্দের (১.২৯ লক্ষ কোটি টাকা) তুলনায় কতটা? হায় রে, ৭ শতাংশ কম! এই বরাদ্দ জিডিপির কত শতাংশ? মোদির জাতীয় শিক্ষানীতি শিক্ষায় বরাদ্দ করতে বলেছে জিডিপির অন্তত ৬ শতাংশ। সেই হিসেবে বরাদ্দ হওয়া উচিত ১৯-২০ লক্ষ কোটি টাকা। কিন্তু বাস্তবে যে তার ধারেকাছেও পেল না শিক্ষাক্ষেত্র! এবার পেশ হওয়া বাজেটে স্কুলশিক্ষা এবং সমগ্র শিক্ষা অভিযানে বরাদ্দ সামান্য বাড়লেও টাকা কমিয়ে দেওয়া হয়েছে উচ্চশিক্ষায়। ইউজিসির জন্য গতবছর বরাদ্দ ছিল ৫,৩৬০ কোটি টাকা, অঙ্কটা এবার তার অর্ধেকও নয় (মাত্র ২৫০০ কোটি)! মোট বরাদ্দের মধ্যে, ৭৩ হাজার কোটি টাকা স্কুলশিক্ষা ও সাক্ষরতায় এবং ৪৭,৬২০ কোটি টাকা উচ্চশিক্ষার জন্য। 
অর্থাৎ স্বাস্থ্য ও শিক্ষার মতো সবচেয়ে জরুরি ক্ষেত্র দুটির সঙ্গী অবহেলাই। অথচ বিশেষজ্ঞরা বরাবর বলে আসছেন এই দুটি ক্ষেত্রকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে তার চাহিদাগুলি অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে পূরণ করতে। তাঁদের পরামর্শ, স্বাস্থ্যে বরাদ্দের পরিমাণ হতে হবে জিডিপির অন্তত ৩ শতাংশ। সেখানে সরকার এখনও বলে যাচ্ছে ২০২৫-এর মধ্যে তারা ২.৫ শতাংশ করবে। অর্থাৎ সরকারের পর সরকার বদলায় ভারতবাসীর স্বাস্থ্য ও শিক্ষা ভাগ্য বদলায় না। বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, সাফল্যের যত ফিরিস্তিই সরকার দিক না কেন, তার বাস্তব মূল্য কী! স্বাস্থ্য ও শিক্ষার ন্যূনতম দাবি পূরণ করতে হলেও আর্থিক দিকের অগ্রগতি দরকার আরও বহুগুণ। পাঁচ কেন, পৃথিবীর তিন নম্বর অর্থনীতি হয়ে উঠলেও এই চাহিদা পূরণ করা কঠিন। কারণ, ভারতই সর্বাধিক জনসংখ্যার দেশ। 
আর ভারতকে এগতে হলে জরুরি যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর সদ্ব্যবহার। এই চেতনার সবচেয়ে বড় অন্তরায় সিঙ্গল ইঞ্জিন, ডাবল ইঞ্জিন বিভাজন এবং ঘোড়া কেনাবেচার অস্ত্রে শান দিয়ে বিরোধী দল বা জোটের সরকার ফেলে দেওয়ার সর্বগ্রাসী রাজনীতি। বিরোধীদের মহাজোট ‘ইন্ডিয়া’র মুণ্ডপাত করার সময় মোদিভক্তদের প্রধান যুক্তি থাকে, কেবল বিজেপিই স্থায়ী সরকার দিতে পারে। বেশ, কিন্তু কেন্দ্রে একটি সরকার পাঁচ বা দশ বছর টিকে যাওয়াই কি সমাধান? দোর্দণ্ডপ্রতাপ বিজেপির রাজনৈতিক সংস্কৃতিই যে দেশজুড়ে অস্থিরতা জারি রেখেছে! বেছে বেছে বিরোধী সরকারগুলিকে আর্থিকভাবে বঞ্চনা করা হচ্ছে। প্রকারান্তরে আর্থিক অবরোধেরও শিকার তারা। এছাড়া জারি রয়েছে বিরোধী সরকার গায়ের জোরে ফেলে দিয়ে গেরুয়া সরকার বসিয়ে দেওয়ার হিট‍লারি মনোবৃত্তি। একটু দুর্বল বিরোধী সরকারগুলি সারাক্ষণই তাদের আয়ু নিয়ে দুশ্চিন্তায়। যে সরকার ভাবছে তার শিয়রে শমন, সে উন্নয়নের কাজটা করবে কখন? 
এই ধারার স্থায়িত্বের দুয়োই প্রাপ্য নয় কি? অতএব, কেন্দ্রে একটা স্থায়ী সরকার প্রতিষ্ঠাই যথেষ্ট নয়, আসলে দরকার কেন্দ্র এবং রাজ্যগুলির মিলিত উদ্যোগ। সেখানে কেউ রাজা বা প্রজা নয়, উভয়ের আন্তরিক জনমুখী সক্রিয়তাই শেষকথা। দেশের আর্থিক এবং সার্বিক বিকাশের ধারণাটি কোনও রাজ্য বা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলকে বাদ দিয়ে নয়। বরং সমস্ত রাজ্য এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের সাফল্যের নামই হল দেশের সাফল্য। এর বাইরে কেন্দ্র বা দেশের অস্তিত্ব কোথায়! দিকে দিকে কিছু দুর্বল, ছন্নছাড়া রাজ্য রেখে দিয়ে শক্তিশালী কেন্দ্র হয় নাকি! দেশের দুর্ভাগ্য যে, এই ভুলটাই, টানা এক দশক ধরে করে চলেছেন মোদি-শাহ জুটি। 
তার ফলে কিছু রাজ্য বাধ্য হচ্ছে কেন্দ্রীয় বঞ্চনার জবাব উন্নয়নের মাধ্যমে দিতে, একার সীমিত ক্ষমতার পূর্ণ সদ্ব্যবহারই তার হাতিয়ার। এই প্রশ্নে দেশের মধ্যে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে উঠেছে পশ্চিমবঙ্গ।   
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ২০১১ সালে রাইটার্সের দখল নেন। সেই থেকে বাংলাজুড়ে শিক্ষার উন্নয়নে দীর্ঘমেয়াদি পরিকাঠামো গড়ে তোলার কাজ চলছে। এর ফলে বেড়েছে ভালো মানের শিক্ষার সুযোগ এবং কমেছে স্কুলছুট। আটশো জুনিয়র হাইস্কুল হাইস্কুলে উন্নীত হয়েছে। দু’হাজারের বেশি হাইস্কুল উঠেছে উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে। ছাত্রসংখ্যা বৃদ্ধির কথা মাথায় রেখে তৈরি হয়েছে সাত হাজারের বেশি নতুন স্কুল ভবন এবং দুই লক্ষাধিক অতিরিক্ত ক্লাসরুম। আইসিটি কর্মসূচির অন্তর্ভুক্ত হয়েছে নয় হাজারের বেশি স্কুল। স্কুলগুলিতে শৌচাগার তৈরি হয়েছে ৬৮ হাজারের বেশি। অগ্রাধিকার পেয়েছে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুরা। বিনামূল্যে ইউনিফর্ম দেওয়া হয়েছে প্রায় ১২ কোটি। পড়ুয়ারা একইভাবে পেয়েছে পাঠ্যপুস্তকও। বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের দেওয়া হয়েছে ব্রেইল বুকস এবং স্টাইপেন্ড। এই ধরনের লক্ষাধিক ছেলেমেয়েকে এসকর্ট ভাতা এবং যাতায়াত খরচও দেওয়া হয়ে থাকে। ‘তরুণের স্বপ্ন’ প্রকল্পের অধীনে স্কুল ও মাদ্রাসা পড়ুয়াদের ই-লার্নিংয়ের জন্য ট্যাব অথবা স্মার্টফোন কিনতে প্রত্যেককে দেওয়া হচ্ছে দশ হাজার টাকা। এই স্কিমে ইতিমধ্যেই প্রায় পৌনে চার কোটি পড়ুয়া উপকৃত হয়েছে। মিড-ডে মিল পাচ্ছে প্রায় সওয়া এক কোটি বাচ্চা। 
নবান্নের হাত উচ্চশিক্ষার প্রতিও দরাজ। ১২ বছরে রাজ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ১২ থেকে বেড়ে ৪২ হয়েছে। এইসময়ে গড়া হয়েছে ৫২টি নতুন ডিগ্রি কলেজ। তার ফলে ২০১০-১১ সালের (১৩.২৪ লক্ষ) তুলনায় উচ্চশিক্ষার সুযোগ অনেকটাই বেড়েছে (২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষে ২৭.১৪ লক্ষ)। দেওয়া হচ্ছে স্বামী বিবেকানন্দের নামে মেধা বৃত্তি। গত অর্থবর্ষে সাড়ে নয় লক্ষাধিক ছাত্র দেড় হাজার কোটি টাকার বিবেকানন্দ মেরিট কাম মিনস স্কলারশিপ পেয়েছে। 
মেয়েদের ক্ষমতায়নের অনবদ্য প্রকল্প ‘কন্যাশ্রী’ ইতিমধ্যেই এক দশক পূর্ণ করেছে। প্রায় ৮৬ লক্ষ ছাত্রী এর বেনিফিট নিয়ে এগিয়ে চলেছে তাদের জীবনের পথে। নতুন বাজেটে এই খাতে বরাদ্দ করা হয়েছে ১,৩৭৪ কোটি টাকা। চলছে সবুজসাথীও, তাতে বরাদ্দের পরিমাণ ৫১৫ কোটি টাকা প্রায়। মেয়েদের উচ্চশিক্ষায় এগিয়ে দিতে রয়েছে কন্যাশ্রী-৩ প্রকল্প। গত অর্থবর্ষে প্রায় ৪৩ হাজার ছাত্রী কন্যাশ্রী-৩ প্রকল্পের সুবিধা পেয়েছেন। এছাড়া স্কলারশিপের জন্য আবেদন জমা পড়েছে প্রায় ৩০ হাজার। পশ্চিমবঙ্গে বসবাসকারী শিক্ষার্থীদের দেশে, এমনকী বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়েও উচ্চশিক্ষার জন্য স্টুডেন্ট ক্রেডিট কার্ড স্কিমে নামমাত্র সুদে দশ লক্ষ টাকা পর্যন্ত শিক্ষাঋণ দেওয়া হয়। ইতিমধ্যে ৬২ হাজারের বেশি ছাত্রছাত্রীকে মোট দু’হাজার কোটি টাকার বেশি ঋণ মঞ্জুর করা হয়েছে। 
কারিগরি শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা উন্নয়নেও অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছে এই সরকার। চলছে ‘উৎকর্ষ বাংলা’ এবং ‘আমার কর্মদিশা’ নামে দুটি অনবদ্য কর্মসূচি। বিভিন্ন স্তরের গ্রন্থাগারে বেকার যুবক-যুবতীদের জন্য রাজ্য সরকার চালাচ্ছে কেরিয়ার গাইডেন্স সেন্টার। 
আগামী অর্থবর্ষের জন্য চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য ৮ ফেব্রুয়ারি যে বাজেট পেশ করেছেন তাতে স্কুলশিক্ষার জন্য বরাদ্দ হয়েছে প্রায় ৩৮,২৪২ কোটি টাকা। উচ্চশিক্ষায় বরাদ্দের পরিমাণ ৬,৪০১ কোটি টাকার বেশি। সংখ্যালঘু ও মাদ্রাসা শিক্ষার জন্য বরাদ্দের পরিমাণ ৫,৫৩১ কোটি টাকা প্রায়। এছাড়া কারিগরি শিক্ষা (১,৩৭৮ কোটি) এবং জনশিক্ষা প্রসারেও (৪০৪ কোটি) ভালো টাকা ধরা হয়েছে। আরও একটি জিনিস মাথায় রাখা দরকার—খাদ্য, নারী ও শিশু কল্যাণ, গ্রাম ও নগর উন্নয়ন, এসসি/এসটি/ওবিসি কল্যাণ, সুন্দরবন, জঙ্গলমহল, উত্তরবঙ্গ প্রভৃতি অঞ্চলের উন্নয়ন খাতেও এই সরকার যে বিপুল অর্থ খরচ করবে, নানাভাবে সেসবেরও বেনিফিট পৌঁছে যাবে শিক্ষাক্ষেত্র পর্যন্ত। মায়েদের হাতে টাকা গেলে তার অনেকটা ছেলেমেয়েদের শিক্ষাতেও খরচ হয়। তাই লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের একাংশ যে শিক্ষাখাতেও খরচ হচ্ছে তাতে সন্দেহ কী।    
***
সমস্ত প্রকল্পের সুবিধা উদ্দিষ্ট মানুষগুলিকেই প্রদান নিশ্চিত করতে একটু সতর্ক হওয়াও জরুরি। চুরি দুর্নীতি অস্বচ্ছতার যেসব অভিযোগ উঠেছে, সেগুলি যাতে আর কোনওভাবেই না-ওঠে সেটা দেখা চাই। স্কুলে ঢুকে শিক্ষক নিগ্রহের‌ মতো জঘন্য অপরাধে লাগাম টানা জরুরি। ভোট বা রাজনৈতিক কাজে শিক্ষকদের দিনের পর দিন টানাহেঁচড়াটাও কমুক। পরীক্ষা কেন্দ্রের পাশে তাজা বোমা পড়ে থাকার খবরে পরীক্ষার্থীদের যেন আর আতঙ্কিত হতে না-হয়। পরীক্ষার হলে টোকাটুকি এই প্রজন্মও কি বন্ধ করতে পারবে না? মা সরস্বতীর কাছে প্রার্থনা, বাঙালিকে প্রকৃত শিক্ষিত করে তোলো, তাহলে কুকথার স্রোতেও একটা বাঁধ পড়বে নিশ্চয় আগামী দিনে। 
5Months ago
কলকাতা
রাজ্য
দেশ
বিদেশ
খেলা
বিনোদন
ব্ল্যাকবোর্ড
শরীর ও স্বাস্থ্য
সিনেমা
প্রচ্ছদ নিবন্ধ
আজকের দিনে
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
mesh

পারিবারিক অশান্তির অবসানে গৃহ সুখ ও শান্তি বাড়বে। প্রেমের ক্ষেত্রে শুভ। কর্মে উন্নতি। উপার্জন বৃদ্ধি।...

বিশদ...

এখনকার দর
ক্রয়মূল্যবিক্রয়মূল্য
ডলার৮৩.২৬ টাকা৮৪.৩৫ টাকা
পাউন্ড১০৬.৪৬ টাকা১০৯.১২ টাকা
ইউরো৮৯.৭৬ টাকা৯২.২০ টাকা
[ স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া থেকে পাওয়া দর ]
*১০ লক্ষ টাকা কম লেনদেনের ক্ষেত্রে
দিন পঞ্জিকা