বিশেষ নিবন্ধ

চল্লিশ বছর: একটি সত্যি রূপকথা
সমৃদ্ধ দত্ত

কৃষ্ণনগর থেকে বাসে  কয়েক ঘণ্টার জার্নির পর করিমপুর। তারপর সেখান থেকে শিকারপুর। এবার যেতে হবে ভ্যানে চরমেঘনা। ভারতীয় গ্রামের অনেক জমি বাংলাদেশের এলাকা দিয়ে ঘেরা অংশে পড়ে গিয়েছে। যে ভূমিকে বলা হয় ছিটমহল। ফেন্সিং শুরু হয়েছে। আর যেখানে সীমান্তে সেই ফেন্সিং হয়ে গিয়েছে, সেখানে দিনের দুটি নির্দিষ্ট সময়ে ওই জমিতে যাওয়া এবং সেখান থেকে ফেরার সুযোগ মিলবে। অর্থাৎ ওই দুবার মাত্র ফেন্সিং এর গেট খুলবে। এ এক মহাসমস্যা। 
সকালে সারাদিনের মতো খাবারদাবার চাষের সরঞ্জাম নিয়ে এই ভারতীয় এলাকার কৃষকদের চলে যেতে হয় নিজের জমিতে ওই ঩গেট পেরিয়ে বাংলাদেশের দিকে নিজেদের জমিতে  চাষ করতে। আবার বিকেলে চারটের সময় গেট খুলবে। তার মধ্যে চাষ সেরে ফিরতে হয়। অর্থাৎ নিজের জমিতে যখন তখন যে যাওয়া যাবে এমন নয়। বিএসএফ হেনস্তা করে। আবার বি ডি আরের পক্ষ থেকে হুমকি। এই সংবাদ সংগ্রহের জন্য যেতে হয়েছিল ওই চরমেঘনা অঞ্চলে। ১৯৯৪।  
গেট পেরিয়ে চাষ করতে যাওয়ার আগে এক 
যুবক কৃষক বলেছিলেন, আমার বাবার সঙ্গে ডোমকলে একবার দেখা হয়েছিল বরুণবাবুর। মুক্তিযুদ্ধের টাইমে। দু একটা কথা নাকি জেনেছিলেন এসব এলাকার সম্পর্কে। সেই থেকে বাবা ওনার ভক্ত। খবরের কাগজ তো নিয়মিত কেনা হয় না। তবে 
বাবার আজও একটা অভ্যাস হল তেহট্টে গিয়ে একটা পুরনো কাগজ নেওয়ার দোকানে  বেছে বেছে ওনার লেখা যেদিন  থাকে, সেগুলো সস্তায় কিনে আনা। সেই থেকে পড়া হয়।
করিমপুরেরই একটি গ্রামের মানুষ বলেছিলেন, তাঁদের গ্রামের বেশিরভাগ ছেলেপিলের নাম ‘বনমালী’, ‘জঙ্গোলি’, ‘পথিক’ ইত্যাদি। কেন? কারণ নিকটবর্তী প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র কিছুটা দূর গ্রাম থেকে। আর প্রসবযন্ত্রণা না উঠলেও আগে থেকেই হাসপাতালে গিয়ে ভর্তি হয়ে থাকা এবং সময়মতো সন্তান হওয়া, এরকম শহুরে ব্যবস্থার সঙ্গে প্রত্যন্ত গ্রামবাসী তেমন পরিচিত নয়। তাই প্রসবযন্ত্রণার আভাস পেলে তখনই হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া দস্তুর। কিন্তু সমস্যা হল, রাস্তা খারাপ। 
এত খারাপ যে ভ্যানে করে যেতে  প্রচুর দেরি হয়। আর জঙ্গল কিংবা পথেই সন্তানের জন্ম হয়। তাই ওরকম নাম।  ব্লক মেডিকেল অফিসার অফ হেলথ দুঃখিত মুখে বলেছিলেন, একটা কাজ করতে পারেন? বরুণবাবুকে বলুন এই সমস্যাটা নিয়ে কিছু কড়া করে লিখতে। তাহলেই কাজ হবে। মানুষ জানবে। সরকারও গুরুত্ব দেবে। 
হাওড়ার গাদিয়াড়া বিখ্যাত ভ্রমণস্থল। কিন্তু নয়ের দশকে বেড়ে গিয়েছিল নদীভাঙনের সমস্যা। সেই নদীভাঙনের ফলে কীভাবে গ্রাম, জমি নদীগর্ভে চলে যাচ্ছে  দেখে রিপোর্ট নিয়ে ফেরার সময় বাসে চেপে শ্যামপুর যাওয়ার রাস্তার সংযোগস্থলে একটি পথচলতি হোটেলে দুপুরের খাওয়ার জন্য বাসযাত্রীরা ঢুকছিলেন। শ্যামপুরের এক মাস্টারমশাই বলেছিলেন, বাগনান স্টেশনে হকারদের মধ্যে প্রতি সপ্তাহের একটি বিশেষ দিনে মারামারি, ঢিল ছোঁড়াছুঁড়ি হতো জানেন তো? কারণ, ওইদিন বরুণ সেনগুপ্তের সাপ্তাহিক কলাম থাকত। কারা বেশি কাগজ নেবে সেই লড়াই। সেদিন প্রচণ্ড চাহিদা থাকত কাগজের। মনে পড়ে একই কথা বলেছিলেন এক বাগনান নিবাসী পরিচিত বন্ধু তাঁর বাবার স্মৃতিচারণ শুনিয়ে। বলেছিলেন, আমি শুনেছি পুলিসও দিতে হতো মাঝেমধ্যে যাতে ভোরবেলা ওই বিশেষ দিনে স্টেশনে ওরকম ঠেকাতে। একজন  সাংবাদিক কতটা জনপ্রিয় হলে এই ঘটনা ঘটতে পারে?  
বিশ্বের সবথেকে বড় এবং ঝাঁ চকচকে মন্দির তৈরি হচ্ছে মায়াপুর ইসকনে। সেই মন্দিরের উদ্বোধন পর্বে হাজির হবেন  ইসকনের ভক্ত বিশ্ববিখ্যাত ফোর্ড কোম্পানির মালিক হেনরি ফোর্ডের নাতি আলফ্রেড ফোর্ড।  তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে সাক্ষাৎকার নিতে হবে। মায়াপুরে সেদিন হাজার হাজার মানুষ। অসংখ্য সাংবাদিক। সেখানে আলফ্রেড ফোর্ডের স্ত্রীর কাছে সবেমাত্র চাকরি পাওয়া ট্রেনি সাংবাদিকের পক্ষে যাওয়া অসম্ভব। কেন তাঁর সাক্ষাৎকার চাই? কারণ কিংবদন্তি ফোর্ড কোম্পানির মালিক আলফ্রেডের স্ত্রী বাঙালি ভট্টাচার্য পরিবারের কন্যা। শর্মিলা ভট্টাচার্য ফোর্ড। সেই সাক্ষাৎকার অনায়াসে সম্ভব হয়েছিল। কারণ, আগে থেকেই তাঁর কাছে কে সাক্ষাৎকার নেবে সেই নাম পৌঁছে দিয়েছিলেন বরুণবাবু। ঠাসা প্রোগ্রামের মধ্যেই ব্রেকফাস্ট টেবিলে শর্মিলা ফোর্ড সময় দিয়েছিলেন। 
সারের দাম কত করে যাচ্ছে? ডিপ শ্যালো টিউবওয়েলের বিদ্যুৎ খরচ কত? এবছর জ্যোতি আলুর ফলন কেমন? কোন কোন স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে  পর্যাপ্ত যাত্রী শেড নেই? ফ্যামিলি কোর্টে ঠিক কী ধরনের পারিবারিক সমস্যাগুলি আসছে? কনজিউমার কোর্টে কি আদৌ মানুষ যথাসময়ে ক্ষতিপূরণ পাচ্ছে? কত পেন্ডিং কেস? যখন তখন টানা লোডশেডিং-এর ফলে কোল্ড স্টোরেজগুলোর আর্থিক ক্ষতি কতটা? ব্যান্ডেলে রেললাইনের আন্ডারপাসে জল জমা সমস্যা দূর হল কি না। শ্যাওড়াফুলি  ফেরিঘাটে নেমে স্টেশনে আসতে সেই বাজারের মধ্যে দিয়েই আসতে হবে? কুপার্স ক্যাম্পের কতটা উন্নতি হল? নদীয়া সিপিএমের জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর বৈঠকে গত বুধবার দুজন সদস্য আসেননি কেন? 
এরকম প্রতিটি খুঁটিনাটি তিনি জেনে নিতেন ফোন করে জেলায় থাকা তাঁর সাংবাদিকদের কাছে। শুধু‌ই সংবাদ নিতেন? মোটেই নয়। কলকাতার কেন্দ্রস্থলে বসে তিনি ঠিক খবর পেতেন বিস্ফোরক তথ্য সংবলিত। এবং ভোরবেলা জানাতেন, চুঁচুড়া-চন্দননগরের কাছে একটি বিখ্যাত আমবাগান কেটে ফেলে শুনলাম প্রমোটিং হবে। খোঁ‌জ নাও তো! 
বরুণ সেনগুপ্ত সাংবাদিকতার একটি সিলেবাস তৈরি করে গিয়েছেন। বাংলাকে না জানলে, বাংলার জেলা, ব্লক, গ্রামকে না চিনলে, মফস্‌সলের মানুষের পালস না বুঝলে অর্ধেক সাংবাদিক হওয়া যায়। তাই তিনি সর্বাধিক জোর দিতেন জেলা সাংবাদিকতায়।
তিনিই পথিকৃৎ জেলার সংবাদ বেশি বেশি করে প্রকাশের। তিনি বলতেন সিভিক প্রবলেম অর্থাৎ সাধারণ মানুষ যেসব সংবাদের সঙ্গে নিজেকে একাত্ম করতে পারে, সেই সমস্যাগুলি বেশি করে জানতে হবে। চলতে ফিরতে দেখতে হবে কোন পড়ে সমস্যায় মানুষ বেশি বিরক্ত হচ্ছে। আলোচনা করছে।  
জেলা পরিষদের কর্মাধ্যক্ষ, স্থায়ী সমিতি, জেলা পরিকল্পনা বোর্ড, গ্রামসভার বৈঠক, জমির পাট্টা প্রদান কর্মসূচি এ সমস্ত কিছু জানতে হবে।  জেলা ও পঞ্চায়েত প্রশাসন জানলে তবেই শেখা যাবে যে, দিল্লিতে পেশ হওয়া বাজেট বরাদ্দ কিংবা প্রকল্পগুলি একেবারে নিচুতলায় ঠিক কীভাবে গিয়ে পৌঁছয়। পদ্ধতিটি কী? এটা জানা দরকার সাংবাদিকের। 
চাকদহে এক বালিকা দাবি করছে সে নাকি দেবযানী বণিক ছিল পূর্বজন্মে। দেবযানী বণিক মৃত্যুরহস্য একটা সময় ছিল বাংলায় অত্যন্ত চর্চিত একটি ইস্যু। সেই দেবযানী বণিক পুনর্জন্ম নিয়েছে? চাকদহের ওই পাড়ায় শোরগোল। ১৯৯৪ সাল। বরুণবাবুর কানে ওই সংবাদ গিয়েছে। তিনি বলেছিলেন, ওদের বাড়িতে গিয়ে সকলের সঙ্গে কথা বলবে। পাড়ায় কথা বলবে। নিছক জল্পনা? নাকি সত্যি জাতিস্মরের মতো ঘটনা বাস্তবে রয়েছে। খুব ভারসাম্য রাখতে হবে। বিজ্ঞান ও বিশ্বাসের মধ্যে। কোনও পক্ষপাত যেন না থাকে। আর এমনভাবে লিখবে না যে, ওই পরিবারটির কোনও ক্ষতি হয়। এরকম ছিল তাঁর শিক্ষাপদ্ধতি। 
শিল্প বাণিজ্য মন্ত্রী ছিলেন কমল নাথ। ইউপিএ সরকারের আমলে। মিডিয়াম অ্যান্ড স্মল স্কেল ইন্ডাস্ট্রির কোনও সিদ্ধান্ত সরকারি স্তরে হলে কিংবা বরাদ্দ বৃদ্ধি বা নতুন প্রকল্প হওয়ার পর একবার কমল নাথ বলেছিলেন, এটা বরুণকে জানাবে। এই স্মল স্কেল নিয়ে ওঁর আগ্রহ আছে। 
এই বিচ্ছিন্ন কথাগুলির অর্থ হল, একজন সাংবাদিকের কী আশ্চর্য সংযোগসূত্র এবং অনুসন্ধিৎসা থাকলে এরকম কিংবদন্তি হওয়া যায়, তার নিখুঁত এক উদারহণ এই ক্ষুদ্র ঘটনাপঞ্জি। সম্পাদক হয়েছেন, মালিক হয়েছেন, কিন্তু আজীবন তিনি ছিলেন অন্তর থেকে নিখুঁত সাংবাদিক। তাঁর শেষ শিক্ষা বাঙালিকে— কীভাবে এক সাধারণ মানুষের পক্ষে একটি মহীরুহ সমান প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা সম্ভব স্রেফ একনিষ্ঠ উদ্যোগে। নিখাদ বাঙালির মেধা, সমাজচেতনা ও বাণিজ্যের এক আশ্চর্য উদাহরণ। সেই প্রতিষ্ঠানের ৪০ বছর বর্ষপূর্তি হল। স্বাধীন ভারতের বাঙালি ইতিহাসে এটি যেন আর একটি সত্যি রূপকথা!
7Months ago
কলকাতা
রাজ্য
দেশ
বিদেশ
খেলা
বিনোদন
ব্ল্যাকবোর্ড
শরীর ও স্বাস্থ্য
সিনেমা
প্রচ্ছদ নিবন্ধ
আজকের দিনে
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
mesh

পারিবারিক অশান্তির অবসানে গৃহ সুখ ও শান্তি বাড়বে। প্রেমের ক্ষেত্রে শুভ। কর্মে উন্নতি। উপার্জন বৃদ্ধি।...

বিশদ...

এখনকার দর
ক্রয়মূল্যবিক্রয়মূল্য
ডলার৮৩.২৬ টাকা৮৪.৩৫ টাকা
পাউন্ড১০৬.৪৬ টাকা১০৯.১২ টাকা
ইউরো৮৯.৭৬ টাকা৯২.২০ টাকা
[ স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া থেকে পাওয়া দর ]
*১০ লক্ষ টাকা কম লেনদেনের ক্ষেত্রে
দিন পঞ্জিকা