বিশেষ নিবন্ধ

‘বিমারু’ রাজ্য নিয়ে টানাটানি, জনগণের কী আসে যায়!
হিমাংশু সিংহ

 

ভোট আসে ভোট যায়, নেতাদের ফন্দি ফিকির বাড়ে। চলে আমিত্ব আর অহংয়ের মিশেলে রকমারি প্রদর্শনী। প্রচারের রংমশালে গরিবের চোখ ধাঁধিয়ে সমর্থন জেতার প্রকাণ্ড আয়োজন। বন্যা, দুর্ভিক্ষ, প্রলয়, মহামারীতেও এত টাকার জোগান বড় একটা দেখা যায় না। এত হাজার হাজার কোটির প্রকল্প, উদ্বোধনের ফোয়ারা, হাওয়াই জাহাজের ছোটাছুটি। দামি গাড়ির রোড শো। তারপর হারজিতের ফল বেরলেই সব ফাঁকা। কেউ আর সাধারণের দিকে তাকায় না। উদ্বোধনের কত শিলায় শুধু জঙ্গল আর ধুলোই জমে যুগের পর যুগ। শুরু হয় নেতাদের কাটআউট, ব্যানারকে ছাদ করে টাঙিয়ে গরিবের দিনযাপনের বারোমাস্যা। স্বাধীনতার ৭৫ বছরে এই তো সফল জাতীয় আবাস যোজনার বিজ্ঞাপন! নেতাদের ফেলে দেওয়া বাসি মালার ঘোর লাগা গন্ধে হারিয়ে যায় আম আদমির স্বপ্ন। তার বেশি কিছু মেলে না। খাতায় কলমে এক আঁচড়ে দেশে গরিব কমে। ভোট বড় বালাই, তাই মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড়েরও উত্তরণ হয় সরকারি খাতায়। কিন্তু বাস্তব মাটিতে তার ছাপ কোথায়? নীতি আয়োগ বলছে, দেশে সাড়ে ১৩ কোটি গরিব সচ্ছল হয়েছে। কিন্তু পরিযায়ীদের স্রোত, বেকারত্বের দিনলিপিতে কই কোথাও তো ছেদ পড়ে না এতটুকু! এসব রিপোর্ট কি সত্যি গরিবি কমানোর প্রক্রিয়া, না ভোট বাজারে শাসকের বুকের ছাতি ফোলানোর এনার্জি টনিক, বোঝা দায়!
নভেম্বরজুড়ে তিন ‘বিমারু’ রাজ্যে নির্বাচন হচ্ছে। মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান ও ছত্তিশগড়। নামেই মালুম হয় রাজ্যগুলি ‘অসুস্থ’। যদিও মোদিজি দশ বছর আগে সেকথা মানলেও ইদানীং আর মানেন না। পাছে দায়ের পাটকেলটা সরাসরি তাঁর গায়ে লাগে। ওই তালিকায় নেই মিজোরাম ও তেলেঙ্গানা। ‘বিমারু’ নামটা এক বঙ্গসন্তানের দেওয়া। আজ থেকে প্রায় সাড়ে চার দশক আগে রাজীব গান্ধীর নির্দেশে তৈরি করা এক সমীক্ষায় বঙ্গসন্তান আশিস বসু মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান, উত্তরপ্রদেশ সহ পাঁচ রাজ্যকে ওই পংক্তিতে ফেলেন। আশিসবাবুর পরিচয় দেশের শ্রেষ্ঠ জনবিন্যাস বিশ্লেষক ও অর্থনীতির বিশেষজ্ঞ হিসেবে। রাজীব গান্ধীর নির্দেশেই একদল বিশেষজ্ঞ দেশঘুরে  কোন কোন রাজ্য আর্থিকভাবে পিছিয়ে, তার বিস্তারিত খতিয়ান তৈরি করেন। সেই দলে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংও ছিলেন। কিন্তু আশিসবাবু ছিলেন সমীক্ষার মূল দায়িত্বে। পরবর্তীকালে ওই রিপোর্টের সুপারিশ মেনেই গরিবি হটাতে দেশে ১০০ দিনের কাজ চালু হয়। মনমোহন সিংয়ের নেতৃত্বে ইউপিএ সরকারের আমলে ২০০৫ সালে। মহাত্মা গান্ধী ন্যাশনাল রুরাল এমপ্লয়মেন্ট গ্যারান্টি স্কিম সংক্ষেপে নারেগা। গত দু’বছর ওই প্রকল্পের হাজার হাজার কোটি টাকা আটকেই বাংলাকে ভাতে মারার চক্রান্ত চলছে মোদি সরকারের তরফে।
আগেই বলেছি, ‘বিমারু’ শব্দের অর্থ অসুস্থ। এক্ষেত্রে ওই নামকরণের কারণ এই রাজ্যগুলি অর্থনীতি, শিক্ষা, শিশু মৃত্যু, প্রসূতির স্বাস্থ্য, পুষ্টি, মাথাপিছু আয়ের নিরিখে পিছিয়ে। তারপর অনেকটা সময় কেটে গিয়েছে। ওই তালিকায় মধ্যপ্রদেশ ভেঙে তৈরি হওয়া ছত্তিশগড়ও ঢুকেছে ২০০০ সালের ১ নভেম্বর। ছত্তিশগড়ের বয়সও আজ নয় নয় করে ২৩ বছর। ‘বিমারু’ নামকরণ যিনি করেছিলেন, সেই বঙ্গসন্তানও মারা গিয়েছেন মোদির উদয়ের বছরে, ২০১৪ সালে। কিন্তু বিমারুর ছায়া আজও তাড়া করছে তিন ভোটযুদ্ধে অবতীর্ণ রাজ্য ও তার শাসককুলকে। তা সত্ত্বেও সাম্প্রতিক নির্বাচনের উচ্চকিত প্রচারে কোথাও এই পিছিয়ে পড়ার ছাপ পড়তে দেখছেন। সরকার ও বিরোধী কারোর এনিয়ে মাথাব্যথা আছে বলে মনে হচ্ছে? মধ্যপ্রদেশে দীর্ঘসময় বিজেপি শাসন করেছে। রাজস্থানেও একটানা না-হলেও মধ্যিখানে অনেকটা সময় গেরুয়া শাসন কায়েম ছিল। কিন্তু কিছু উন্নতি হলেও অর্থনৈতিক দিক দিয়ে পিছিয়ে পড়ার তকমা কি সত্যি ঘুচেছে? সব সরিয়ে আমার মতো বাজারি কলমচিরও একটাই প্রশ্ন, কে জিতবে ইন্ডিয়া জোট না মোদির বিজেপি? কে কত আসন পাবে? মানুষ নয়, উন্নয়ন নয়, গণতন্ত্রে শেষ কথা কি তবে বলে স্রেফ পাটিগণিত!
আসলে মূল্যবৃদ্ধি, দারিদ্র্য এবং কর্মসংস্থান নিয়ে যত সরকারি হিসেব প্রকাশিত হয় তার নব্বই ভাগই বড্ড গোলমেলে। কানে বাঁশির সুর শোনা গেলেও চোখে দেখা যায় না। চাকরি মেলা, ঋণ মেলার ঢাক বাজতেই থাকে উচ্চগ্রামে। তবু বেকারের সংখ্যা লাফিয়ে বাড়ে কোন রসায়নে। চম্বলে আজও কেন বাহুবলীরাই শেষ কথা বলে? প্রচারে বেরিয়ে প্রধানমন্ত্রী আগ বাড়িয়ে বলেছেন, মধ্যপ্রদেশ আর পিছিয়ে পড়া রাজ্য নয়। বিজেপি নাকি তাকে উন্নয়নের আলোয় ভাসিয়ে দিয়েছে। তাঁর কথায়, বিজেপির জন্যই ঘুচেছে ‘বিমারু’ কলঙ্ক। কংগ্রেস এলে আবার সেই অভিশাপই নাকি চেপে বসবে। কিন্তু দেশের ‘সবচেয়ে সাহসী’ প্রধানমন্ত্রী সত্যিটা বললেন কি? সরকারের সাম্প্রতিক পরিসংখ্যানই তো উল্টো কথা বলছে। এখনও রাজস্থান, ছত্তিশগড়, মধ্যপ্রদেশে সবকা সাথ সবকা বিকাশের তেমন কোনও ছাপ নেই। শিশুমৃত্যু, মায়ের স্বাস্থ্য ও পুষ্টি নিয়ে যে রিপোর্ট নীতি আয়োগ দু’বছর আগে প্রকাশ করেছে তাতে উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান ও ছত্তিশগড় এখনও পিছিয়ে। তাহলে মোদিজির ডাবল ইঞ্জিনের মাহাত্ম্য কোথায়? স্রেফ বিরোধীদের দল ভাঙায়!
যে তিন রাজ্য দখলের জন্য সীমান্তে পাকিস্তানের উগ্রপন্থীদের চেয়েও আমাদের রাজনৈতিক দলগুলি মরিয়া, তাদের এসবে কোনও ভ্রুক্ষেপই নেই। সেখানকার মানুষের দৈনন্দিন সমস্যা, গরিবি, শিক্ষা, সামাজিক অবস্থান ও কর্মসংস্থান নিয়ে কটা কথা বলতে শুনছেন নেতাদের। মধ্যপ্রদেশ ও ছত্তিশগড়ে এখনও নকশাল সমস্যা মেটার কোনও লক্ষণ নেই। এর মূল কারণও সেই অনুন্নয়ন। চম্বলে এখনও আইন নয়, দিনেদুপুরে চলে বন্দুকের শাসন। পুলিস, প্রশাসন নয়, ডাকাতরাই অস্ত্র উঁচিয়ে শেষকথা বলে। প্রতিটি রাজনৈতিক দলই বাহুবলীদের মন জুগিয়ে চলে। মাঝেমাঝে খবর আসে সুকমায় বিস্ফোরণে প্রাণ গিয়েছে এক ডজন সশস্ত্র জওয়ানের। আমরা খবর লিখি। কিন্তু কী কারণে দুষ্কৃতীদের আজও এই  বাড়বাড়ন্ত, খুঁজে দেখি কই? তলিয়ে দেখলে উত্তর একটাই—গরিবি ও অশিক্ষা, খাদ্যের অভাব। তার ফায়দা লোটে শাসক থেকে বিরোধী সবাই। সরকার আসে সরকার যায়। প্রতিশ্রুতির ফোয়ারা ছোটে, কিন্তু মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড় ও রাজস্থান ‘বিমারু’ রাজ্য হয়েই থেকে যায় যুগ যুগ ধরে। বলা বাহুল্য, নেতারাই এযুগে সবচেয়ে বড় অঙ্ক বিশারদ। লোকসভা ভোটে ২৭২ আসন জয়ের ম্যাজিক ফিগার দখলের মরিয়া চেষ্টায় তাই গরিব বড়লোক খুব একটা ইতরবিশেষ হয় না। উত্তর-পূর্বের হোক কিংবা বিমারু রাজ্য, উন্নয়ন না পৌঁছলেও ভোটের দপদপানি ষোলো আনা ছড়িয়ে পড়ে। কেউ বলে সেমি ফাইনাল, কেউ বলে ফাইনাল। কিন্তু চম্বলের মানুষ জানে, সুকমার আদিবাসীরা জানে তাদের ভবিতব্য কি? ভোট মিটলেই আবার সেই অন্ধকারেই।
ভোট যেখানে চোখে ঠুলি পড়িয়ে নীচ স্বার্থপর হতে শেখায়, সেখানে  কুকথার স্রোত অনিবার্য পরিণতি। শিক্ষা যেখানে দুর্বল, সেখানে গরিব মানুষকে বিভ্রান্ত করার কৌশলেরও অভাব নেই। বিজেপির বিতর্কিত এমপি রমেশ বিধুরি আগেও অনেক বিতর্কিত কথা বলে বাজার গরম করেছেন। বিজেপি নেতৃত্ব ব্যবস্থা নেয়নি। কারণ, এমন লোকেরই মেঠো অশিক্ষিত রাজনীতিতে আজ কদর। বিভাজন ও মেরুকরণের তাস খেলতে এঁদেরই প্রয়োজন সর্বাগ্রে। রাজস্থানের টঙ্ক আসনটির এবার বাড়তি গুরুত্ব। সেখানে কংগ্রেস প্রার্থী শচীন পাইলট। জ্যোতিরাদিত্যকে দিয়ে মধ্যপ্রদেশ দখলের পর শচীন পাইলটের দিকেই হাত বাড়িয়েছিল মোদি-অমিত শাহরা, কিন্তু রাজস্থানে অপারেশন লোটাস ব্যর্থ হয়েছে। হাজার টানাপোড়েনের পরও পাইলট কিন্তু সিন্ধিয়ার পদাঙ্ক অনুসরণ করেননি। উল্টে এবার ভয়ঙ্কর চাপে পড়ে গিয়েছেন জ্যোতিরাদিত্যই। পরাজয়ের হাতছানি শুধু নয়, গদি হারালে জ্যোতিরাদিত্যের পিঠে বিশ্বাসঘাতকতার কলঙ্ক আরও বেশি করে চেপে বসবে। কৌলীন্য হারাবে সিন্ধিয়া পরিবার। আবার মধ্যপ্রদেশে বিজেপি জিতলেও কি এবার জ্যোতিরাদিত্য মুখ্যমন্ত্রী হবেন? এখনও পর্যন্ত যা ইঙ্গিত, তা মোটেই তাঁর পক্ষে নয়। সাতজন বিজেপি এমপি মধ্যপ্রদেশ দখলের লড়াইয়ে নেমেছেন মোদিজির নির্দেশে। তার মধ্যে তিনজন কেন্দ্রের মন্ত্রী। তবে  মামাজি শিবরাজের সঙ্গে কাঁটে কা টক্কর চলছে আর এক নরেন্দ্রর। মোদি নন, তিনি নরেন্দ্র সিং তোমার। চম্বলের কঠিন আসনে এবার গেরুয়া প্রার্থী। জেতা কঠিন, তবে শিকে ছিঁড়লে এবং বিজেপি মধ্যপ্রদেশে সরকার গড়লে মুখ্যমন্ত্রীর দৌড়ে তিনি না মামাজি, তা এখনও অজানা। তবে একটা অদৃশ্য সুতোর লড়াই কিন্তু চলছেই। সেই যুদ্ধটা উল্টোদিকের গেহলট-কমল নাথ-দিগ্বিজয়দের চেয়ে কম টানটান নয়।
একই অবস্থা রাজস্থানেও। এবারের লড়াইয়ে বসুন্ধরা মোটেই গেরুয়া শিবিরের মুখ নন, দিয়া কুমারীও নন। মুখ খুঁজতে ভুলভুলাইয়ায় মাথা কুটে মরছে স্থানীয় বিজেপি নেতৃত্ব। ‘ডিমিনিশিং রিটার্ন’ বলে একটা কথা আছে, মোদির মুখ আর মুখোশকে বুকে করে আর কত ভোট বৈতরণী পার করবে বিজেপি ও তার থিঙ্কট্যাঙ্ক আরএসএস। কংগ্রেস যদি একটা পরিবারের হাতে বন্দি হয়ে থাকে, এই দলটাও তো একটা ব্যক্তিত্বের শিকলে বাঁধা! ভবিষ্যতে তাদেরও এর মাশুল গুনতে হবে সুদে-আসলে। এক রেশন কার্ড, এক নির্বাচনের পর একজন ব্যক্তিই যদি ভারতের মতো বৈচিত্র্যে ভরা দেশে বিজেপির ট্রেড মার্ক হন, তা মোটেই বাজপেয়ি-আদবানিদের দলের পক্ষে খুব একটা গৌরবের হবে না। পরিবারতন্ত্রের মতো ব্যক্তিতন্ত্রও গণতন্ত্রে ষোলোআনা পরিত্যাজ্য।
তবে এই কঠিন সেমি ফাইনালে অন্তত দু’টি রাজ্যেও যদি কেঁদে ককিয়ে শিকে ছেঁড়ে, কিংবা দল ভাঙিয়ে পিছনের দরজা দিয়ে গেরুয়া বাহিনী সরকার গড়তে পারে, তাহলে লোকসভা ভোট যে এগিয়ে আসবে, তা নিশ্চিত। ২২ জানুয়ারি অযোধ্যায় রামমন্দির উদ্বোধনের পরপরই স্বশাসিত মহামান্য নির্বাচন কমিশন ‘মোদির নির্দেশে’ লোকসভা ভোটের ঘোষণা করতে পারে।
নতুন বছরের শুরুতে তাই পরতে পরতে নাটক অপেক্ষা করছে। কে জিতবে ‘ইন্ডিয়া’  না ‘ভারত’, তা সময় বলবে। তবে এটা নিঃসন্দেহে বলা যায় পাটিগণিত জিতলেও জনগণের অবস্থার খুব একটা পরিবর্তন হবে না। সাধারণ মানুষ আবার সেই তিমিরেই। মূল্যবোধ, মানবিকতা, সততার মতো ক্লিশে শব্দগুলো আজকের রাজনীতিতে ব্রাত্য।
8Months ago
কলকাতা
রাজ্য
দেশ
বিদেশ
খেলা
বিনোদন
ব্ল্যাকবোর্ড
শরীর ও স্বাস্থ্য
সিনেমা
প্রচ্ছদ নিবন্ধ
আজকের দিনে
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
mesh

পারিবারিক অশান্তির অবসানে গৃহ সুখ ও শান্তি বাড়বে। প্রেমের ক্ষেত্রে শুভ। কর্মে উন্নতি। উপার্জন বৃদ্ধি।...

বিশদ...

এখনকার দর
ক্রয়মূল্যবিক্রয়মূল্য
ডলার৮৩.২৬ টাকা৮৪.৩৫ টাকা
পাউন্ড১০৬.৪৬ টাকা১০৯.১২ টাকা
ইউরো৮৯.৭৬ টাকা৯২.২০ টাকা
[ স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া থেকে পাওয়া দর ]
*১০ লক্ষ টাকা কম লেনদেনের ক্ষেত্রে
দিন পঞ্জিকা