বিশেষ নিবন্ধ

চিচিং ফাঁক: এ কেমন চৌকিদার?
তন্ময় মল্লিক

তমলুক শহরের ধারিন্দার বাসিন্দা সোমনাথ দাস একজন কাঠমিস্ত্রি। কোনও রকমে সংসার চলে। ক্যান্সার ধরা পড়েছে তাঁর দু’বছরের মেয়ের। কী করে মেয়ের চিকিৎসার খরচ জোগাবেন, সেই চিন্তায় রাতের ঘুম উবে গিয়েছে। সম্বল বলতে ব্যাঙ্কে জমানো অল্প কিছু টাকা। সেই অবস্থায় মোবাইলে আসে ফোন। প্যান ও আধার নম্বর না জানালে বন্ধ হয়ে যাবে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট। এমনিতেই মেয়ের চিন্তায় মাথার ঠিক নেই। তার উপর অ্যাকাউন্ট বন্ধের হুমকি। অগত্যা দু’টি নম্বরই দিয়ে দেন। পরে ব্যাঙ্কের পাসবই আপডেট করতে গিয়ে দেখেন, ২৫ হাজার টাকা তুলে নিয়েছে। থানায় অভিযোগ জানিয়েছেন।
কালনার সাহাপুর কালীতলার বিশাখা দেবনাথের স্বামী অসুস্থ। রোজগারের রাস্তা বন্ধ। তাই সংসারের তেষ্টা মেটানোর জন্য ‘ঘটির জল’ই ভরসা। অসময়ে কাজে লাগবে ভেবে লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের টাকায় হাত দিতেন না। ব্যাঙ্কের টাকায় ক’দিন চলবে জানার জন্য পাসবই আপডেট করতে যান। সেখানে গিয়ে শোনেন, ১৮দিন আগে সিএসপি(কাস্টমার সার্ভিস পয়েন্ট) থেকে সাড়ে সাত হাজার টাকা তুলে নেওয়া হয়েছে। না, তিনি কাউকে ওটিপি দেননি। তাঁর একটাই দোষ, তিনি সরকারের নির্দেশ মেনে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের সঙ্গে আধার ও প্যানকার্ড লিঙ্ক করিয়েছিলেন। ‘ব্যাঙের আধুলি’ও সাইবার অপরাধীদের থাবা থেকে রেহাই পাচ্ছে না।
শুধু লেখাপড়া না জানা বা অল্পশিক্ষিতরাই নয়, উচ্চ শিক্ষিতদেরও অ্যাকাউন্ট সাফ করে দিচ্ছে টাকা চোররা। খড়্গপুর আইআইটির অধ্যাপক অনাথবন্ধু পাত্র স্নায়ু ও হৃদরোগে ভুগছেন। তিনি অনলাইনে কলকাতার একটি বেসরকারি হাসপাতালের ওয়েবসাইট দেখে ফোন নম্বর পান। সেই নম্বরে ফোন করলে নাম নথিভুক্ত করার জন্য অনলাইনে পাঁচ টাকা পাঠাতে বলে। সেই টাকা পাঠানোর পর তাঁর দু’টি অ্যাকাউন্ট থেকে চার দফায় প্রায় ১ লক্ষ ২৫ হাজার টাকা হাওয়া।
কাটোয়ার মাধবীতলার প্রসেনজিৎ দত্ত খুইয়েছেন ২ লক্ষ ৫৪ হাজার টাকা। তমলুকের এক যুবক খুইয়েছেন ১৭ লক্ষ টাকা। তবে তাঁকে প্রেমের ফাঁদে ফাঁসিয়েছিল সাইবার অপরাধীরা। 
প্রতারণার এরকম অজস্র ঘটনা দেশজুড়ে ঘটে চলছে। প্রতারকরা নিত্যনতুন ফাঁদ তৈরি করছে। তাতে পা দিলেই সর্বনাশ। খালি হয়ে যাচ্ছে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট। দেশজুড়ে এই অপরাধ সংগঠিত হলেও সংখ্যাটা আপাতত বাংলা ও মহারাষ্ট্রেই বেশি। গোয়েন্দারা জানতে পেরেছে, উত্তর দিনাজপুর থেকে উত্তর ২৪ পরগনা, হাওড়া থেকে ঝাড়গ্রাম এরাজ্যের ১০টি জেলায় সাইবার অপরাধীরা জাঁকিয়ে কারবার চালাচ্ছে। সাধারণ মানুষকে ফাঁদে ফেলে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে।
কিন্তু কেন এই পরিস্থিতি হল? আগে মানুষ চোর-ডাকাতদের ভয়ে টাকা, সোনা ঘরের মেঝেয়, দেওয়ালে গর্ত করে হাঁড়ির মধ্যে রেখে দিত। ডাকাতরা গৃহস্থকে মারধর করে গর্ত খুঁড়িয়ে সেসব লুট করত। ফলে অবস্থাপন্নরা রাত হলেই ডাকাতির আতঙ্কে ভুগত। ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থা চালু হওয়ায় মানুষ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিল। ইন্দিরা গান্ধী ব্যাঙ্ক রাষ্ট্রায়ত্তকরণ করায় দেশবাসী আরও নিশ্চিন্ত হয়েছিল। তারপর চালু হল লকার। বাড়ির সোনার গয়না ঢুকে গেল ব্যাঙ্কের সুরক্ষিত ভল্টে। 
ব্যাঙ্ক যখন ছিল না তখন আতঙ্ক ছিল কেবল রাতটুকুর। ভোরের আলো ফুটলেই সেই ভয় দূর হতো। ‘ডিজিটাল ইন্ডিয়া’র চক্করে পড়ে আতঙ্ক হয়ে গেল দিনরাতের। কিন্তু ব্যাঙ্কের সুরক্ষিত টাকা কেন আজ অরক্ষিত? কেন মানুষ ব্যাঙ্কে টাকা রেখেও নিশ্চিন্তে থাকতে পারছে না? 
এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী কে? অনেকে কেন্দ্রীয় সরকারের নীতিকেই দায়ী করছেন। তাঁদের মতে, গিমিকের রাজনীতির সুপারস্টার নরেন্দ্র মোদি প্রথমে নোটবন্দি করলেন। অনেক কালো টাকা নিয়ে অনেক বড় বড় কথা বললেন। কিন্তু মানুষের কোনও লাভ হল না। তারপরই সরকার দেশের মানুষকে ডিজিটাল লেনদেনে উৎসাহিত করা হল। বলা হল, অনলাইনই আগামীর ভবিষ্যৎ।
মোদিজি খুব ভালো করেই জানেন, ‘কালা ধনে’র উপর সাধারণ মানুষের প্রচণ্ড রাগ। বিশেষ করে গরিবগুর্বোদের। দেশে তাঁরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। তাই যখনই মানুষকে নিজের স্কিম খাওয়াতে চান তখনই তিনি ‘কালো টাকা’ নামক কুমিরের ছানাটিকে সামনে আনেন। ২০১৪ সালে সুইস ব্যাঙ্কের ‘কালা ধন’ ফিরিয়ে আনার গল্প শুনিয়েই তিনি নির্বাচনে বাজিমাত করেছিলেন। কালো টাকা ফেরানো, ব্যাঙ্কের হাজার হাজার কোটি টাকা শোধ না করে বিদেশে পালিয়ে যাওয়া মেহুল চেকসি, নীরব মোদিদের দেশে ফিরিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু পারেননি। পারবেনও না। তাই তিনি ব্রতী হলেন দেশের অন্দরে ‘কালো টাকা’ দমনে। বের করা হল নতুন রাস্তাও। ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের সঙ্গে যুক্ত করতে হবে আধারকার্ড। 
মানুষ প্রভাবিত হয় ‘টোপে’ আর ‘চাপে’। এটা ‘বেওসায়ি’ বিজেপি নেতৃত্ব সবচেয়ে ভালো বোঝে। শুধু মুখের কথায় মানুষ ব্যাঙ্কের সঙ্গে আধারকার্ড যুক্ত করতে চাইবে না। তাই দেওয়া হল গ্যাসের ভর্তুকির টোপ। সরকার জানিয়ে দিল, ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের সঙ্গে আধারকার্ড যুক্ত না করলে গ্যাসের ভর্তুকি মিলবে না। সেই সময় সিলিন্ডার পিছু ভর্তুকির পরিমাণটা ছিল ২০০ টাকার বেশি। এখনকার মতো পিঁপড়ের পিছন টিপে ১৯ টাকা দিত না। এই ঘোষণামাত্র ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের সঙ্গে আধারকার্ড লিঙ্ক করার ধুম পড়ে গেল। 
তারপর এল আধারের সঙ্গে প্যানকার্ড যুক্ত করার ফরমান। এক্ষেত্রেও সরকার সেই ‘কুমিরের ছানা’ কালো টাকা। বলা হল, উভয় কার্ডের মধ্যে লিঙ্ক হলেই সরকার বুঝে যাবে, একজনের কতগুলো অ্যাকাউন্ট আছে। তাতেই জানা যাবে, জমা টাকার পরিমাণ কত? ফলে কেউ আর ‘কালা ধন’ লুকিয়ে রাখতে পারবে না।
তবে, প্যান ও আধার কার্ড লিঙ্ক করানোর জন্য বেঁধে দেওয়া হল সময়সীমা। বলে দেওয়া হল, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে লিঙ্ক না করলে অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা তোলা যাবে না। কার্যকর হল ‘চাপ’ থিওরি। আধারের সঙ্গে প্যানকার্ড লিঙ্ক করানোর হুড়োহুড়ি পড়ে গেল। ব্যাঙ্কের, পোস্ট অফিসের সামনে লম্বা লাইন। কোথাও কোথাও পুলিসকে লাঠিচার্জ করতে হল। মানুষ রাত জেগে, লাইন দিয়ে, লড়াই করে আধারের সঙ্গে প্যান নম্বর লিঙ্ক করাল। যাঁরা লাইন দিতে পারলেন না তাঁরা ফি ছাড়াও দিলেন ঘুষ। তারপরেও কিছু মানুষ বাইরে থেকে গেল। কিছুটা অজ্ঞতা, কিছুটা ইচ্ছাকৃত।
সরকারি নির্দেশ অমান্য! তাই ধার্য হল জরিমানা। ১০০০ টাকা। বহু সাধারণ মানুষও জরিমানা দিয়ে লিঙ্ক করালেন। কারণ প্রচার করে দেওয়া হল, এরপর জরিমানার পরিমাণ হবে নাকি ৫০০০ টাকা। ফাইন আর ফি মিলিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের ঘরে ঢুকল মোটা টাকা। সেই সঙ্গে উন্মুক্ত হয়ে গেল আম জনতার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট সাফা করার রাস্তাও।
তবে, সর্বনাশের ষোলোকলা পূর্ণ হল কার্ডলেস ক্যাশ সিস্টেম চালুতে। যার পোশাকি নাম আধার এনাবেল পেমেন্ট সিস্টেম(এইপিএস)। এই পদ্ধতিতে কাস্টমার সার্ভিস পয়েন্টে আঙুলের ছাপ দিয়ে দিনে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত তোলা যায়। আর মোবাইল লিঙ্ক না থাকলে মেসেজও যাবে না। আগে কেবল ওটিপি শেয়ার করলে টাকা গায়েব হতো। এখন টাকা চোররা ওসবের ধারই ধারছে না। জমির দলিলে কিংবা সিম কার্ড নেওয়ার সময় দেওয়া আঙুলের ছাপ ক্লোন করে তুলে নিচ্ছে টাকা। ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট ফাঁকা করার জন্য অপরাধীরা রীতিমতো গবেষণা চালাচ্ছে। 
নতুন ভ্যাকসিন বা জীবনদায়ী ওষুধ বাজারে ছাড়ার আগে খতিয়ে দেখা হয় তার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। হাজার হাজার মানুষ মরছে দেখেও করোনা ভ্যাকসিন আবিষ্কারের পর বহুভাবে পরীক্ষা করা হয়েছিল। তারপরেই তা মানুষের শরীরে প্রয়োগের জন্য ছাড়া হয়েছিল বাজারে। নতুন কিছু চালুর আগে তার সুরক্ষার সবদিক দিয়ে ক্ষতিয়ে দেখতে হয়। এটাই নিয়ম। 
তাই ১৪০ কোটি জনসংখ্যার দেশের প্রধানমন্ত্রী নতুন সিস্টেম চালু করলে তার সুরক্ষা নিয়ে কোনও সংশয় থাকার কথা নয়। তার উপর তিনি এমন একজন প্রধানমন্ত্রী যিনি নিজেকে কখনও চৌকিদার, কখনও পাহারাদার বলেন। প্রয়োজন পড়লে ছাপ্পান্ন ইঞ্চি ছাতির কথাও মনে করিয়ে দেন। আবার ‘গ্যারেন্টার’ও হয়ে যান। সেই চৌকিদারের আমলে চালু হওয়া সিস্টেমেই আম জনতার সুরক্ষিত ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টও হয়ে গিয়েছে ‘চিচিং ফাঁক’! এরপর তো প্রশ্ন উঠবেই, এ কেমন চৌকিদার?
10Months ago
কলকাতা
রাজ্য
দেশ
বিদেশ
খেলা
বিনোদন
ব্ল্যাকবোর্ড
শরীর ও স্বাস্থ্য
সিনেমা
প্রচ্ছদ নিবন্ধ
আজকের দিনে
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
mesh

পারিবারিক অশান্তির অবসানে গৃহ সুখ ও শান্তি বাড়বে। প্রেমের ক্ষেত্রে শুভ। কর্মে উন্নতি। উপার্জন বৃদ্ধি।...

বিশদ...

এখনকার দর
ক্রয়মূল্যবিক্রয়মূল্য
ডলার৮৩.২৬ টাকা৮৪.৩৫ টাকা
পাউন্ড১০৬.৪৬ টাকা১০৯.১২ টাকা
ইউরো৮৯.৭৬ টাকা৯২.২০ টাকা
[ স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া থেকে পাওয়া দর ]
*১০ লক্ষ টাকা কম লেনদেনের ক্ষেত্রে
দিন পঞ্জিকা