বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
বিশেষ নিবন্ধ
 

কেতা দেখিয়ে দুর্গম পথ পেরনো কঠিন
পি চিদম্বরম

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি একজন আপাদমস্তক শোম্যান। জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনে বিশ্ব নেতাদের সামনে তাঁকে বেশ আশ্বস্ত এবং স্বচ্ছন্দ দেখাচ্ছিল। তিনি যাতে গুছিয়ে এবং সম্পূর্ণ নির্ভুলভাবে ভাষণ দিতে পারেন, সেসব তৈরি করে দেওয়ার জন্য মোদিজির একটা টিম আছে। এবং তিনি এও জানেন, কীভাবে তাঁর মন্ত্রীদের জন্য এক ইঞ্চিও জায়গা না ছেড়ে ক্যামেরা ফ্রেমের পুরোটারই দখল নিতে হয়।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তাঁর খুশিমতোই মিডিয়াকে দূরে সরিয়ে রেখেছেন। তিনি মিডিয়া থেকে শুধু নিজেকেই দূরে রাখেননি, তাঁর সরকার এটাও নিশ্চিত করেছে যে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনও যেন আগ্রহী সাংবাদিকদের কোনও প্রশ্ন না নেন। এতে আমেরিকান প্রতিনিধি দল এতটাই হতাশ হয়েছিল যে তারা জানিয়েছিল, জি-২০ বৈঠক সংক্রান্ত প্রশ্নের উত্তর বাইডেন সাহেব দেবেন তাঁর পরবর্তী স্টপ ভিয়েতনামে!
ব্যাপক কেতা
টাকাপয়সা কোনও বাধা হয়নি। দিল্লিজুড়ে রাস্তাঘাট, গাছপালা, টবের গাছ, ঘাস, আলো (এবং আরও আলো), ভাস্কর্য, বিলবোর্ড প্রভৃতি সমস্তই ফের সাজসজ্জায় মুড়ে দেওয়া হয়েছে। একটা শহরের জন্য যতটা সাজসজ্জা প্রয়োজন করা হয়েছে তার চেয়ে অনেক বেশিই। জি-২০-র পরবর্তী আসর যে রিও ডি জেনেইরোতে বসবে, আমাদের অব্যবহৃত কিছু জিনিস আমরা তাদেরকেই অফার করতে পারি। সর্বত্র মুখ দেখা গিয়েছে একটাই। বিলবোর্ডগুলিতে, এমনকী, সফররত কোনও অতিথি নেতাকেও সামান্য ঠাঁই দেওয়া হয়নি সেখানে।
সারকথা
সমস্ত সরকারি বিবৃতির মতো, দিল্লি ঘোষণাতেও কিছু লম্বা-চওড়া কথা পাওয়া গিয়েছে। উদাহরণ: ‘আমরা ইতিহাসের একটি নির্দিষ্ট মুহূর্তে মিলিত হই, যেখানে গৃহীত সিদ্ধান্তগুলি আমাদের জনগণ এবং এই গ্রহের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করে দেয়।’ আমি নিশ্চিত যে, নেতাদের পূর্ববর্তী শীর্ষ সম্মেলনগুলিতেও অনুরূপ কথাবার্তা উচ্চারিত হয়েছিল, এবং কোনও সন্দেহ যে, এসব শব্দাবলি, বাক্য পরবর্তী বৈঠকেও ব্যবহৃত হবে।
ইতিবাচক ফলাফল হল:
• ইউক্রেনের যুদ্ধকে ‘ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ না বলে অন্যভাবে বর্ণনা করার জন্য সঠিক শব্দ খুঁজে বের করা। রাশিয়া এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র (এবং তার মিত্ররা) এই কৌশলটাকে গ্রহণযোগ্য বলেই মনে করেছে, এটা বিরাট এক প্রাপ্তি। সম্ভবত, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন এবং চীনের প্রেসিডেন্ট জিনপিংয়ের অনুপস্থিতি এক্ষেত্রে সুবিধা করে দিয়েছে। আমার এই ধারণা হয়েছে যে, সবাই ইউক্রেনকে ছবির বাইরে রাখতে চেয়েছে, যাতে তারা অর্থনৈতিক সমস্যাগুলির সমাধানের কাজটি শুরু করতে পারে—জি-২০ সম্মেলনের এটাই তো মূল দায়িত্ব-কর্তব্য।
• বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লুটিও) প্রতি পূর্ণ আস্থা প্রকাশ করা হয়েছে মূলত দুটি বিষয়কে সামনে রেখে: (১) সবার জন্য একটি অনুকূল বাণিজ্য ও বিনিয়োগের পরিবেশ সৃষ্টি করা এবং (২) বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য ২০২৪ সালের মধ্যে সমস্ত সদস্য রাষ্ট্রের সামনে একটি উন্মুক্ত পরিপূর্ণ ও সত্যিকার কার্যকরী ব্যবস্থার গড়ে তোলা। ২০১৯ সালে ট্রাম্প সাহেবের আকস্মিক ক্ষোভের পর এটা স্বাগত জানাবার মতোই একটা সঙ্কল্প। ডব্লুটিও-র ডিরেক্টর জেনারেল এনগোজি ওকোনজো ইওয়েলার সক্রিয় উপস্থিতিতে ব্যাপারটা সুনিশ্চিত হয়েছে। 
• শ্রমশক্তির অংশগ্রহণের (লেবার ফোর্স পার্টিসিপেশন বা এলএফপি) ব্যবধান কমানোর প্রতিশ্রুতি পুনরায় নিশ্চিত করা; কর্মসংস্থানের সুযোগগুলিকে অন্তর্ভুক্তিমূলক করে তোলা; লিঙ্গভিত্তিক বেতন বৈষম্যের বিলোপসাধন; লিঙ্গ-ভিত্তিক হিংসা দূর করা—তার মধ্যে ধরা হয়েছে যৌনহিংসা, হয়রানি, বৈষম্য ও মহিলাদের উপর নির্যাতন প্রভৃতি। কর্মস্থলে নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করা এবং লিঙ্গ বৈষম্যকে স্থায়ী রূপদানের অনাচারগুলিকে (যেমন—বিশেষ লিঙ্গের প্রতি বিদ্বেষ অথবা পক্ষপাত) বন্ধ করা। 
• সমস্ত প্রকারের সন্ত্রাসবাদের নিন্দা করা। তার মধ্যে ধরা হয়েছে—অন্য দেশের লোক সম্বন্ধে অকারণ ভীতি ছড়ানো, বর্ণবাদ এবং ধর্ম অথবা বিশ্বাসের নামে অসহিষ্ণুতার প্রকাশ। সকল ধর্মের তরফে শান্তিস্থাপনের প্রতিশ্রুতিকে এখানে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।
৩৪-পৃষ্ঠা এবং ৮৩-অনুচ্ছেদ বিশিষ্ট ঘোষণাটি মোটামুটিভাবে পূর্ববর্তী সিদ্ধান্ত এবং চালু উদ্যোগগুলিরই একটি অনুমোদন।
পথ কিন্তু দুর্গম
ভারত দাবি করেছে—এবং মিডিয়া বিশ্বস্তভাবে রিপোর্ট করেছে—জি-২০ দেশগুলির মধ্যে ভারত একটি মর্যাদাপূর্ণ স্থান দখল করেছে এবং এই আন্তর্জাতিক সম্মেলনে ২০২৩ সালে ভারতের সভাপতিত্ব একটি ঐতিহাসিক ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত হয়ে রইল। ভারতও দাবি করেছে, এই মর্যাদা অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে তার ব্যতিক্রমী পারফর্ম্যান্স এবং নেতৃত্ব প্রদানে প্রধানমন্ত্রীর অনবদ্য ভূমিকার কারণে। অথচ সবাই জানে, জি-২০ সম্মেলনে সভাপতির দায়িত্ব (প্রেসিডেন্সি) প্রাপ্তিটা কোনও বিরাট প্রতিযোগিতায় জিতে পাওয়ার ব্যাপার নয়। প্রেসিডেন্সির সম্মানটা রোটেশনে আসে। যেমন এরপরের বছর (২০২৪) পাবে ব্রাজিল। একই নিয়মে দায়িত্বভার দক্ষিণ আফ্রিকার উপর বর্তাবে ২০২৫ সালে। ২০২৬ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে দিয়ে শুরু হবে নতুন একটি রোটেশন।
এছাড়া গত ন’বছরে ভারতীয় অর্থনীতির পারফরম্যান্স ব্যতিক্রমী কিছু হয়নি। ভারতের বৃদ্ধির হার ছিল মাঝারি (গড় ৫.৭ শতাংশ)। এমনকী, অন্যদের মধ্যে প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির ভিজিটিং প্রফেসর ডঃ অশোক মোদিও বৃদ্ধির এই পরিসংখ্যান উল্লেখ করেছেন। তিনি জানিয়েছেন, ২০২৩-২৪ সালের প্রথম ত্রৈমাসিকে ৭.৮ শতাংশ বৃদ্ধির যে কথা বলা হয়েছে, সেটি ছিল ‘উৎপাদন থেকে আয়’-এর উপর ভিত্তি করে, সেখানে ব্যয়ের দিক থেকে বৃদ্ধিটা ছিল মাত্র ১.৪ শতাংশ। কিন্তু এই অসঙ্গতি কেন, তার ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি। ন্যাশনাল স্ট্যাটিস্টিকাল অফিস (এনএসও) প্রথম সংখ্যাটিকে সঠিক বলেই ধরে নিয়েছে। তবে দ্বিতীয় সংখ্যাটির ব্যাপারে তারা জানিয়েছে যে, সেটি যথাসময়ে সংশোধন করা হবে। প্রফেসর মোদির মতে, ‘যখন আমরা ভারতীয় ডেটাতে ব্যুরো অব ইকনমিক অ্যানালিসিস (বিইএ) পদ্ধতি প্রয়োগ করি, তখন বৃদ্ধির সাম্প্রতিক উজ্জ্বল হারটি ৭.৮ শতাংশ থেকে ৪.৫ শতাংশে নেমে আসে।’ প্রফেসর মোদির উপসংহার আমাদের গ্রহণ করতে হবে না, তবে মন্থর গতির বৃদ্ধি, ক্রমবর্ধমান বৈষম্য এবং চাকরির অভাব সম্পর্কে তাঁর পর্যবেক্ষণগুলি অনস্বীকার্য। বৈষম্য এবং বেকারত্ব সম্পর্কে পর্যবেক্ষণের সমর্থনে পূর্ববর্তী নিবন্ধগুলিতে তথ্যাদি আমি দিয়েছি।
বৃদ্ধির পরিসংখ্যান বাদ দিয়ে, ভারতের কিছু প্রতিশ্রুতি এবং আশ্বাস দেখে ভীষণই অবাক হয়েছি: কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের স্বাধীনতা; ক্ষুদ্র, ছোট ও মাঝারি শিল্প-ব্যবসার (এমএসএমই) উদ্ভাবন এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টি; রক্ষণশীলতাকে নিরুৎসাহিত করা এবং বাজারের তরফে বিকৃতির চর্চা; সামাজিক সুরক্ষা সুবিধার বহনযোগ্যতা (পোর্টেবিলিটি); এবং এটাই নিশ্চিত করা যে কেউ পিছনে পড়ে থাকবে না। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে, এই মারাত্মক এজেন্ডা বা কর্মসূচি রূপায়ণ করতে হলে হয় সরকারকে তার নীতি বদলাতে হবে অথবা এই সরকার পরিবর্তন করে ফেলতে হবে জনগণকে।
ভারত, আজকে, এই গ্রুপ অব টোয়েন্টির শীর্ষস্থানের কাছাকাছি কোথাও নেই। মাথাপিছু আয়, মানব উন্নয়ন সূচক (এইচডিআই), শ্রমশক্তির অংশগ্রহণের হার (এলএফপিআর), বিশ্ব ক্ষুধা সূচক (জিএইচআই) এবং অন্যান্য মাপকাঠির একেবারে নীচের দিকেই রয়েছে আমাদের দেশ। আশা করি, শীর্ষস্থান অর্জন করার লক্ষ্যে জি-২০ সম্মেলনে ভারত যেমনটা বলেছে কাজও করে যাবে সেইমতো।
 লেখক সাংসদ ও ভারতের প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী। মতামত ব্যক্তিগত

18th     September,   2023
 
 
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ