১৩ সেপ্টেম্বর রাত ৯টার আশপাশ। সল্টলেকের সিজিও কমপ্লেক্স। টানা ৯ ঘণ্টা জেরার পর কালো টি-শার্ট আর জিনস পরা এক তরুণ শান্তভাবে বেরিয়ে আসছেন। এতটুকু টেনশন নেই চোখেমুখে। যেন বারবার জেরা সামলে বীরদর্পে বেরিয়ে আসা ও মিডিয়ার সামনে দাঁড়ানো তাঁর কাছে জলভাত। অতঃপর সওয়া এক ঘণ্টার সাংবাদিক সম্মেলন। এবং সেই প্রশ্ন-উত্তর আদানপ্রদানের পুরোটাই রাস্তায় দাঁড়িয়ে। শুরুটা টিপটিপ বৃষ্টিতে ছাতা মাথায়। তারপর বৃষ্টি থেমে গেলেও চলল প্রশ্নোত্তরের পালা। অতিবড় নিন্দুকও তাঁর স্ট্যামিনার প্রশংসা না করে পারবে না। অনেক অপ্রিয় প্রশ্নবাণও ছিল তার মধ্যে। একযোগে বাংলা ইংরাজি ও হিন্দিতে সাংবাদিকদের চোখা চোখা প্রশ্ন সামলাচ্ছেন তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক। দলের ঘোষিত সেকেন্ড ইন-কমান্ড। কোথাও কোনও জড়তা নেই। বিশেষ মেদিনীপুরিয়া টান নেই। নেই শূন্য হয়ে যাওয়া বামেদের ‘ভবিষ্যৎ মুখ্যমন্ত্রী’র গলার সেই পশ্চিম বর্ধমানের কোলিয়ারি এলাকার ছায়াও। শহুরে শব্দোচ্চারণ। তিনি বলে চলেছেন, ‘গতবার জিজ্ঞাসাবাদের নিট ফল ছিল শূন্য। আর এবার বলছি, মাইনাস ২। আবার ডাকলে ফল হবে মাইনাস ৪। ইন্ডিয়া জোটের বৈঠকে যাওয়া আটকাতেই এই ষড়যন্ত্র! যতবার ডাকবে, আসব, ১০ পয়সার লেনদেন প্রমাণ করে দেখাক ইডি, সিবিআই।’ এবং সেই সঙ্গে তাঁর বয়ান কোর্টে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে পেশ করার চ্যালেঞ্জ। মাত্র কিছুদিন আগেই প্রকাশ্যে মুখ্যমন্ত্রীই জানিয়েছেন, অভিষেক গ্রেপ্তার হতে পারে। সেই থেকে আশঙ্কা একটা আছেই। তারপরও এতটা মানসিক শক্তি যাঁর চলনে বলনে উপস্থিতিতে তাঁর উত্থান রুখবে কে?
২০১৬ সালের বিধানসভা ভোটে তাঁকে সেভাবে দেখিনি। কিন্তু উনিশের লোকসভা নির্বাচন ও বিশেষ করে একুশের বিধানসভার লড়াইয়ে তিনি হয়ে উঠেছেন দলের অন্যতম চালিকাশক্তি। এবং তখন থেকেই তিনি বাংলার জননেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছায়া থেকে বেরিয়ে নিজের একটা আলাদা আইডেন্টিটি তৈরি করেছেন। যার সাম্প্রতিকতম উদাহরণ ধূপগুড়ির উপ নির্বাচন। ঠাকুরপাট ফণীর মাঠে গত ৩ সেপ্টেম্বর প্রকাশ্য সভায় পৃথক মহকুমা গঠনের প্রতিশ্রুতি দেন তিনি। ব্যস, ওইটুকুতেই রসায়ন বদলে যায়। বিরোধীরাও স্বীকার করছে, ওটা ছিল গেম চেঞ্জার। ওই একটা ঘোষণা ধূপগুড়ি পুনরুদ্ধারে সবচেয়ে নির্ণায়ক ভূমিকা নিয়েছে। যাঁরা সাগরদিঘি মডেলের ধ্বজা উড়িয়েছিল কয়েক মাস আগে, তাঁদের জামানতই জব্দ। আর উত্তরবঙ্গ ভাগের কারিগর বিজেপি? অনন্ত মহারাজকে রাজ্যসভায় পাঠিয়ে রাজবংশী ভোটব্যাঙ্ক দখলের চেষ্টা আপাতত মাঠেই মারা গিয়েছে গেরুয়া শিবিরের।
চোখ বুঝলে এখনও দেখতে পাই ২ মে, ২০২১। সকাল থেকে টানটান উত্তেজনা। বেলা বাড়তেই একপশলা বৃষ্টি সঙ্গে দমকা হাওয়া। এবং সেই সঙ্গে স্বস্তি। গরম থেকে নয়, দমবন্ধ করা নেগেটিভ প্রচার থেকে। না, অনেক কাড়া-নাকাড়া বাজিয়েও বাংলার বারোটা বাজাতে বহিরাগতরা ব্যর্থ। শক হূন দল পাঠান মোগল, আমাদের জন্মের অনেক আগের ইতিহাস। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই লড়াই ও তার পরিণাম একদম টাটকা। স্বাস্থ্যসাথী, লক্ষ্মীর ভাণ্ডার, বার্ধক্য ভাতা, কন্যাশ্রী, সবুজসাথী হারিয়ে দিয়েছে নরেন্দ্র মোদি ও অমিত শাহের ডেলি প্যাসেঞ্জারিকে, ডাবল ইঞ্জিনের দু’হাত ভরা লাড্ডুকে। তাঁদের তৃণমূল ভাঙার হীন প্রচেষ্টা সফল হয়নি। দু’হাতে অর্থ, পদ এবং ক্ষমতা বিলিয়েও তৃণমূলের বিকল্প গড়তে পারেনি বিজেপি। কারণ যোগ্য নেতৃত্ব ও মুখের অভাব। অত ঢাকঢোল পিটিয়েও গেরুয়া শিবির আজও থমকে। জানি না, তাঁরা একান্তে বিশ্বাস করেন কি না যে, তাঁদের ধর্ম আছে, মেরুকরণ আছে, ইডি আছে, সিবিআই আছে, কিন্তু একজন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নেই। নিদেনপক্ষে অভিষেকও নেই। তাই যতবার লড়বি, ততবার হারবি!
সেই ঐতিহাসিক ২ মে’র পর কেটে গিয়েছে ২৭ মাস। ইডি, সিবিআইয়ের তল্লাশি, একের পর এক গ্রেপ্তার। তবু কি তৃণমূলের জনসমর্থনের ভিত নড়ানো গিয়েছে? শহুরে সমালোচনায় কিছু নেতিবাচক দিক প্রাধান্য পেলেও তা ভোটবাক্সে কী চেহারা নেবে, তা নিয়ে সন্দিহান প্রধান বিরোধীরাই। পুরসভা থেকে পঞ্চায়েত তারই মুক্ত প্রদর্শনী। আর উত্তর ও দক্ষিণের বিস্তৃত গ্রাম বাংলা, জেলা শহর এখনও আচ্ছন্ন সরকারের জনমুখী একের পর এক প্রকল্প নিয়ে। সবুজসাথীর সাইকেলে চেপে গ্রামের রাস্তায় গোল্লাছুট, রুখবে কে?
গত ১৪ সেপ্টেম্বর সকাল ৮টা। বেশ জোরেই বৃষ্টি পড়ছে। একেবারে কলকাতা লাগোয়া একটি দুয়ারে সরকার ক্যাম্পের উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে রয়েছি। ওই সকালেই বৃষ্টি মাথায় করে বৃদ্ধবৃদ্ধা, মহিলা এমনকী ছাত্রীদের পর্যন্ত ভিড়। ছাত্রীদের ইউনিফর্ম দেখে মনে হল, ওরা এসেছে কন্যাশ্রীরই ফর্ম তুলতে। অজ পাড়াগাঁ নয়, শহর কলকাতার একেবারে পাশে। এদের কাছে দুর্নীতি, গ্রেপ্তার, কলকাতাকেই সর্বভারতীয় সংস্থা ইডি, সিবিআইয়ের সদর দপ্তর বানিয়ে ফেলার কোনও ছাপ পড়েছে বলে মনে হল না। কেউ স্বাস্থ্যসাথী, কেউ বার্ধক্য ভাতা কেউ আবার লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের ফর্ম ফিল-আপ করেই ফিরে যাচ্ছেন হাসি মুখে, ভিজতে ভিজতে। এই জনতা ভোটটা দেবেন কাকে? খুব বড় রহস্য কি? কলকাতাতেই যদি এই অবস্থা হয়, তাহলে দূর গ্রামে কী অবস্থা সহজেই অনুমান করতে পারি। ইডি ও তার দোসর সিবিআইয়ের অতিসক্রিয়তার আসল কারণ কিন্তু সাধারণের কাছে ধরা পড়ে গিয়েছে। আগামী ৬-৭ মাস পর লোকসভা ভোট মিটে গেলেই এই বঙ্গে ইডির ব্যস্ততা যে কমে যাবে, তাও দস্তুর। বিচার প্রক্রিয়া কি তখনও শুরু হবে? নাকি আবার দোকান খুলবে ২০২৬ সালে বিধানসভা ভোটের আগে। অক্সিজেন, নাইট্রোজেন, কার্বন সাইকেলের মতো কেন্দ্রীয় এজেন্সির এই অতিসক্রিয়তার চক্রটাকেও কিন্তু মানুষ ধরে ফেলেছে।
কাট টু সিপিএমের রাজ্য কমিটির বৈঠক। অকুস্থল আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের সদর দপ্তর। উপস্থিত সবারই মুখ শুকনো। ধূপগুড়ি সব উৎসাহে এক লহমায় যেন জল ঢেলে দিল। এত সভা, জেলায় জেলায় এত লোক সমাগম। তারপরও নিটফল শূন্য। বাড়ছে না ভোট। সংখ্যালঘু ভোট ভাঙার মরণ খেলায় আপাতত কি তবে ইতি? পঞ্চায়েত ভোটের পর উপ নির্বাচনেও মুখ থুবড়ে পড়েছে বামেরা। সাগরদিঘি মডেল নিয়ে যারা ঝড় তুলেছিল বাইনারি ভেঙে গিয়েছে বলে, ধূপগুড়ি নিয়ে এখন তাদেরই আশ্চর্য নীরবতা। জামানত জব্দ হলেও আলিমুদ্দিনের ছোট-মেজো কর্তারা অবশ্য শুকনো মুখে কপাল ঠুকে বলছেন, ৬০০ ভোট তো বেড়েছে। একদা বামেদের ঘাঁটি কোচবিহার জেলায় ক্ষমতা যাওয়ার একযুগ পরও জামানত রক্ষা করা দায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবু ওই ৬০০ ভোটই নাকি সান্ত্বনা পুরস্কার! সিপিএমের বৈঠকে জেলার নেতারা একটা আশঙ্কা কিন্তু কিছুতেই চেপে রাখতে পারছেন না। লোকসভা ভোট যত এগিয়ে আসবে, বাইনারি ততই চেপে বসবে। এর থেকে মুক্তির ইঙ্গিত নেই। ‘দিদিভাই-মোদিভাই’ কৌশলও মানুষকে আর খাওয়ানো যাচ্ছে না। আবার ২০১৯ ও ২০২১’এর লোকসভা ও বিধানসভা ভোটের মতোই শূন্যের মধ্যেই পুণ্য খুঁজে নিতে হবে আলিমুদ্দিনের কর্তাদের। কারণ মালদহ ও মুর্শিদাবাদ, দিনাজপুর ছাড়া কংগ্রেসেরও আসন জেতার তেমন কোনও সুযোগ আছে বলে মনে হচ্ছে না। বামেরাই স্বীকার করছেন, যে অল্প স্বল্প ভোট বেড়েছে তা ছড়িয়ে ছিটিয়ে। কোনও ক্লাস্টার, জেলা কিংবা এলাকা ধরে তা বাড়েনি। তাই আসনের নিরিখে তেমন কোনও হেরফের হচ্ছে না। এই আসনটা আমাদের, ঘাম ঝরাতে পারলেই জেতা যাবে—এমন কথাও বুকে হাত দিয়ে বলার মতো অবস্থায় নেই বাম নেতৃত্ব।
এটা সম্ভবত দিল্লির দীনদয়াল উপাধ্যায় মার্গের কর্তারাও স্বীকার করবেন, বাংলায় বিজেপি এক আশ্চর্য ক্ষয়রোগে আক্রান্ত। দু’বছর আগে তবু বলার মতো হাফ ডজন নেতা ছিল। আজ কমতে কমতে সবেধন নীলমণি একজনই। তাঁকেও কি দলের সব অংশ মেনে নিতে রাজি? রাজ্য সভাপতি এখনও বিশেষ একটি জেলার নেতা। তাই নারদ কাণ্ডে অভিযুক্ত দীর্ঘ সময় তৃণমূলের পাতের উচ্ছিষ্ট খাওয়া একজনই মুখ এবং মুখোশ। মেদিনীপুরিয়া টানে ইংরেজি বলা সেই ভদ্রলোক যদি কলকাতায় এসে শেক্সপিয়ারের হ্যামলেট নাটকের সংলাপ বলতে যান, মানুষ কি তা গ্রহণ করবে? তাই উত্তর থেকে দক্ষিণ, সর্বত্র বঙ্গ বিজেপির পিছু হটা যেন অনিবার্য দেওয়াল লিখন! একুশে এরাজ্যে বিজেপির সংগঠন চাঙ্গা হয়েছিল দিলীপ ঘোষকে ঘিরে। তিনি কোনও দলবদলু নন। তাঁর জীবনযাত্রাও জমিদারের মতো নয়। বিরাট দামি গাড়ি নেই, সাতমহলা বাড়িতেও থাকেন না। আগমার্কা আরএসএস। কিন্তু অদৃশ্য কারণে বঙ্গ বিজেপিতে এই মুহূর্তে তিনি ব্রাত্য। এরাজ্যে পার্টির বড় বড় কর্মসূচিতে ইদানীং তাঁকে আর বড় একটা দেখা যায় না। এর পিছনে কার আপত্তি কিংবা কোন গোষ্ঠী সমীকরণ কাজ করছে জানি না। তবে এতে যে দলেরই ক্ষতি হচ্ছে তা স্বীকার করতে বাধা নেই। এবং এটাও ভোলা যাবে না, রাজ্য বিধানসভায় তিনি একটা সময় একা গেরুয়া পতাকা হাতে লড়াই করেছিলেন। তাই এই ছন্নছাড়া সংগঠন নিয়ে এবারও অমিত শাহদের টার্গেট রক্ষা করা যে অসম্ভব তা বুঝতে কারও বাকি নেই। তাই লক্ষ্য ক্রমেই কমানো হচ্ছে। এখনও পর্যন্ত বঙ্গ রাজনীতি যেখানে দাঁড়িয়ে তাতে উত্তরবঙ্গও নড়বড়ে হয়ে যাচ্ছে। তাই গতবারের ১৮ আসন কমতে কমতে কমতে কোথায় নামবে, তা বড় প্রশ্ন। ইস্যু যতই গুরুতর হোক না কেন দুর্নীতি যে গ্রাম বাংলা ও জেলা শহরের সিংহভাগ এলাকায় তেমন কোনও ভোটের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়ার মতো নির্ণায়ক হতে পারেনি, তা একবাক্যে সকলে স্বীকার করছেন। আর মোদি বনাম ইন্ডিয়া জোটের লড়াইয়ে এবারও এরাজ্যে সংখ্যালঘুদের নিরাপদ আশ্রয় তৃণমূলই থাকছে। লোকসভা ভোটে তৃণমূলের প্রাপ্তি যদি আগের বারের চেয়েও বেশি হয়, তাহলে বলতেই হবে বিগত অর্ধশতকের বঙ্গ রাজনীতিতে জাদুদণ্ড ওই কালীঘাটের আটপৌরে মহিলার আঁচলেই বাঁধা। বাকিদের দেখা যায় না দূরবিনেও!