বিশেষ নিবন্ধ

বিজেপির ভূষণ ব্রিজভূষণ নিয়ে মোদি চুপ কেন
সন্দীপন বিশ্বাস

২০১৬ সালের ২৬ আগস্ট হরিয়ানার মুখ্যমন্ত্রী মনোহরলাল খট্টর ওলিম্পিক পদক বিজয়ী সাক্ষী মালিককে ‘বেটি বচাও বেটি পঢ়াও’ এর ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর করলেন। কিন্তু সেই ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর বা দেশকে সম্মান এনে দেওয়া গোল্ডেন বেটিকেই আজ বাঁচানোর কেউ নেই। তিনি একা নন, দেশের মুখ উজ্জ্বল করা অসংখ্য বেটি আজ নিপীড়ন ও শ্লীলতাহানির হাত থেকে বাঁচতে চেয়েছিলেন রাষ্ট্রের সাহায্য। চেয়েছিলেন অভিযুক্তের বিচার করে তাঁকে শাস্তি দেওয়া হোক। কিন্তু রাষ্ট্র তাঁদের দিকে এখনও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়নি। বরং বলপ্রয়োগ করে তাঁদের প্রত্যেককে অসম্মানের শেষ সীমায় ঠেলে দেওয়া হয়েছে। রাষ্ট্রের গুন্ডামিতে দেশের তারকা বেটিরা প্রকাশ্যে অসম্মানিত। এই অসম্মান ছুঁয়ে গিয়েছে দেশের প্রত্যেকটি মেয়েকে। তাহলে আমাদের নিরাপত্তা দেবে কে? নিরাপত্তার জন্য আমাদের কি সকলকেই মোদিভক্ত হতে হবে? কোনও অন্যায়ের প্রতিবাদ করা যাবে না? কোথায় তবে গণতন্ত্র? অবশ্য দেশে গণতন্ত্র অনেকদিন আগে থেকেই ভ্যানিশ। এখন আবার হীরক রাজার হুকুমে উদয়ন পণ্ডিতরা আর ছাত্রদের গণতন্ত্রের পাঠ দিতে পারবেন না। এসবের মধ্য দিয়ে মোদিজি ফের বুঝিয়ে দিয়েছেন, তিনি সম্ভবত গণতন্ত্রকে ভয় পান।
এই ঘটনা সারা বিশ্বের দরবারে দেশকে ফের কলঙ্কিত করল। মোদি সরকারের কাজকর্ম কতবার যে বিশ্বের মানুষের কাছে দেশকে ছোট করেছে, তা বোধহয় গুনে শেষ করা যাবে না। এবার কিন্তু নির্লজ্জতার সমস্ত সীমা লঙ্ঘন করে বিজেপি সরকার দেশের মানুষের মনে অগ্নিরোষ সৃষ্টি করল। আমাদের লজ্জা যে, বহু অপরাধে অভিযুক্ত বেশ কিছু মানুষকে আমরা সংসদে পাঠিয়েছি। এইসব ডনের অতীত কলঙ্কিত। এঁদের কারও বিরুদ্ধে রয়েছে ডাকাতি, খুন কিংবা ধর্ষণের অভিযোগ। সব জেনেও মানুষ বাহুবলীদের ভোট দেন কেন? আসলে সুখের থেকে স্বস্তি ভালো। গব্বর সিংয়ের সংলাপ মনে আছে তো? ‘গব্বর সিংয়ের হাত থেকে কাউকে বাঁচাতে পারে মাত্র একজনই, সে হল স্বয়ং গব্বর সিং।’ তাই বহু ক্রিমিন্যাল কেসে জড়িয়ে থাকা অভিযুক্তরা আজ আমাদের দেশের সংসদ আলো করে বসে আছেন! দেশটাকে অন্ধকারের দিকে ঠেলে দিচ্ছেন। তাঁদের মাথার উপর আরও বড় ক্ষমতাধারীদের আশীর্বাদ না থাকলে এটা সম্ভব হতো না।
২০২৩ সালের ২৮ মে দিনটি ভারতের ইতিহাসে একটি কালো দিন। সেদিন রাজধানীর পথে কত বড় কুনাট্যের অবতারণা হল। যেদিন নতুন সংসদ ভবনের ঘটা করে উদ্বোধন হল, সেদিনই রাজপথে লাঞ্ছিত হলেন কুস্তিগীররা। প্রহসনটা নিমেষেই ধরা পড়ে গেল। রাজদণ্ড হাতে নেওয়ার পর, রাজা সাজার বাসনা পরিপূর্ণ করার পরেও রাজা ন্যায়বিচার করতে পারলেন না। তিনি মানুষের রাজা হতে পারলেন না। যেমন তিনি বিজেপির প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, তেমনই রইলেন। কার্যত প্রথম দিনেই খসে পড়ল তাঁর রাজদণ্ড! 
সারা দেশ আজ অবাক! তাঁদের প্রশ্ন, কেন একজন এমপিকে আড়াল করতে চাইছেন প্রধানমন্ত্রী? সেটা ভয়ে না ভক্তিতে? এই প্রশ্নের দৃষ্টিকোণ থেকে পরিপ্রেক্ষিতটা একটু বিচার করে যাক।
২০০৪ সালের ১৮ জুন একটি সর্বভারতীয় সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছিল একটি খবর। কী ছিল সেই খবরে? সেই খবরটা হল, গোন্ডা জেলার নবাবগঞ্জ এলাকায় একটি ২২ বছরের ছাত্র নিজেকে গুলি করে আত্মঘাতী হয়েছেন। পিস্তলটি ছিল তাঁর বাবারই লাইসেন্সপ্রাপ্ত। গুলির শব্দ পেয়ে বাবা দৌড়ে গিয়ে দেখেন ছেলের রক্তাক্ত মৃতদেহ ঘরের মধ্যে পড়ে রয়েছে।  ছাত্রটি সুইসাইড নোটে লিখেছিলেন, ‘বাবা, তুমি একজন ভালো বা আদর্শ বাবা হিসাবে নিজেকে প্রমাণ করতে পারোনি। তুমি আমাদের ভাইবোনদের সুখ-সুবিধার ব্যাপারে কোনও খেয়ালই রাখোনি। তুমি সারাজীবন নিজের সুখ-সুবিধা ছাড়া আর কিছুই ভাবোনি। তাই বুঝেছি, আমাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। এছাড়া আমরা কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। তুমি চাও আমি তোমার পথই অনুসরণ করি। কিন্তু আমার পক্ষে তোমার ওই পথ অনুসরণ করা সম্ভব নয়। সেই জন্য আর বেঁচে থাকার কোনও প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না।’ দীর্ঘ সুইসাইড নোটের এটিই সারমর্ম। এটি লিখেছিলেন হতভাগ্য শক্তি সিং নামে এক যুবক। তাঁর বাবার নাম ব্রিজভূষণ সিং। ইনিই সেই অভিযুক্ত ব্রিজভূষণ। তিনি তখন ছিলেন বলরামপুরে বিজেপি এমপি। কেউ কেউ বলেন, বাবার কাজকর্ম, অন্ধকার জীবনের গল্প নাকি জেনে গিয়েছিলেন শক্তি। 
তাই লজ্জায়, অপমানে তাঁকে আত্মহত্যা করতে হয়েছিল। সুতরাং প্রশ্ন উঠেছে, যিনি নিজের ছেলেমেয়ের ব্যাপারে যত্নশীল নন, যাঁর কাজে 
লজ্জিত হয়ে নিজের ছেলেই আত্মহত্যা করেছেন, তিনি অন্যের ছেলেমেয়েদের ব্যাপারে কতটা যত্নশীল হতে পারেন, তা নিয়ে একশো শতাংশ সন্দেহ থাকবেই। যাঁরা অভিযোগ করছেন, তাঁরা তাঁর সন্তানের থেকেও ছোট। তার মধ্যে নাবালিকাও আছে। ভারতের কুস্তিগীরদের সংসারে তিনি প্রধান অভিভাবক। কিন্তু রক্ষক নিজেই যদি ভক্ষক হয়ে ওঠেন এবং সেই ভক্ষক যদি ক্ষমতার আশীর্বাদপুষ্ট হন, তবে কে ছোঁবেন তাঁকে? এ ছবি তো সেই কবেই এঁকে গিয়েছেন কবিগুরু। ‘কোন অন্ধ কারামাঝে জর্জ্জর বন্ধনে/ অনাথিনী মাগিছে সহায়? স্ফীতকায় অপমান/ অক্ষমের বক্ষ হতে রক্ত শুষি করিতেছে পান/ লক্ষমুখ দিয়া!’ 
বিজেপি নাকি পরিবারতন্ত্রকে ঘৃণা করে। কংগ্রেসকে ঠেস মারতে গিয়ে মোদিজি সারাদিনে বুক বাজিয়ে দশবার মানুষকে সেকথা শোনান। কিন্তু ব্রিজভূষণের চরণতলে এসে সেসব ‘মন কি বাত’ ভ্যানিশ হয়ে যায়। কেন? একবার দেখা যাক। ব্রিজভূষণের স্ত্রী কেতকী দেবী সিং গোন্ডা কেন্দ্রের এমপি। পুত্র 
প্রতীক ভূষণ সিং উত্তরপ্রদেশ গোন্ডা কেন্দ্রের এমএলএ। আর এক ছেলে করণ ভূষণ সিংও রাজনীতিক। তিনি এখন উত্তরপ্রদেশের কুস্তি মহাসঙ্ঘের প্রধান। আগামী লোকসভা নির্বাচনে প্রতীককে সংসদে পাঠিয়ে তাঁর বিধানসভা আসনটি করণকে দেওয়ার ইচ্ছেও নাকি আছে ব্রিজভূষণের। সেই সঙ্গে চান ভারতীয় কুস্তি মহাসঙ্ঘের আসনটিও ছেলেকে দিয়ে পরিবারতন্ত্রের সার্বিক জয়ধ্বনি করতে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী সব জানেন। কিন্তু তিনি যেন নিরুপায়, অনেকটা ধৃতরাষ্ট্রের মতো। 
২০২১ সালের আগস্ট মাসে কুস্তিগীর বিনেশ ফোগাট নাকি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে ব্রিজভূষণের বিরুদ্ধে তাঁর শ্লীলতাহানির অভিযোগ জানিয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রীও নাকি তাঁকে আশ্বাস দিয়েছিলেন ন্যায়বিচারের।  সেই খবর কিন্তু হাওয়ারও আগেই পৌঁছে গিয়েছিল ব্রিজভূষণের কানে। তারপর প্রধানমন্ত্রী এই অভিযোগ পেয়ে কী করলেন? কিছুই যে করেননি, তা তো প্রমাণিতই। অথচ এর আগে  শ্লীলতাহানি সংক্রান্ত এক অভিযোগে দলের এমপি তথা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী এম জে আকবরকে সরিয়ে দিতে বেশিক্ষণ চিন্তা করেননি মোদি। কিন্তু ব্রিজভূষণের উপর পকসো অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও তাঁকে বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা করা হচ্ছে। আকবর কোনও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন না। তাঁর ভোট টানার কোনও ক্ষমতা ছিল না। কিন্তু দাবাং ব্রিজভূষণ আপাদমস্তক রাজনৈতিক চরিত্র। ছ’বারের সাংসদ। উত্তরপ্রদেশের গোন্ডা এবং তার আশপাশের বিশাল এলাকাজুড়ে তাঁর প্রতিপত্তি। সশস্ত্র বাহুবলীরা তাঁকে ঘিরে থাকেন। বিশাল এলাকার তিনি স্বঘোষিত মসিহা। সংবাদ মাধ্যমে সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে ছাতি ফুলিয়ে তিনি বলতে পারেন, ‘আমি একটা খুন করেছি।’ কিন্তু তা সত্ত্বেও তাঁর কাছ পর্যন্ত আইন পৌঁছতে পারে না। 
আসলে বিজেপি যতই পুরাণ, রামায়ণ, মহাভারতের আদর্শ নিয়ে কথা বলুক না কেন, তারা কিন্তু ওইসব মহাকাব্য থেকে শিক্ষা নেয়নি। সীতাকে অপমান করে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল রাবণ। দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণের পাপে নির্বংশ হয়ে গিয়েছিল কৌরবরা। আজ যেন সেই পদধ্বনিই শোনা যাচ্ছে। দেশটা ক্রমেই ধর্ষকদের মৃগয়াক্ষেত্র হয়ে উঠছে। গুজরাতে বিলকিস বানো ধর্ষণে সাজাপ্রাপ্ত ‘ধর্ষক একাদশ’ গুজরাতের রাস্তায় কলার তুলে ঘুরে বেড়াচ্ছে। হাতরাসের ধর্ষকের সাজা হয়নি। ব্রিজভূষণের মতো বহু অভিযুক্ত ছাতি ফুলিয়ে ঘুরছেন। মোদি এঁদের ছুঁতে পারছেন না, নাকি ছুঁতে চাইছেন না। ব্রিজভূষণ কৈসরগঞ্জের সাংসদ। কিন্তু তাঁর রাজনৈতিক প্রতিপত্তি বিশাল। অন্তত সাতটি লোকসভা এবং ৪০টি বিধানসভা তাঁর হাতের মুঠোয়। অযোধ্যা এলাকা থেকে শুরু করে গোন্ডা, বাহরাইচ, সীতাপুর প্রভৃতি লোকসভা কেন্দ্রের সাংসদরা কেউই মোদি বা যোগীর অনুগত নন। সকলেই ব্রিজভূষণের অনুগত। মোদি জানেন, ব্রিজভূষণকে ছুঁলে চরম মূল্য দিতে হবে। একেই চব্বিশের ভোটে অস্তাচলে যাওয়ার কাউন্টডাউন শুরু হয়েছে, এর মধ্যে উত্তরপ্রদেশে যদি দলে বিরাট ভাঙন ধরে, তাহলে সামলানো যাবে না। ব্রিজভূষণকে ছুঁলে তিনি একাই বিজেপিকে খাক করে দিতে পারেন। সুতরাং ভোট বড় বালাই। ক্ষমতা হল নেশার মতো। তাই ব্রিজভূষণের সামনে এসে প্রশাসনকে চোখ বন্ধ করে ফেলতে হয়। কেননা মোদি আজ সরকার রক্ষার জন্য ব্রিজভূষণকে কবচকুণ্ডল বানাতে চাইছেন। কিন্তু বিজেপি জানে না, সাক্ষী মালিকদের চোখের জলে ভেসে যাবে সেই পাপের কবচকুণ্ডল! বেশিদিন তিনি আটকাতে পারবেন না। দেশের মানুষের প্রতিবাদে তাঁকে ব্রিজভূষণের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতেই হবে। 
13Months ago
কলকাতা
রাজ্য
দেশ
বিদেশ
খেলা
বিনোদন
ব্ল্যাকবোর্ড
শরীর ও স্বাস্থ্য
সিনেমা
প্রচ্ছদ নিবন্ধ
আজকের দিনে
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
mesh

পারিবারিক অশান্তির অবসানে গৃহ সুখ ও শান্তি বাড়বে। প্রেমের ক্ষেত্রে শুভ। কর্মে উন্নতি। উপার্জন বৃদ্ধি।...

বিশদ...

এখনকার দর
ক্রয়মূল্যবিক্রয়মূল্য
ডলার৮৩.২৬ টাকা৮৪.৩৫ টাকা
পাউন্ড১০৬.৪৬ টাকা১০৯.১২ টাকা
ইউরো৮৯.৭৬ টাকা৯২.২০ টাকা
[ স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া থেকে পাওয়া দর ]
*১০ লক্ষ টাকা কম লেনদেনের ক্ষেত্রে
দিন পঞ্জিকা